আলবেনিয়ার ডায়েরি-প্রথম পর্ব

রুয়া জর্দান মিসইয়ার স্কুলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
রুয়া জর্দান মিসইয়ার স্কুলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

খুব বেশি দিন হয়নি, তখন আমি ইউরোপে পা রেখেছি। সেভাবে বুঝে উঠতে পারিনি। সত্যি বলতে গেলে, তখনো ইউরোপের সমাজে অনেকটা বেমানানই বটে। কেন জানি বারবার নিজেকে পাশ্চাত্য সমাজব্যবস্থায় অবাঞ্ছিত বলে মনে হতো। বয়সেও তখন আমি একেবারে নবীন, আপাদমস্তক বলতে গেলে এক ছেলেমানুষ।

যেখানে খুব বেশি দিন হলো না একটা নতুন দেশে এসেছি এবং দেশটিকে নতুন করে জানারই সুযোগ সৃষ্টি হয়নি, সেখানে নতুন কোনো দেশে ভ্রমণের পরিকল্পনা নেহাত একটা বোকামি বলতে হবে। তবু কেন জানি অকস্মাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম।

প্রথম সেমিস্টার শেষে প্রায় দেড় মাসের একটা লম্বা ছুটি পেলাম। যদিও তখন পাঁচ মাস হয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ ছেড়ে ইউরোপে আসা। প্রথমে ভাবলাম ছুটিতে বাংলাদেশে যাব। পরিবারের কেউই এতে সায় দিল না। মাত্র কয়েক দিন হলো নতুন দেশে এসেছি, এ অবস্থায় আবার দেশে ফেরাটা বেমানান লাগছিল। এতে আমার গৃহকাতরতার মাত্রা জটিল পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাতে পারে। তখন হয়তোবা এমন হবে যে বাংলাদেশে যাওয়ার পর আর ইউরোপে ফিরে যেতে চাইব না।

কী আর করা। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ধরনের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, আইজেক নামটি তাঁদের কাছে পরিচিত। আইজেক গ্লোবাল ভলান্টিয়ারিং অর্গানাইজেশন। আইজেক দাবি করে, তারা যুবসমাজে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা–এসডিজি বাস্তবায়নের নেতৃত্ব গঠনের গুণাবলি বিকাশে কাজ করে থাকে। ১৯৪৮ সালে আইজেক প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে বিশ্বের ১২৮টি দেশে আইজেক সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

২০১৭–১৮ সালের কথা। আমাদের ইউনিভার্সিটিতে আইজেক কাজ করত। সে সময় প্রতি বৃহস্পতিবার ইরাসমাস স্টুডেন্ট নেটওয়ার্ক বা ইএসএনের তরফ থেকে কান্ট্রি প্রেজেন্টেশন নামে কালচারাল প্রোগ্রামের আয়োজন করা হতো। প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট একটি দেশ থেকে কিছু শিক্ষার্থী দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে তুলে ধরতেন। ইএসএনের পাশাপাশি অনেক সময় আইজেকও কান্ট্রি প্রেজেন্টেশন অনুষ্ঠানের সহ-আয়োজকের ভূমিকা পালন করত। এ ছাড়া আইজেক মাঝেমধ্যে তাদের নিজস্ব কিছু প্রোগ্রামের আয়োজনও করত। এভাবে আসলে আমি প্রথমে আইজেক সম্পর্কে জানতে পারি।

আইজেকে গ্লোবাল ভলান্টিয়ারিং প্রোগ্রাম, গ্লোবাল ট্যালেন্ট প্রোগ্রাম এবং আইজেক ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম আছে। ফুলটাইম শিক্ষার্থীদের জন্য মূলত গ্লোবাল ভলান্টিয়ারিং প্রোগ্রাম অফার করা হয়ে থাকে। এ ধরনের প্রোগ্রামের ব্যাপ্তি ৬ সপ্তাহ থেকে ১১ সপ্তাহ পর্যন্ত হয়ে থাকে। কেউ যদি গ্লোবাল ভলান্টিয়ারিং প্রোগ্রামে অংশ নিতে চায়, তাহলে স্থানীয় আইজেক কর্তৃপক্ষকে ১৩০ ইউরো দিতে হয়। যদিও এটা একটা পেইড প্রোগ্রাম, তারপরও আমি আইজেকে কেন জানি গ্লোবাল ভলান্টিয়ারিং প্রোগ্রামে অংশ নিতে আগ্রহী হলাম। আইজেকের অধীনে কোনো প্রজেক্টে অংশ নেওয়ার শর্ত হচ্ছে, অন্য কোনো দেশে সম্পূর্ণ আলাদা কোনো সাংস্কৃতিক পরিবেশে কাজ করতে হবে। আমি ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। ফার্স্ট সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা শেষে ছুটির সময়টিকে বেছে নিলাম গ্লোবাল ভলান্টিয়ারিং প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য।

লাতিন আমেরিকা—এ অঞ্চলের প্রতি আমার বিশেষ ধরনের দুর্বলতা কাজ করে। প্রথমত, লাতিনের অবস্থান এশিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিপরীতে; দ্বিতীয়ত, কেন জানি লাতিন আমেরিকার কথা মাথায় এলে চোখের সামনে ভেসে আসে একঝাঁক সুন্দরী তরুণীর কথা। ইউরোপের দেশে বেড়াতে গেলে দেখা যায়, অধিবাসীদের চেহারার গঠন সবার মোটামুটি একই ধরনের। এরা দেখতেও একে অপরের মতো। কিন্তু এসব (লাতিন) দেশের অধিবাসীদের ক্ষেত্রে অনেক সময় একই ধরনের চেহারার গঠন পরিলক্ষিত হলেও বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। কারণ, একই চেহারার গঠন থাকলেও দেখতে কেউ কারও মতো নয়।

প্রথমে চিলি কিংবা আর্জেন্টিনা বেছে নেওয়ার জন্য লক্ষ্য স্থির করলাম। কিন্তু ভিসা–জটিলতার সঙ্গে টিকিটের উচ্চ মূল্যের কারণে তা বাতিল হলো। এমন সময় হঠাৎ মাথায় আলবেনিয়ার চিন্তা এল। আইজেকের পক্ষ থেকে সেখানে কী প্রোগ্রামের ব্যবস্থা আছে, খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। প্রথমে স্কাইপে একটা ইন্টারভিউ দিতে হয়েছিল। যথারীতি ইন্টারভিউতে কোয়ালিফাইও করলাম। আলবেনিয়াতে আইজেক আয়োজিত ছয় সপ্তাহের গ্লোবাল ভলান্টিয়ারিং প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য মনোনীত হলাম।

২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারি। হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট থেকে আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানার উদ্দেশে উইজ এয়ারের ফ্লাইটে যাত্রা শুরু হলো। সেনজেনের কোনো রাষ্ট্রের ভিসা কিংবা টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট থাকলে ভিসা ছাড়া আলবেনিয়ায় যাওয়া যায়। স্লোভেনিয়াতে আমার টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট রয়েছে, তাই আলবেনিয়ার জন্য কোনো ভিসার প্রয়োজন হয়নি। শুধু ইমিগ্রেশন অফিসার পাসপোর্টে একটা অ্যারাইভাল সিল দিয়েছেন।

ইউরোপ সম্পর্কে কোনো ধারণা নিয়ে আলবেনিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মেসিডোনিয়া, সার্বিয়াসহ বলকানের দেশ ভ্রমণে এলে হতাশ হতে হবে। ইউরোপের সংজ্ঞা যদি হয় জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, তাহলে এসব দেশে পা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হবে এ এক কোন অদ্ভুত রাজ্যে পৌঁছালাম।

বলকান অঞ্চলের মানুষের আচরণও গতানুগতিক ইউরোপিয়ান বলতে আমরা যেমন বুঝি, তা থেকে একেবারে ভিন্ন। রাজনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে অনেক ক্ষেত্রে দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের মতোই। অপরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, দুর্বল অবকাঠামো, দুর্নীতিপরায়ণ প্রশাসন এসব দেশে মামুলি বিষয়। এ জন্য যেকোনো আন্তর্জাতিক সূচকে ইউরোপের মধ্যে এদের অবস্থান সবার নিচে। অর্থনৈতিকভাবেও দেশগুলো খুব একটা অগ্রসর নয়।

বিমান থেকে আলবেনিয়াকে দেখলে কোনো রুগ্‌ণ ও কঙ্কালসার মায়ের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠবে। বাস্তবিক অর্থে অবস্থাও তা–ই। অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। এ জন্য বিমানবন্দর থেকে শুরু করে সর্বত্র দেশটির দুর্বল অর্থনীতির পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। রিনাসে দেশটির একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পা রাখলে দেশের সাধারণ কোনো একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের অভিজ্ঞতা আপনার স্মৃতিপটে ভেসে উঠবে। খুবই ছোট একটি এয়ারপোর্ট এবং সে অর্থে জাঁকজমক চোখে ধরা দেবে না বললে চলে।

তবে আলবেনিয়ার মানুষ অনেক আন্তরিক এবং অতিথি আপ্যায়নেও ভালো। বাইরের দেশ থেকে আসা কোনো পর্যটক দেখলে তারা তাঁকে যথাসম্ভব সহযোগিতা করার চেষ্টা করে।

গ্লোবাল ভলান্টিয়ার প্রজেক্টের অংশ হিসেবে আমি রাজধানী তিরানার উপকণ্ঠে রুয়া জর্দান মিসইয়ার নামের স্কুলে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। স্কুলটি মূলত অস্ট্রিয়াভিত্তিক চ্যারিটেবল অর্গানাইজেশনের অর্থায়নে নির্মিত। আলবেনিয়ার জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের মানুষ নিম্নবিত্ত জীবন যাপন করে। দেশটিতে এমন অনেক বাবা কিংবা মা আছেন, তাঁদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য স্কুলে পাঠানোর সামর্থ্যটুকু নেই। স্কুলটি সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের জন্য।

স্কুল শেষে সন্ধ্যা মুলিরি ভিটের কফিশপে অন্য গ্লোবাল ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে লেখক। বাঁয়ে তুরস্কের ইজমির এলিফ ও ডানে নাদিয়া। ছবি: সংগৃহীত
স্কুল শেষে সন্ধ্যা মুলিরি ভিটের কফিশপে অন্য গ্লোবাল ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে লেখক। বাঁয়ে তুরস্কের ইজমির এলিফ ও ডানে নাদিয়া। ছবি: সংগৃহীত

আলবেনিয়াতে বেশি সংখ্যক মানুষ ইংরেজি না জানলেও মোটামুটি বেশির ভাগ মানুষ ইতালিয়ান ভাষায় পারদর্শী। স্যাটেলাইট টেলিভিশনে আলবেনিয়াতে অনর্গল ইংরেজি বলতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম, যদিও রাজধানী তিরানা কিংবা দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর দুরেসে আমাকে সে অর্থে ভাষাগত কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। তবে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের প্রসারের কারণে দেশটিতে ইতালিয়ান সিনেমা বা টেলিভিশন সিরিয়াল ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং এ কারণে দেশটির বেশির ভাগ মানুষ ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে—সেটা হোক ৭০ বছরের কোনো বয়োবৃদ্ধ কিংবা ৬ বছরের কোনো বাচ্চা।

দীর্ঘদিন তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যে থাকায় দেশটিতে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটে। এ কারণে দেশটির সিংহভাগ মানুষের ধর্ম ইসলাম। তবে দেশটিতে ক্যাথলিক কিংবা অর্থোডোক্স খ্রিষ্টধর্মালম্বী মানুষও আছে। আলবেনিয়ার অধিবাসীদের ভাষা আলবেনিয়ান। আলবেনিয়ান এমন একটি ভাষা, ইউরোপের অন্য কোনো ভাষার সঙ্গে এর মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। আলবেনিয়া ছাড়াও কসোভো এবং মেসিডোনিয়ার একটি বিরাট অংশের মানুষের ভাষা আলবেনিয়ান।

রুয়া মিসইয়ার স্কুলে বাচ্চাদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে কিছুটা আলবেনিয়ান শিখেছিলাম। বাচ্চাদের মধ্যে কেউই ইংরেজি জানত না সেভাবে। আমার কাজ ছিল স্কুলে কাজ করা শিক্ষকদের সহায়তা করা। পাশাপাশি অনেক সময় এসব বাচ্চার শিক্ষক হিসেবেও আমি কাজ করেছি। কখনো তাদের আমি ইংরেজি শিখাতাম। কখনো তাদের নিয়ে খেলতে যেতাম। কখনো তাদের সঙ্গে নিয়ে ড্রয়িংয়ে বসতাম, কখনো আবার বিজ্ঞানভিত্তিক মজাদার বিষয় নিয়েও তাদের সঙ্গে আলোচনা করতাম। ইংরেজিতে সবকিছু বলার চেষ্টা করতাম এবং তাদের এক শিক্ষিকা সেটা নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে দিতেন। বস্তিগুলোতে যেতাম বিভিন্ন পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।

রোমা নামে এক জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস রয়েছে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, যারা জিপসি নাম পরিচিত। তারা দেখতে অনেকটা উপমহাদেশের মানুষের মতো। তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। এ ভাষায় আমাদের এ উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষার প্রভাব পাওয়া যায়। অনেকে বলেন, তাদের আদিনিবাস ভারতে। বস্তিগুলোতে জিপসি ও ইজিপসিয়ান লোকজনের বসবাস ছিল বেশি। ইজিপসিয়ানদের অবশ্য নিজেদের ভাষা নেই, এদের জীবনধারা সাধারণ আলবেনিয়ানদের মতো। আবার ভুলেও মনে করে বসবেন না যে ইজিপসিয়ান মানেই মিসরের অধিবাসীদের বংশধর।

আমার প্রজেক্টের সহকর্মী হিসেবে ছিলেন ইতালি থেকে আসা নাদিয়া দালা জেসপারিনা, তুরস্কের ইজমির থেকে আসা এলিফ ও দিলাই, মালয়েশিয়া থেকে আসা খাই লি। মিসর থেকে আলী নামেও একজনের যোগ দেওয়ার কথা ছিল। ভিসা পেতে দেরি হওয়ায় আলী আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারেনি।

ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় আলবেনিয়াতে জীবনযাত্রার ব্যয় এখনো অনেক কম। আলবেনিয়ার সাধারণ মানুষ মাত্রাতিরিক্তভাবে কফিবিলাসী, এ কারণে কয়েক মিটার পথ পাড়ি না দিতেই কফিশপ চোখে পড়ে। আলবেনিয়া এমন একটি দেশ, যে দেশে কোনো ধরনের কফি উৎপাদিত হয় না, অথচ প্রতি বর্গমাইল হিসাবে এ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কফিশপ সম্ভবত আলবেনিয়াতে দেখা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জনপ্রিয় কফি চেইন শপ স্টারবাকের কোনো শাখা নেই। এক ইউরোর কম খরচে আলবেনিয়াতে কফির স্বাদ উপভোগ করা যায়। মুলিরি ভিটের দেশটির জনপ্রিয় কফি চেইন শপ। চলবে...


*শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া