কাসায়ামা পর্বতের আগ্নেয়গিরিতে একদিন

কাসায়ামা পর্বতের আগ্নেয়গিরি। ছবি: সংগৃহীত
কাসায়ামা পর্বতের আগ্নেয়গিরি। ছবি: সংগৃহীত

যেদিন প্ল্যান হলো আমরা একটা আগ্নেয়গিরি দেখতে যাব, সত্যি বিশ্বাস হচ্ছিল না। মুহূর্তেই মানসপটে ভেসে উঠছিল জ্বলন্ত লাভার উদ্‌গিরণসহ জ্বালামুখ আর কালচে কুণ্ডলী পাকা ধোঁয়ার ছবি। নির্ধারিত দিনে ইয়ামাগুচি শহর থেকে প্রায় ৩৯ কিলোমিটার দূরে হাগি শহরে আমরা পৌঁছাই প্রায় ৫০ মিনিট গাড়ি চালিয়ে।

অবশেষে নিজের স্নায়ু চাপ কাটিয়ে দর্শন মিলল জীবনে প্রথম দেখা আগ্নেয়গিরির। জাপানের ইয়ামাগুচি প্রিফ্যাকচারের হাগি শহরে জাপান সাগরের কিতা নাগাতো সমুদ্র উপকূলের মাঝামাঝিতে এটি অবস্থিত। কাসায়ামা পর্বতের এই আগ্নেয়গিরির উচ্চতা প্রায় ১১২ মিটার। জ্বালামুখের আয়তন ৩০ মিটার এবং এর গভীরতা প্রায় ৩০ মিটার। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখটির বয়স প্রায় ১০ হাজার বছর। প্রায় ৮ হাজার ৮০০ বছর আগের সর্বশেষ উদগিরনের সাক্ষ্য বহন করে এই আগ্নেয়গিরি। বর্তমানে অবশ্য এটি মৃত। এটি মূলত আগ্নেয়গিরিজাত শিলা দ্বারা গঠিত। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণে গলিত উত্তপ্ত লাভা ঠান্ডা হয়ে যেসব পাথর কঠিন, কালচে ও ধূসর রং ধারণ করে, সেটাই আগ্নেয়গিরিজাত শিলা।

ভূপৃষ্ঠ থেকে মালভূমিটিতে এবং সেখান থেকে জ্বালামুখের ভেতরে সিঁড়ি ধরে ঢুকতে সময় লাগে পাঁচ থেকে ছয় মিনিট। জ্বালামুখে ঢোকার সময় সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে খুব সহজেই হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখা যায় উঁচু উঁচু লালচে আভাযুক্ত লাভার শক্ত কঠিন পাথরের দেয়াল ও অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত আগ্নেয় শিলার টুকরো। জ্বালামুখের ঠিক মাঝে দাঁড়িয়ে বেশ ভালোমতোই উপলব্ধি করতে পারছিলাম পৃথিবীর বুকে একসময়ের এক শক্তিশালী আগ্নেয়গিরির দোর্দণ্ড কর্মকাণ্ড। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল এই ভেবে যে হাজার হাজার বছর আগের এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের ভেতর আমি অবস্থান করছি। যেখান থেকে সে সময় উত্তপ্ত গলিত লাভার উদ্‌গিরণ হতো আর তার ফলে কত পাহাড়, পর্বত, নদী, পুকুর সৃষ্টি হতো, বদলে যেত মানুষের জীবনধারা, গতিপথ। শিহরিত হলাম ক্ষণিকের জন্য।

এই জায়গা ভিন্ন ভিন্ন মৌসুমে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। যেমন এখানকার পেছনের দিকে একটি চুনাপাথরের গুহা রয়েছে, যেখান থেকে গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রচণ্ড গরমে প্রায় ১৪ ডিগ্রি°সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে শীতল হাওয়া প্রবাহিত হয়। এই জায়গায় প্রায় ১২০ বছরের পুরোনো কৌড়াই তাচিবানা নামের (কমলাজাতীয় ফল দেওয়ার বৃক্ষ) বৃক্ষগুলো জন্ম নেয়, যা পুরো জাপানে এই একটি মাত্র জায়গাতেই জন্মায়। জাপানে এগুলো মেমোরিয়াল বৃক্ষ নামে পরিচিত।

সূর্যাস্ত। ছবি: সংগৃহীত
সূর্যাস্ত। ছবি: সংগৃহীত

উঁচু মালভূমিটি থেকে কাসায়ামা আগ্নেয়গিরির কারণে সৃষ্ট কয়েকটি দ্বীপ চোখে পড়ে এবং সেই সঙ্গে নয়নাভিরাম জাপান সাগরের উপকূলরেখারও দেখা মিলবে। এখান থেকে সূর্যাস্ত–সূর্যোদয়, দুটোর রূপই মনোহরা। যদিও সূর্যোদয় দেখা হয়নি এখান থেকে; তবে শুনেছি আমাদের গাইডের মুখ থেকে। এখানে সূর্যোদয়ের সময় দেখলাম দ্বীপপুঞ্জগুলোর চূড়ায় ভোরের নরম আলতো আলোর প্রতিবিম্ব পড়েছে। আর সূর্যাস্তের সময় জাপান সাগরে নিমজ্জিত হতে থাকা লোহিত সূর্যের বিদায়বেলার স্বর্গীয় দৃশ্য যেকোনো প্রাকৃতিক দৃশ্যকেই হার মানাবে। তাই তো এখানকার সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয় দুটোই জাপানের প্রথম সারির ১০০টি সূর্যাস্ত অবলোকন করার মতো দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম।

ব্রিম মাছের প্রাকৃতিক অ্যাকুয়ারিয়াম
কাসায়ামা পর্বতের পাশেই প্রায় ১১ হাজার ৫৫০ বর্গমিটারের একটি প্রাকৃতিক পুকুর আছে। কাসায়ামা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে উদ্‌গিরণ হওয়া কঙ্কর স্তূপীকৃত হয়ে স্তম্ভ আকারে গঠিত হওয়ায় মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে কাসায়ামা পর্বতের যোগসাজশ সংগঠিত হওয়ার কারণে এই পুকুর হয়েছে। পুকুরের তলদেশে সেই সময় থেকেই একটা ফাটল রয়েছে, সে কারণে এখানে সহজেই সাগরের পানি আসা–যাওয়া করতে পারে। পুকুরটিতে রংবেরঙের অনেক মাছ দেখতে পাওয়া যায়। মেয়োজিন ইকে নামের এই পুকুরকে লাল রঙের ব্রিম মাছের প্রাকৃতিক অ্যাকুয়ারিয়াম বলা হয়ে থাকে। এটি দর্শনীয় জায়গা বিধায় এখানে কেউ মাছ শিকার করে না।

দেখতে এসেছিলাম একটি মৃত আগ্নেয়গিরি। সঙ্গে নিয়ে ফিরলাম দীর্ঘ প্রতীক্ষিত শক্ত লাভার কঠিন চমকপ্রদ রূপ, নিস্তেজ হয়ে পড়া এত বছরের পুরোনো জ্বালামুখের দৃঢ়, নির্বিকার, অটল প্রতিমা, লালিমা আভা মিশ্রিত, সম্মোহনী সূর্যের প্রস্থানকাল, পাইন, ক্যামেলিয়ার বিস্তীর্ণ মাঠ, উথাল-পাতাল ঢেউয়ের দিগন্তজোড়া সাগর উপকূল আর জমকালো, ঝকঝকে মৎস্য জলাধারের মহীয়সী কাহিনি। এই ভ্রমণ যেকোনো পর্যটকের মনে এক অভূতপূর্ব সাড়া জাগাবে নিশ্চিত, যা সে কখনো ভুলতে পারবে না, কেবলই শিহরিত করেই যাবে।