করোনাজীবনের পঞ্চম দিন

>করোনাভাইরাসে পাল্টে গেছে জীবনের বাস্তবতা। আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। করোনায় জীবন নিয়ে লিখছেন অনেকেই। এই চিকিৎসকও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর সিরিজ লিখছেন। আজ পড়ুন পঞ্চম পর্ব।

গত রাতে আবারো ঘুম হয়নি। মনে হচ্ছিল জোর করে চোখ বন্ধ করে আছি। মাঝেমধ্যেই উঠে হাঁটাহাঁটি করছি। সকালে আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হলো না। জানালা খুলতেই দেখি দুইটা বড় খরগোশ ফুলের বাগানে ঢুকছে, এদের দেখতে পাই না সহজে, কিন্তু গাছ খেয়ে যায়। নিচে নেমে ওষুধ খাওয়ার পর ব্যথা কমেছে, কনজেশন আজ বেশি। অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করব সঙ্গে স্টেরয়েড—আমার এজমার টেনশন কমবে।

আমার সঙ্গে কাজের আরও যে দুজনের করোনা পজিটিভ, তাঁরা ভালো ফিল করছেন।

আমি ওষুধ খেয়ে আদা চা নিয়ে বাগানে পাখিদের খেলা দেখছি। কর্তা মার বাসায় খাবার আনলেন, নাশতা করে নিলাম।

ছেলেমেয়ে এখনো ওঠেনি। বাসায় লাইসল স্প্রে করার পর দেখি বাচ্চারা উঠেছে। গলা শুনেই ছেলের মনে পড়েছে মাস্কের কথা! সে নাশতা সেরে আমাকে দূর থেকে দেখেই মাস্ক পড়ে তাড়াতাড়ি নিচে চলে গেছে।

মেয়ে কাশছে—জ্বর, ব্যথা নাই, তাকেও অ্যালার্জি আর ঠান্ডার ওষুধ খেতে বললাম। সবাই মাস্ক পরছি বাসায়। দূরত্ব মেইনটেইন করার চেষ্টা করছি। আব্বার বাসার খাবার বাইরে রেখে দিতে বলে ছিল, সেখান থেকেই নিয়ে এসেছে। কোনো ফিজিক্যাল কন্টাক্ট নেই।

আজ ওর কোনো সমস্যা নেই। হয়তো সেদিন রোদে বেশি ঘোরাঘুরি করে ফেলেছিল। সারাক্ষণ চিন্তা হয়। আমাদের সবার এত খারাপ অ্যালার্জি আর আমার আর ছেলের অ্যাজমা। ছেলের বাপ ভাবছে তার বয়সের কারণে সে হাই রিস্ক, আশ্বস্ত করলাম। তার কোনো রিস্ক নেই, তবে রিস্ক নেওয়া যাবে না। মাস্ক মাস্ট। আজ হয়তো গ্লাভস পাব, তাহলে আমার আর টেনশন থাকবে না।

বাবার বাসা থেকে টেনশন সারাক্ষণ ফোন দিয়ে জানতে চায় কী অবস্থা। আমার চাপা স্বভাবের জন্য বিশ্বাস করে না, খুব খারাপ নেই। অথবা আমি ভীষণ খারাপ রোগী ডিল করে অভ্যস্ত বলে, নিজেকে অতটা খারাপ ভাবছি না। সে যা–ই হোক, মেয়েটা ভালো ফিল করলে ভালো লাগবে। নিচে শুনি বাবা মেয়েকে বলছে, মামি ইজ পজিটিভ, সো আমাদের নিজেদের পজিটিভই ভাবতে হবে, সেভাবেই ম্যানেজ করতে হবে। বেচারারা।

বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ফেসবুকে অ্যাকটিভিটিস নেই বলে খোঁজ নিচ্ছে। ওষুধ খাবার ইন বিটুইন আমি ঘুমে, আর জেগে থাকলে আর কারও সাথে কথা বলার অ্যানার্জি নেই আপাতত। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা যারা আমাকে মনে করে আমার জন্য আর আমার ফ্যামিলির জন্য দোয়া করছেন, শুভকামনা জানাচ্ছেন। আপনারা সুস্থ থাকুন আর মাস্ক অবশ্যই পড়ুন। সেটাই একমাত্র আপনাকে সুরক্ষা দিতে পারে। অবশ্যই যে কোনো গেট টুগেদার এড়িয়ে চলুন আর সবার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখুন।

দিনটা কাটে বেশির ভাগই নিজের রুম থেকে বাগান দেখে। সেখানে কতশত পাখি, কাঠবিড়ালি, হরিণ, খরগোশ, প্রজাপতির নাচন দেখে, যে দু–একবার নিচে নামি, বেশির ভাগ সময়ই কেউ নিচে থাকে না। নামি মাস্ক পরে। কখনো ব্যথায় বয়স্কদের মতো রেলিং ধরে, কখনো এক পা এক পা করে। নিচে আমি পেছনের বারান্দায় চলে যাই। ওপরে বা নিচে—এ জায়গাগুলোই একমাত্র জায়গা, যেখানে মাস্ক ছাড়া শ্বাস নিতে পারি। ব্রেকফাস্ট, দুপুরের খাবার শান্তিতে করতে পারি, অবশ্যই একাকী। কখনো বেড়াল সাথি হয়, ও বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে, ওর আদর কমে গেছে, ছোঁয়াছুঁয়ি কম।

এখনো বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছি, খাবারের স্বাদ, গন্ধ পাচ্ছি। মেয়েটার কাশি ছাড়া সমস্যা নেই। এভাবে এ সপ্তাহ গেলে আমি খুশি। ধন্যবাদ ইনহেলার হাতের কাছে থাকায়। ইনহেলার জীবন বাঁচায়। আমাদের অনেকের ভুল ধারণা একবার ইনহেলার নিলে সারা জীবন নিতে হয়। প্রথমেই বলেছি এটা ভুল ধারণা। তবে যাদের নিতে হয়, তারা নিয়মানুযায়ী না নিলে, মারা যেতে পারেন, কারণ এটা জীবন বাঁচায়। একটি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ।

এসপিরিন নয়, ফ্যান্সি নামের ওষুধ নয়, সিম্পল সিম্পটমেটিক ট্রিটমেন্ট চলছে।

অনেকের ভয়, করোনায় রক্ত জমাট বাঁধে—কথা সত্য। তবে এর ব্যাখ্যা আমার কাছে এমন, আপনার যদি কোনো সমস্যাও না থাকে, ইভেন করোনাও নেই ; আপনি যদি সে অবস্থায় তিন দিনও শুয়েবসে কাটান। আপনার শরীরে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। কারণ, রক্তের সার্কুলেশন ঠিকমতো হয় না। একই কারণে আমরা যখন দীর্ঘক্ষণ প্লেনে বসে থাকি, অনেকের রক্ত জমাট বাঁধে। কিছু লোক জেনেটিক্যালি হাই রিস্ক। মোটা হলেও রিস্ক বেশি আর হরমোন পিল রিস্ক বাড়িয়ে তোলে। পরিবারের কারও ক্যানসার, রক্তের আরও কিছু সমস্যা, কিছু ওষুধও রক্ত জমাট বাঁধার রিস্ক বাড়িয়ে তোলে। আর করোনার কারণে যারা হসপিটালে থাকে, তারা কতটা নাড়াচাড়া করে, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ।

আমরা আরও একটু অ্যাডভান্স! অসুস্থ হলেই বিছানায় শুয়েবসে আরাম করতে চাই। রোগী হিসেবে এই সুবিধা নিতে আমরা সবাই মুখিয়ে থাকি। এটা আসলে বন্ধ করা উচিত। প্রতি ঘণ্টায় নিজেদের যতটুকু সম্ভব সচল রেখে পাঁচ থেকে দশ মিনিটের জন্য হলেও হাঁটাহাঁটি করা উচিত। নিজের কাজ যতটা সম্ভব যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজের করে নেওয়া উচিত। এতে আপনিই বুঝতে পারবেন; কতটা করতে পারছেন। তার মানে এই নয় যে আপনি পারছেন না, তাও করতে হবে। আর এই কাজগুলো করে আপনি নিজেকেই আসলে সাহায্য করছেন—দ্রুত সুস্থ হতে।

একই কারণে এখানে হিপ বা হাঁটু রিপ্লেস করিয়েই হাঁটানো হয়—কোন রোগের চিকিৎসা বেড রেস্ট নয়, আনলেস পেশেন্ট কিছুই করতে না পারে! তারপরও ফিজিওথেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট সময়মতো এসে এক্সারসাইজ করিয়ে দিয়ে যায়।

আমি সারপ্রাইজড, আজ আমি মেডিকেলীয় কিছু ভাবতে পারছি। চলবে...।

*লেখক: চিকিৎসক