ও জীবন রে

বেলাটা ঢলে পড়েছে পশ্চিমের কোণে। ওপরের আকাশটা এক অদ্ভুত গাঢ় নীল বুকে ধারণ করে আছে। একপলক দেখেই সুদীপ বুঝতে পারল দিনটা বেশ রৌদ্রোজ্জ্বল কেটেছে। যদিও আজকাল ফ্যাক্টরির ব্যস্ততায় এমন ঝকঝকে একটা দিন দুচোখ মেলে দেখার সুযোগ হয়ে ওঠে না তার। একটা হিমেল হাওয়া আছড়ে পড়ে চরাচরে। একটা ভিজে ভিজে ভাব। শরীরটাকে আলতো করে ছুঁয়ে যায়।

নদী পাড়ের লতায়–পাতায় ডুবে থাকা লোহার বয়লারের ওপর ঠেস দিয়ে উদাসী মনে বসে আছে সুদীপ। কয়েকটা বন্য কদ গাছের ছায়ায় জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। এদিকটায় মানুষের আনাগোনা তেমন একটা নেই। বেলা শেষে প্রায়ই এ জায়গায় আনমনে বসে থাকে সুদীপ। আজও তা–ই। পকেটে রাখা ফোনটা বেঝে ওঠে হঠৎ। ‘হ্যালো, সুদীপ সাহেব, ফ্যাক্টরি থেকে কি বের হয়ে গেছেন?’

‘জি না স্যার।’
‘একটু যদি আমার রুমে আসতেন।’
‘শিউর।’

হাতের জামাটা ভাঁজ করে কনুইয়ের ওপর তুলতে তুলতে সুদীপ টের পেল শীতল হাওয়ার জোর খানিকটা বেড়েছে। খোলা বাতাসে ওড়তে থাকে সুদীপের এলোমেলো চুল। জিএম ভবনের সিঁড়ি ভেঙে দোতলার ওপর উঠে আসে। ঠকঠক করে শব্দ করতেই ভেতর থেকে হাসনাত সাহেব বললেন, ‘আসুন।’

চকচকে টেবিলটা থেকে ওঠে দাঁড়ালেন হাসনাত সাহেব। হাতের ইশারায় তিনি সুদীপকে বসতে বললেন। কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন ঠিক বলে উঠতে পারছেন না তিনি।

সুদীপ বলল, ‘স্যার বোধ হয় কিছু বলতে চাচ্ছেন।’
‘না, ঠিক তেমন কিছু না।’

হাসনাত সাহেব সবুজ কাচে ঘেরা জানালাটার ভেতর দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকেন অচেনা এক করুণ দৃষ্টিতে।
নিঃশব্দতার জের টানে সুদীপ। ‘স্যার, জানি আপনি কি বলতে চাচ্ছেন।’
হকচকিয়ে হাসনাত সাহেব সুদীপের দিকে তাকান। ‘বলেন তো কী?’

মৃদু হেসে সুদীপ বলল, ‘স্যার, আমাকে ছাঁটাই করবেন, এই তো? কদিন ধরে এমন কিছুই টের পাচ্ছিলাম, স্যার।’ বলতে বলতে সুদীপ কেমন যেন এক অজানা আবেগে খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে গেল।

হাসনাত সাহেব ছোট করে একটা ঢোক গিলে বললেন, ‘সুদীপ সাহেব আপনি ঠিকই ধরেছেন। তবে আমরা ভাবছি রায়হান সাহেবের কথা। দেখুন, আমাদের সব ফরেন অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। তাই...।’

ঘর্ঘর শব্দ ওঠে কফি ম্যাকার থেকে। বাইরে তখন সাজের বেলা। জানালার কাচে আছড়ে পড়ে পাতলা অন্ধকার। ল্যাম্পপোস্টগুলো হুতুমপ্যাঁচার চোখের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠে। মৃদু হিমেল হাওয়া বয়ে চলে ফ্যাক্টরির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। এসির ঠান্ডা বাতাসটা হঠাৎ করেই যেন সুদীপের কাছে খানিকটা উষ্ণ হয়ে ওঠে।

সুদীপ ছোট্ট একটা খাঁকারি দিয়ে গলাটা একটু টেনে বলে, ‘স্যার, আমি নিজেই চলে যেতে চাচ্ছি।’ বলতে বলতে বুকপকেটে রাখা রিজাইন লেটারটা হাসনাত সাহেবের দিকে মেলে ধরে সুদীপ।

হাসনাত সাহেব অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সুদীপের দিকে।
সুদীপ আর দেরি না করে উঠে দাঁড়ায়। একেকটা সিঁড়ি ফেলে নামতে থাকে সে।
অনেক দিনের চেনা ফ্যাক্টরির লাইন, নদীর পাড়, পথের দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারুগাছগুলো যেন দূরে চলে যেতে থাকে। বহুদূরে।

ফ্যাক্টরির পাশ ঘেঁষে রাস্তাটার শেষ প্রান্তে ছোট্ট একটা চায়ের টং। সুদীপ সেই টংয়ের সামনে এসে দাঁড়াতেই যেন টের পেল সন্ধ্যাটা মিলে গেছে রাতের আঁধারে। টংয়ের মাথার ওপর মস্ত বড় জামগাছটার গায়ে গায়ে জমে আছে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দু–চারটা অচেনা পাখি এক অদ্ভুত আয়েশে ডেকে চলেছে কিচিরমিচির শব্দে। এসবই যেন আজ মিলিয়ে যেতে থাকে কোনো এক অচেনা পথে।

রাত ১০টায় বাসায় ফেরে সুদীপ। তুলি এক গ্লাস ঠান্ডা পানি হাতে দিতে দিতে জিজ্ঞাস করে, ‘এমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেন?’
‘এমনিতেই।’
খিদে পেয়েছে, খেতে দাও বলে সুদীপ ফ্রেশ হতে ওঠে।
খানিকবাদে বাথরুমের দরজায় নক করে তুলি বলে, ‘খেতে এসো।’
খাওয়ার টেবিলে বসে সুদীপ বলে, ‘বাবু কি ঘুমিয়ে গেছে?’
‘হুম, কবেই।’

রাত বাড়ছে। বেডরুমের সঙ্গে লাগানো বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর আকাশে তাকিয়ে আছে সুদীপ। তুলি এসে সুদীপের কাঁধে মাথা রাখে। রাতের নিস্তব্ধতা ভারী হতে থাকে।
তুলি বলে, ‘কী দেখো?’
‘তারা।’
‘তোমার কী হয়েছে?’
একটু নীরব থেকে সুদীপ বলে, ‘তুলি কাল থেকে আমার জব নেই।’
‘মানে?’
‘আমাকে ছাঁটাই করা হয়েছে।’
তুলি পেছন থেকে সুদীপকে জড়িয়ে ধরে। শক্ত করে। ‘তাহলে এখন কেমন করে চলবে?’
‘জানি না গো...’

রাতের তারারা হেঁটে চলে দূর থেকে বহুদূরে। লাগানো কাঁঠালগাছের দু–চারটা পাতা করিডরে ঢুকে রেলিংয়ের ফাঁকফোকর দিয়ে। ঝিরঝিরে শীতল বাতাসে শনশন শব্দ ওঠে কাঁঠালপাতার গায়ে গায়ে। তুলির ঘুম আসে না। এপাশ–ওপাশ করে।
সুদীপ নরম সুরে বলে, ‘একটা সত্যি কথা বললে তুমি কি খুব রাগ করবে?’
‘কখনো কি করেছি?’
‘আমি নিজেই রিজাইন দিয়েছি।’
অন্ধকারেই আড়মোড়ে উঠে বসে তুলি। ‘তুমি কি পাগল?’
‘তুলি তা নাহলে রায়হান ভাইকে চলে যেতে হইত।’
‘তাই বলে...’

সুদীপ তুলিকে শক্ত করে ধরে বলে, ‘আমরা তখন হলে থাকতাম। টিউশনির টাকা শেষ হয়ে যেত ১৫ তারিখেই। ডাইনিংরুমে যাওয়ার সময় হলে রিডিংরুমে পড়ার ভান ধরে পড়ে থাকতাম। রায়হান ভাই কেমন করে যেন বুঝে যেতেন। কাঁধে হাত দিয়ে ভাই তখন বলতেন চল...। মাসের দুয়েক দিন থাকতে ভাইয়ের টাকাও শেষ হয়ে আসত। ভাই তখন ডাইনিং বয়কে দিয়ে খাবার নিয়ে আসতেন রুমে। তিনি আগে খেয়ে অর্ধেকের বেশিটা...।’ বলতে বলতে গলাটা ধরে আসে সুদীপের।

গভীর রাতের নরম হাওয়া ছুটে চলে। তুলি সুদীপের বুকে হাত রেখে বলে, ‘জামাই আই অ্যাম প্রাউড অব ইউ।’
সুদীপের বুক থেকে যেন হিমালয়ের চাপটা সরে গেল।
‘জানো তুলি, তোমাকে নিয়েই খুব ভয়ে ছিলাম...’

বেশ কদিন ধরে দুয়েকটা টিউশনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় সুদীপ। জীবনের কিছু কিছু ক্ষণ যেন অনেক বেশি বড় হয়ে ওঠে। বড় হয়ে ওঠে আত্মসম্মান থেকেও জীবিকার দায়। খড়কুটোর মতো যেকোনো পথ ধরেই যেন বাঁচতে চায় সুদীপ।

ট্রাউজারের সঙ্গে আধা পুরোনো টি-শার্টটা পরতে পরতে সুদীপ সুর ধরে, ‘ও জীবন রে ছাড়িয়া যাইস না মোরে...।’ ঘর থেকে পা ফেলতে গিয়ে সুদীপ বলে, ‘দোয়া রাইখো বউ। এ লাইনে আজই প্রথম।’

এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে তুলি হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সুদীপের দিকে। লোনা জলের ঢেউ ওঠে নয়ন সাগরে।

দিন কেটে যায়। কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি। জীবননদীতে সাঁতরে বেড়ায় সুদীপ। তুলিও হাল ধরে। তার দিন কাটে সেলাই মেশিনের খটখট শব্দে।

অনেক দিন তুলির রেওয়াজ হয় না। আজ সকালে সুদীপ যখন বের হয় তুলি বলে, ‘শুনছ, আজ একটু আগে আগে ফিরবে। আর শোনো, এই কটা লিফলেট আশপাশের কোনো দেয়ালে সেঁটে আসবে।’

সুদীপ লিফলেটগুলো হাতে নিয়ে মৃদু হেসে বলে, ‘বউ এ যুদ্ধে আমার ওপর কি ঠিক ভরসা করতে পারছে না?’
‘ঠিক তা না। তোমার কাঁধে একটু হাত রাখতে চাই শুধু।’
সুদীপ পা বাড়ায়। তুলি পেছন থেকে বলে, ‘এই তোমার ই–মেইলের পাসওয়ার্ডটা যেন কী? ...’

হাওয়া বইছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে। বেশ শীতল। আধা ঘণ্টা আগে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। কালো মেঘের খণ্ড ভেসে বেড়ায় আকাশের বুকে। সুদীপ অটো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হসপিটাল মোড়ে।
‘এ খালি যাবে?’
‘উঠেন।’
‘ডানে এইড ফার্মাতে।’
‘ওকে স্যার।’

ডিনার শেষে শুয়ে পড়ে সুদীপ। তুলি তখনো হাতের কাজ চালিয়ে যায় খটখট শব্দ করে।
সুদীপ বলে, ‘খলিফারানি একটু দয়া করবে...?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ এই তো...।’
সুদীপের ফোনটা হঠাৎ বেঝে ওঠে।
‘হ্যালো, কেমন আছেন ভাই?’
ওপাশ থেকে ডুকরে কান্নার শব্দ ভেসে আসে।
‘সুদীপ চুলগুলো ফেলে দিলে...।’
সুদীপ কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে গেল। জবুথবু দেখাচ্ছে সুদীপকে।
তুলি বলে, ‘কে?’
‘রায়হান ভাই আজ হয়তো কোথাও দেখেছেন...’

মাস দুয়েক হলো তুলিরা উঠেছে নবাবি বস্তিতে। একবারে শেষ প্রান্তের ঘরটি ওদের। জানালার সঙ্গে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। তার সঙ্গে লাগানো প্রাচীর। প্রাচীরের গা–ঘেঁষে জোড়া নারকেলগাছ। নারকেলের সুচারু পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে আসে ধবল জ্যোৎস্না। দুচোখ মেলে জ্যোৎস্না দেখে দুজনে। ঝিরঝিরে শীতল হাওয়া বইছে। রাত বাড়ে। বাড়ে জীবনের কত সুখ-দুঃখ।

তুলি বলে, ‘বলো তো জীবন থেকে তুমি আসলে কী চাও?’
‘তেমন কিছু না বউ। এই তো ওমর খৈইয়ামের সঙ্গে যদি মিলিয়ে বলি।’
‘এইখানে এই তরুর তলে
তোমার আমার কৌতূহলে
যে কটি দিন কাটিয়ে যাব প্রিয়ে
সঙ্গে রবে সুরার পাত্র
অল্প কিছু আহার মাত্র
আরেকখানি ছন্দ মধুর
কাব্য হাতে নিয়ে।’

তুলি বলে, ‘কাব্য ছাড়, সুদীপ। কত বলেছি গভমেন্ট জবের জন্য ট্রাই করতে। না। তুমি তোমার টেকনিকেল ফিল্ডে কাজ করবে। দেখলে তো কাব্য আর জীবন যে এক না?’
সুদীপ নির্লিপ্ত হাসে।
তুলি বলে, ‘হেয়ালি ছাড়ো। ওই যে প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেছেন মনে আছে?’
‘কার চুল এলোমেলো
কিবা তাতে এলো গেলো।
কার চোখে কত জল
কেবা তা মাপে?’

চিকচিকে নরম রোদ। অপূর্ব এক নতুন ভোরের সারথি। সুদীপকে নাশতা দিয়ে ল্যাপটপটা অন করে তুলি।
তুলি হঠাৎ এসেই সুদীপকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।
‘একটা সারপ্রাইজ আছে। দারুণ।’
‘কী?’
‘গেস করো তো?’
‘পারছি না, বউ। বলে ফেলো। আমি বের হব।’
তুলির চোখে-মুখে তৃপ্তির হাসি। ‘নো। লেটস সেলিব্রেট।’
কৌতূহলী হয়ে ওঠে সুদীপও।
তুলি এক গাল হেসে বলে, ‘তোমার পিএইচডি স্কলারশিপটা হয়ে গেছে।’

এক অদ্ভুত অজানা উত্তেজনায় দুজন দুজনকে আঁকড়ে ধরে।...

লেখক: পিএইচডি গবেষক, অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আলাবামা, আমেরিকা ও সহকারী অধ্যাপক, শাবিপ্রবি