কানামাছি!

মা ফোন করেই কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন।

বাবা, তাহলে কি তোর আর আসা হচ্ছে না? তোকে ছাড়া কোরবানি করেছি আমরা কখনো?

কী আর করবে মা? এখন থেকে অভ্যাস করতে হবে! তা ছাড়া আব্বা আছেন, রিমি আছে। আমার জন্য চিন্তা কোরো না। নতুন চাকরি, কীভাবে ছুটি চাই বলো? আমাদের প্রতিষ্ঠানে আবার ঈদ উৎসবগুলোয় বিবাহিতদের অগ্রাধিকার বেশি দেয় ছুটির ক্ষেত্রে।

কেন, এটা আবার কেমন নিয়ম! অবিবাহিতদের শখ নাই মা–বাবার সঙ্গে ঈদ করার?

আচ্ছা মা, এখন রাখি, পরে কথা হবে।

মাকে চান্সে বিয়ের প্রয়োজনীয়তাটা বুঝিয়ে দিলাম! কিন্তু কাজ তো তেমন হলো বলে মনে হয় না। ভাবলাম হয়তো মা বলবেন, আচ্ছা, তাহলে এই নিয়ম তোর কোম্পানিতে! আমিও আমার ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দেব শিগগিরই। দেখি আগামী ঈদে তোর ছুটি কীভাবে ওরা আটকায়?

না, মায়ের জেদ দেখলাম না এ ব্যাপারে। অথচ আমার মা অনেক জেদি আর এর ভুক্তভোগী আমার বাপজানই শুধু। ছোটবেলা তো বটেই, এখনো দুজনই আমাকে পক্ষে টানতে থাকেন। আমি পড়ি বেকায়দায়—একবার মা, আরেকবার বাবা।

*
একবার বাবা মাছ কিনে চায়ের দোকানে কথা বলতে বলতে ভুলে গেলেন মাছের কথা! যখন মনে পড়ল, ততক্ষণে মাছ আধপচা। মাছ রান্নার পর যখন খেতে বসলাম, তখন ঘটল ঘটনা। মুখ বাঁকা করে আব্বা বলে উঠলেন,

কী রান্না করলে এটা! মাছ না ভর্তা? এত নরম করে কেউ মাছ রান্না করে!

পচা মাছ রান্না করলে সেটা শক্ত হবে আবার? আনবে তো পচাগলা সব, স্বাদ না হলে আমার দোষ!

আমি পচাগলা আনি? এই রবি, তুই বল তো, চুলায় বেশি আগুন বেশি দেওয়ায় মাছ নরম হয়েছে না!

বাবার অভিযোগ শেষ না হতেই মা শুরু করলেন—

এই রবি, মাছের থেকে পচা গন্ধ পাস না?

মা, মাছ পচা বলে তো মনে হয় না!

আমার কথা শুনে মা তো স্তব্ধ! বাজার থেকে আসার সময় বাবা যে চিপসের প্যাকেটটা এনে দিয়েছিলেন, এটা যে তারই ফসল, মা ঠিকই জানেন।

ঠিক আছে, কাল থেকে বাপ–বেটা মিলেই রান্না করিয়েন। আপনাদের আগুনও বাঁচবে, আর এত নরম তরকারিও খাওয়া লাগবে না।

আরে মা! কী বলো, বাবা বললেই হবে? আমার কাছে মাছ পচা মনে হয়নি আর রান্না? কী বলব, এটা তো তোমার এযাবৎকালের সেরা রান্না!

আরেকবার হয়েছে কি, সকালবেলা আমাদের জন্য চিতই পিঠা বানাচ্ছেন মা। আমি আর বাবা বসে খাচ্ছিলাম পাশে। মা একটার বেশি খান না পিঠা। শুধু মায়ের পিঠাটা বানানো বাকি আছে, এমন সময় আম্মার ফোনটা বেজে উঠল। আম্মার ফোনের ডিসপ্লে নষ্ট, কলার আইডি শো করে না। করলেও মা আমার শুধু রিসিভ করাটাই জানেন। আম্মাজান ফোন রিসিভ করতে সামনের রুমে যেতেই বাবা আমাকে বললেন লবণের বয়ামটা দিতে। বয়ামটা দিতেই আধমুঠ লবণ দিয়ে দিলেন পিঠার খামিরগুলোয়।

আম্মার ফোনে কলটা আব্বা দিয়েছিলেন আর তিনি ফোনের কাছে যেতেই লাইনটা কেটে দিয়ে লবণের কাজটা ঘটিয়ে ফেললেন। আব্বার সঙ্গে আমার চুক্তি করা আছে না বলার কথা!

মা এসে পিঠাটি বানালেন, তরকারিতে চুবিয়ে যখন মুখে দিলেন, মুখটা তার বাঁকা হয়ে গেল!

একি, আজ এত লবণ কেন পিঠাতে! তোমরাও তো কিছু বলোনি!

বাবা মুখ খুললেন, আমি বলতে যায় পিঠাতে লবণ বেশি হয়েছে, আর ঘরে সকাল সকাল যুদ্ধ শুরু হোক! যুদ্ধ করার চেয়ে লবণ খেয়ে থাকা অনেক ভালো! ভাল্লাগছে তোমার পিঠাগুলো। অনেক ভাল্লাগছে!

মা কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। বাবা উঠে গিয়ে বাজার থেকে আনা টোস্ট বিস্কুটের প্যাকেটটা এনে দিলেন। আর বললেন, আজ বিস্কুট আর চা–ই খাও। এই লবণ পিঠা তোমার খাওয়া লাগবে না, আমাদের রোজ খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে গেছে। আমাদের জন্যও চা বানাও, এবারও দেখিও আবার চিনির বদলে লবণ দিতে যেয়ো না। মা চুপচাপ বাবার কথায় কান দিতে লাগলেন।

চল রবি, আমরাও ঘরে যাই বলে বাবা আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। ও ঘরে গিয়ে বাবা হাসতে হাসতে শেষ। আমাকে বললেন, খবরদার তোর মাকে বলিস না। বাবাকে অভয় দিলাম যে বলব না।

*
মাকে এ ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলাম, তবে আমাদের কথা মনে হয় শুনতে পাননি, পেলে মায়ের যা জেদ, বাবার খবর ছিল। সেদিন মা খুব চুপচাপ পার করলেন। পরদিন যে এ দুর্গতি অপেক্ষা করছে কে জানত!

ভোরে একই পিঠা বানাতে লাগলেন মা। আর আমি আর বাবা যথারীতি খেতে বসলাম। পিঠা মুখে দিয়ে বাবা আমার দিকে আর আমি বাবার দিকে তাকিয়ে আছি, না পারছি গিলতে, না পারছি ফেলতে! কীভাবে গিলব, এ যে লবণে ভরপুর।

মা বাবাকে বলতে লাগলেন, আজ লবণ ঠিক আছে না? ঠিক কালকের সমপরিমাণ দিয়েছি, তোমাদের তো আবার এসব খেতে খেতে অভ্যাস, একটু বেশি হলেও সমস্যা হবে না, খেতে পারবে!

আমার দিকে তাকিয়ে মা বললেন, কী হে বাপের শাগরেদ, কেমন হয়েছে পিঠা? একটাও ফেলতে পারবি না। সব খেতে হবে, তুই না পারলে তোরগুলোও তোর বাপে খাবে!

তোমরা ভেবেছ আমি কিচ্ছু জানি না? কাল আমাকে চা বানাতে বলে বাপ–বেটা মিলে কী হাসাহাসি ও ঘরে গিয়ে! ভাবছ আমি কিছু শুনিনি? সব শুনেছি। কাল কিছু বলিনি, আজ জবাব দেব বলে। একটা পিঠাও যেন নষ্ট না হয়, সব খেতে হবে, এই ধমক দিয়ে মা বেরিয়ে গেলেন।

এভাবেই বাবা–মাকে আমি সামলে আসছি ছোটবেলা থেকেই। আমার ছোট আরও একটা বোন থাকলেও আমার সঙ্গেই মা–বাবার সখ্য বেশি। চাকরি হওয়ার পর এবারই প্রথম কোরবানি। অনেক খুশি লাগছে আমার ঢাকাতেই এবারের কোরবানি দেওয়া হবে। নিজে থাকতে পারব না জানানোর পর থেকেই মায়ের মন খারাপ।

বাবা–মাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন, আরে, তোমার ছেলে ফাঁকা ঢাকাতে অনেক মজা করবে, চিন্তা কোরো না তো।

আমি বাড়ি থাকলে সবার আগে গরু বা ছাগল যা কিনি না কেন, আগেই কিনে ফেলতাম। সপ্তাহজুড়ে এটাকে নিয়েই কাটত সময়। অন্য রকম মজা মৌসুমি রাখাল হওয়া। এবার আমি নেই, তাই বাবা–মা সিদ্ধান্ত দিলেন কোরবানির আগের রাতেই কিনবেন।

পরদিন সকালে কোরবানি। রাত নয়টায় বাবা বিমর্ষ মন নিয়ে ঘরে ফিরে এলেন। মা জানতে চাইলেন কী সমস্যা।

আর বোলো না, আমাদের কোরবানির ছাগলটা রাশেদের দোকানের পাশে বেঁধে রেখে আমি গিয়েছিলাম মসলা কিনতে। রাশেদকে বলেছিলাম নজর রাখতে, ওর দোকানেও ঝামেলা, মসলা নিয়ে এসে দেখি ছাগলটা নেই!

নেই মানে?

নেই মানে চুরি হয়ে গেছে। কী যুগ এল, কোরবানির পশুও রেহাই পাচ্ছে না চোরের হাত থেকে।

যুগের দোষ দিচ্ছ কেন? নিজের আক্কেলসেলামির কথা স্বীকার করতে লজ্জা করে?

আচ্ছা, রাত পোহালে ঈদ, এখন ঝগড়া কোরো না তো। দেখি সকালে হাসমত ভাইয়ের কাছ থেকে একটা ছাগল নিয়ে নেব, ভোরে ডেকে দিয়ো আমাকে, এখন তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি, চলো।

কাল তো ভোরে ওঠা লাগবে। আর দেখো, চোরের যদি দয়ামায়া হয়ে যায়, তাহলে হয়তো ফেরতও তো দিতে পারে ছাগলটা।

আহারে, ফেরত দেওয়ার জন্য চুরি করেছে চোরে জীবনবাজি রেখে। সব তো তোমার মতো আহাম্মক।

আব্বা কথা না বাড়িয়ে শুয়ে গেলেন। ফজরের নামাজ পড়তে উঠে আম্মার চিৎকার। কই ওঠো, দেখো কী ঘটনা ঘটে গেছে।

আব্বা ঘুমঘুম কণ্ঠ নিয়ে বলতে লাগলেন—

কী হয়েছে?

আরে রান্নাঘরের পাশে একটা ছাগল বাঁধা, দেখে যাও তো।

আরে, এটাই আমার কেনা ছাগল। তোমাকে বলেছিলাম না, চোরেরও দয়ামায়া থাকে! তুমি তো শুনতেই চাওনি।

শোনো রাতে কী হয়েছিল, তুমি তো ঘুমে বেহুঁশ, নাকি খাসির মাংস না খেতে পাবার আশঙ্কায় অজ্ঞান হয়েছিলে রাতে। মাঝরাতে দরজায় ঠকঠক শব্দ! উঠে গিয়ে দেখি ছাগল হাতে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে বলে, আপনার ছাগলটা চুরি করেছিলাম। কিন্তু মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না, তাই ফেরত দিতে এলাম।

এমন ভালো চোরকে এত রাতে খালি মুখে কীভাবে বিদায় দিই বলো! তাই রবির রুমে ঘুমাতে দিয়েছি, ছাগল তো দেখলে, যাও এবার চোরটাও দেখে আসো।

আমি এতক্ষণ সব শুনছিলাম, মা আমার রুমে চোর দেখতে আসার সঙ্গেই আমি মাকে জড়িয়ে ধরে হাসতে শুরু করলাম, মা তো আমাকে দেখে অবাক, একদম কেঁদে দিলেন।

আর বলতে লাগলেন, এই ঈদের দিনেও বাপ–বেটা আমার সঙ্গে কানামাছি খেললি তোরা?

মা, শুধু বাপ–বেটা না, এবারের খেলায় তোমার আদরের বেটিও ছিল। ও–ই তো রাতে আমাকে দরজা খুলে দিয়েছিল।

আমার ছুটি আগেই হয়েছিল, তখনই আব্বাকে ফোন করে জানিয়েছিলাম। তোমার সঙ্গে একটু কানামাছি খেলার জন্য জানাইনি আমরা। কাল রাতে যখন বাজারে এসে পৌঁছাই, আব্বা ছাগলটি রাশেদের কাছে রেখে আসে। পুরোনো অনেক বন্ধুবান্ধব একত্র হয়েছিল বাজারে, সবার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ১২টার পর ঘরে আসি। প্ল্যান অনুযায়ী রিমা দরজা খুলে দেয়। ছাগলটা রান্নাঘরের পাশেই বেঁধে রাখি, যেন সকালেই উঠেই তোমার নজরে পড়ে।

তাই তো বলি তোর ছুটি না পাওয়ার খবরে তোর বাপের বিন্দুমাত্র আফসোস নেই কেন! রিমার দিকে কটমট করে তাকায় মা, শেষ পর্যন্ত তুইও এদের দলে? আমার দলে কেউ রইল না আর! আমি তোর বিয়ে দিয়েই আমার বউমাকে দলে ভিড়িয়ে নেব, তখন তোদের সঙ্গেই কানামাছি খেলব আমি, দেখে নিস!

মায়ের কথায় খুশিতে টগবগ হয়ে বললাম, তা দেখা যাবে মা, এখন ক্ষুধা লেগেছে, অনেক দিন চিতই পিঠা খায় না, পিঠা বানাও।

আচ্ছা, যা তুই হাত–মুখ ধুয়ে আয়। আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি।

আব্বা পেছন থেকে ডাক দিয়ে বলে উঠলেন, লবণটা একটু খেয়াল করে দিয়ো।

মা, কী জানি বলতে এগিয়ে আসছিলেন বাবার দিকে, আমি এগিয়ে গিয়ে মাকে রান্নাঘরের দিকে নিয়ে গেলাম, এবার একটু মায়ের পক্ষে থাকা জরুরি, মা বলেছেন, তাঁর একজন সাপোর্টার নিয়ে আসবেন...।

*লেখক: জুলেখা হাসপাতালে কর্মরত, দুবাই