রতন যাবি আমার সাথে

ওই দূর পাহাড়ের গা ঘেঁষে কোনো এক পাহাড়ি এলাকা থেকে আমাদের গ্রামের স্কুলে আসত রতন। আসত মানে প্রচণ্ড খরা–ঝড়–বাদলেও কামাই নেই। সঙ্গে ছোট ব্যাগে একগাদা বইখাতা। কলাপাতায় মুড়িয়ে দুটি শুকনা রুটি, একমুঠো আখের গুড়। বন্ধুদের জন্য কাঁঠালের মুচি, তেঁতুল আর বরই কাগজে পেঁচিয়ে আনত টিফিনের সময় ভাগাভাগি করে খাওয়ার জন্য। আইসক্রিম আর চালতার আচার রতন খুব পছন্দ করত, কিন্তু ঠাম্মির কাছে পয়সা চাইতে গিয়ে পিছপা হতো।

সকাল আটটা থেকেই ক্লাস শুরু হয়ে যেত। মাস্টারমশাইরা খুব সিনসিয়ার। বিশেষ করে বিজ্ঞান ও গণিত স্যার দুজনই ভীষণ কড়া। এতগুলো ক্লাস একসঙ্গে করলাম, তবু রতনকে দেখলাম না এক দিনের জন্যও অনিমেষ স্যারের পড়া পারতে। হোমওয়ার্ক তো কখনোই করে না। গণিত ক্লাসে অমনোযোগী হওয়ায় আশুতোষ স্যার প্রায়ই রতনকে বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখেন। রতনের ভাবখানা এমন, তাতে কী আসে যায়! ‘আই এম অলওয়েজ হ্যাপি’! মিহি সুখ খেলা করত ওর চোখ, গাল আর কপালজুড়ে।

পুরো বিকেলটাই আমরা একসঙ্গে কাটাই। ও নানা রকম পাখির ডাক শোনায়। বনজুঁই আর বুনোপাখির গল্প বলে। নানা রকম পাখির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। বাঁশিও বাজায়! সঙ্গে সংগত করে মধুমালতী, কনকচাঁপা আর শেফালীর দল। আমিও একটু আধটু সুর মিলাই।

টিফিন টাইমে আমি খেলি না, ও না। দাঙ্গাবাজ ছেলেদের সঙ্গে গলা উঁচিয়ে গল্প করি, টিফিন ভাগ করে খাই। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, পড়া না পারার কারনে অতীশ স্যার যে তোকে বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখে, কীভাবে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকিস? সে শুধুই হাসে! নরম গলায় বলে, আমি জানালা দিয়ে কৃষ্ণচূড়া দেখি, ব্ল্যাক বোর্ডে নরেন্দ্র স্যারের আঁকিবুঁকি দেখি। ছবির ভেতর ছবি দেখি। উড়াল পাখিদের উৎসব দেখি।

গতকাল রতনের পক্ষ হয়ে সুশান্তের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়াটা ও একদম মেনে নিতে পারেনি। আমাকে বলেই ফেলল ‘মিঠি, ক্যান তুই আমার জন্য ওই সব দাপুটে ছেলেদের শত্রু হোস?’ আমি কী করে বলি বুকের বাঁ পাশে তোর জন্য ক্যামন চিনচিন ব্যথা করে—যদি দেখতি! একটা মাটিমাখা দখিনা বাতাস ছুঁয়ে দেয় দুটি কোমল হৃদয়ে। অন্য ছেলেরা রতনকে বুদ্ধু আর গবেট বললে আমার যে খুব কষ্ট হয়।

স্কুলের শেষ দুই বছরে ধীরে ধীরে রতনের অভিশপ্ত দণ্ডায়মান পর্ব কমতে লাগল। আমরা এখন ইয়ং অ্যাডাল্টস। স্কুলে নতুন জয়েন করেছেন আর্ট টিচার কামাল স্যার। শুধু আর্ট নয়, ডিবেট, আবৃত্তি, নাচ–গান, দেয়াল পত্রিকা আর ললিতকলার নানা সুষমায় স্কুল প্রাঙ্গণ মুখর। রতন খুব তাড়াতাড়ি কামাল স্যারের কাছাকাছি চলে এল। সুক্ষ্ম রুচিবোধ আর আপন দক্ষতায় প্রকৃতির ক্যানভাসে রতন তুলে আনত নানা চিত্রকলা। পরীক্ষায় জিরো ডিজিটের পরিবর্তে আশি–পঁচাশি নম্বর পেত। জিজ্ঞাসা করতেই উত্তর আসত, বুঝলি, সব নিউ প্যাটার্ন, কৌশলটা রপ্ত করতে হয় শুধু, তোর থেকেই তো শিখেছি। হঠাৎ মেটামরফোসিস হল ওর। প্রকৃতির কোল ঘেঁষে এক নির্মোহ প্রজাপতির তাক লাগানো উত্তরণ। অবাক হতে হয় বৈকি!

পরবর্তী চমক হলো ট্যালেন্ট শো। গ্রামের লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়ল, চারপাশে শোরগোল। কামাল স্যার রতনকে মাইকের সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘এখন আপনাদের কাউয়ার ডাক শোনাবে রতন।’ সবাই তো হেসেই শেষ, কাউয়ার ডাক! কা কা কা—সবাই পারে। এতে অবাক হওয়ার কী আছে।

ওমা, সে কী! রতন পুরো বনবাদাড়ের বিভিন্ন পাখির ডাক, দাপুটে বাতাসে পাতার শিরশির আওয়াজ, হাঁসের থই থই, বিড়ালের মিউমিউ, পুরো অডিটরিয়ামজুড়ে মাতিয়ে রাখল। হ্যাপি মুডে কাক কীভাবে ডাকে, আনহ্যাপি হলে সুর কীভাবে বদলে যায়। বিভিন্ন ব্যকগ্রাউন্ডে বুনো পশুপাখির গলার স্বর নকল করে দেখাল। হলভর্তি মানুষের ফুল কনসেনট্রেশনই রতনের দিকে। মেঠোপথে খালি পায়ে হেঁটে আসা সহজ–সরল রতনের চ্যালেঞ্জিং ইউটার্ন, ‘আই হেভ টু উইন...!’

অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ি। টিউশনি করে পড়ার খরচ চালাতে হয় বলে গ্রামে খুব কম যাওয়া হয়। রতন গ্রামে জমিতে হালচাষ, গৃহপালিত পশুপাখির দেখাশোনা, বাবাকে সাংসারিক কাজে সাহায্য ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকে। পড়াশোনা আর চালিয়ে যেতে পারেনি। পুজোর ছুটিতে গ্রামে গিয়ে হঠাৎই দেখা হলো রতনের সঙ্গে। চওড়া ফিগার, কোঁকড়া চুল, কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে ভ্যানে সবজি নিয়ে হাটে যাচ্ছে। পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে একদল দুষ্টু আর দামাল ছেলেমেয়ে। ওদের ঠোঁটে নানা পাখির ডাক। রপ্ত করেছে রতন থেকেই।

আমায় দেখে চমকে ওঠে রতন। মিঠিইইইই বলে ডাক দিয়ে চেপে জড়িয়ে ধরে আমাকে। বুক চেপে কান্না চোখ ছলছল, আমারও। সে অনেক কথা, দিন শুরু আর শেষের কথা, আগামী দিনের কথা। কথায় কথায় বেলা গড়িয়ে এলে আমি তাকে নদীপাড় পর্যন্ত এগিয়ে দিই। যেতে যে হবে অনেক দূর।

পাহাড়ের ওই ধারে উচুঁ উঁচু টিলা, পাশেই স্বরবর্ণ নদী। একদল বেদে নদীর তীর ঘেঁষেই সাপের ঝুড়ি নিয়ে আড্ডায় মশগুল। তাদের গলায় বিচ্ছেদের গান কখনো ভর করে বেহুলাপ্রণয়। মনসা খেল দেখাতে দেখাতে ভুলে যায় জীবনের গুটিচাল। খুব সামনে হাঁটতে গিয়ে কেউ কেউ ভুলে যায়, পেছন দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে জী-ব-ন।

ঘন বনের ভেতর হাঁটতে থাকে রতন। সবুজ গাছগাছালিতে চেনা পথ আড়াল হতে থাকে। রাস্তাটুকু মিশে গেছে। ওই দূরে...আমি দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছি। ওও হাঁটছে আর ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। টিলার ওপর থেকে শেষবারের মতো হাত নেড়ে ও নেমে গেল, ওপারে। ওপারটা আর দেখা যায় না। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে।

আমি ফিরে যেতে থাকি সেই বটতলায় আলেয়া নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্কুলঘরটিতে। জীর্ণশীর্ণ চম্পানদী, ঋষিপাড়া আর নেহার মাস্টারের পূজামণ্ডপ পার হতেই বুকে বাজে মিঠিইইইই...যেন মাঝরাতে বুকের মাঝে হুইসেল—কুঝিকঝিক কুঝিকঝিক, রতন যাবি আমার সঙ্গে! এই মেঘ এই বরষায়, বৈষ্ণবী দিনে—বয়াতি আসরে।