টেনেরিফের বতুতা বাহিনী-১

টেনেরিফে, স্পেন। ছবি কৃতজ্ঞতায়: আদিবা আমাথ
টেনেরিফে, স্পেন। ছবি কৃতজ্ঞতায়: আদিবা আমাথ

১.

সাল ২০১৮। মিউনিখ বিমানবন্দর। থলথলে সুখী সুখী চেহারার এক নারী পুলিশ দ্রুত ধেয়ে আসছেন। তার চেয়েও দ্রুত হেঁটে পালিয়ে যাব, সে উপায় নেই। এখন কী মামলা ঠুকে দেয়, সেটাই দেখার বিষয়। এয়ারপোর্টে সবার সামনে মান–ইজ্জত ফেঁসে শেষে কিয়েক্টা অবস্থায় দাঁড়াবে, ঠোঁটে মেকি হাসি টেনে তাই ভাবছি।

‘বাচ্চাটা কি তোমাদের? ওভাবে কাঁধে নিয়েছ কেন?’

বলামাত্র ছেলের বাবা তাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে সোজা দাঁড় করিয়ে দিল। কিন্তু ভিকটিম বাবাজি মাটিতে পা পড়ামাত্র ঈশান কোণের দিকে দিল এক ভোঁ–দৌড়। সেখানে এয়ারপোর্ট পুলিশের গলফ কার্টগুলো পার্ক করা। তেমন একটা গাড়ি হাঁকিয়ে সে পালিয়ে যাবে, এই হলো ধান্দা। এতক্ষণে পুরো ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে পুলিশ ভদ্রমহিলা তার থলথলে শরীর বিদ্যুৎবেগে উড়িয়ে নিয়ে সম্ভাব্য গাড়িচোর বরাবর ছুট লাগাল। মুহূর্ত আগের আসামি বাবা-মা আমরা বিনা লড়াইয়ে মামলা জিতে এবার তারিয়ে তারিয়ে চোর-পুলিশ খেলা দেখতে লাগলাম।

বেশিক্ষণ মজা নেওয়া গেল না। কারণ, কালপ্রিট ধরা পড়ে পুলিশ আপার হাতের ফোকরে হাত ঝুলিয়ে পায়ে পায়ে ফিরে আসছে।

‘ছেলে তো মারাত্মক চঞ্চল। কিন্তু বকাঝকা একদম বারণ। বুঝিয়ে বলবে, কেমন? নইলে বড় হয়ে গুন্ডা টুন্ডা বনে যাবে...। ’বলেই গুন্ডা ছেলে হাতে গছিয়ে দিয়ে সে বিদায় নিল তখনকার মতো। চোখের আড়ালে চলে যেতেই আবার ছেলে কাঁধে ফেলে চেক-ইনটা কোনো দিকে খুঁজতে রওনা দিয়ে দিলাম। শিশুপালনবিষয়ক জ্ঞান মাথা ঝাঁকিয়ে বাঁ কান দিয়ে বের করে দিয়েছি। বাঙালি বাবা-মা বলে কথা।

জার্মান সময়ানুবর্তিতা মেনে প্লেন ছাড়ল ঘড়ির কাঁটায়। ঘণ্টা পাঁচেকের মাঝারি লম্বা ভ্রমণ। মিউনিখ টু টেনেরিফে। নভেম্বরের হাড়কাঁপানো শীতকে ভেংচি কেটে ইউরোপের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় পালিয়ে যাচ্ছি আফ্রিকার গা ঘেঁষে দাঁড়ানো স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে। টেনেরিফে তারই এক দ্বীপ। মনের ভেতর জেল ডিঙানো ফেরারির আনন্দ। ভারী জ্যাকেটগুলো খুলে ওভারহেড ব্যাংকারে পুরে আরাম করে বসলাম।

‘উফ্, এ্যাইকক...!’ শান্তিতে আর বসা গেল কই। পাজি ছেলেটা সামনের আসনের কারও চুল টেনে দিয়েছে। বছর ষাটেকের প্রৌঢ়া ঘাড় ঘোরাতে ঘোরাতে অপ্রস্তুত আমি বার দশেক ছেলের হয়ে সরি বলে ফেললাম। ভদ্রমহিলা হালকা হেসে, ‘আহা, ছেলেমানুষ, ইটস ওকে’ বলে ফিরে বসলেন। তবে আরও তিন-চারবার চুলে টান খাবার পরে সেই একই ভদ্রমহিলা আমাদের মাতা-পুত্রকে একযোগে দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে দিলেন। তারপর পাশের সিটের যাত্রীর সঙ্গে আসন বদলে নাগালের বাইরে চলে গেলেন। বেয়াড়া ছেলেটা যেকোনো ফাঁকে সুযোগ কাজে লাগায়! কিন্তু যা ঘটার, তা তো ঘটেই গেছে। সুতরাং ছাইভস্ম ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে জানালার বাইরে নির্লিপ্ত দৃষ্টি ছুড়লাম।

টেনেরিফের স্বচ্ছ আকাশ। ছবি কৃতজ্ঞতায়: আদিবা আমাথ
টেনেরিফের স্বচ্ছ আকাশ। ছবি কৃতজ্ঞতায়: আদিবা আমাথ

২.
মেঘ কেটে নেমে যাচ্ছি। আকাশি নীলের জগৎ থেকে সাগর নীলে নামছি যেন। আরও নামতেই আটলান্টিকের বুক গোটা আষ্টেক বড়সড় দ্বীপ আর কিছু খুচরো দ্বীপের অবয়ব ভেসে উঠল। ছোট–বড় পুঁতি মিলিয়ে গাঁথা মালার মতো এক সুবিশাল দ্বীপমালা। এসব মিলিয়েই ক্যানারি আইল্যান্ড। ভূগোলের ভাষায় তাকে আদর করে ডাকা হয় ‘আর্কিপেলাগো’বলে। তারই একটা লালচে দ্বীপ বরাবর ছুটে চলছে আমাদের বিমান।

ক্যাপ্টেন আর বিমানবালাদের তাড়ায় পড়ে সিট বেল্ট বাঁধছি। হঠাৎ মনে হলো, টেনেরিফে নিয়ে অনেক আগে কোথাও কিছু একটা পড়েছি বা ডকুমেন্টারি দেখেছি যেন। ঘটনা বা দুর্ঘটনা। হাজার স্মৃতি ঘেঁটেও লাভ হলো না। ওদিকে প্লেন নাক নামিয়ে মাটি ছুঁল বলে। আর তখনি মনে পড়ল ব্যাপারটা।

টেনেরিফে এয়ারপোর্ট, ১৯৭৭। রানওয়েতে হালকা কুয়াশা কেটে ৭৪৭ জাম্বো জেট টেক অফের জন্য দৌড়াচ্ছে। কেউ কিচ্ছু টের পেল না যে আরেকটা ৭৪৭ উল্টো দিক থেকে নাক বরাবর ঘণ্টায় দুই শ মাইল গতি নিয়ে ছুটে আসছে। শেষ মুহূর্তের কোনো চেষ্টাই কাজে এল না। স্ফুলিঙ্গ তুলে ঘটে গেল বিমান ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। মিনিটের ব্যবধানে প্রায় ছয় শ মানুষ হারিয়ে ছাই।

কাহিনি মনে পড়ার আর ভালো সময় পেল না। আমাদের রায়ান এয়ারের পলকা প্লেনটাও প্রকাণ্ড এক ঝাঁকি মেরে রানওয়ে ছুঁয়ে প্রায় ছেঁচড়ে যেতে থাকল। ‘পাগলা ঘোড়া খেপেছে, চাবুক ছুড়ে মেরেছে’ অবস্থা। অস্বস্তিতে কলিজা খামচে বসে থাকলাম।

অবশ্য মিনিটখানেক বাদেই ভয় উবে গেল। ধুলো উড়িয়ে পাগলা ঘোড়ার খুর থেমেছে। কিন্তু এ কোথায় এসে পড়েছি? চারদিক আলোয় আলোয় ঝলসে যাচ্ছে। মিউনিখের মেঘে ঢাকা ঘোলাটে গুমোট দিন দেখে অভ্যস্ত চোখে তাতানো রোদ সইছে না। পিটপিট চোখে হাতড়ে হাতড়ে বেরিয়ে এলাম একে একে।

৩.
ভাড়া করা গাড়িটা মসৃণ হাইওয়ে ধরে দুর্বার গতিতে ছুটছে। ইচ্ছে করেই হোটেল অনেক দূরে নেওয়া হয়েছে। লোকালয় থেকে দূরে থাকা যাবে। হাতুড়ি বাটালি পিটিয়ে গড়া শহরে দেখার কী আছে? রংবেরঙের ইটকাঠ আর সুরকি ছাড়া? তার চেয়ে পাহাড়, সাগর, খোলা আকাশ ঢের ভালো। তা ছাড়া বহুদিন শীতের দেশে থেকে খানিকটা নবাব হয়ে গিয়েছি। সামান্য গরমেই ননির পুতুল ঘেমে গলে যাই। টেনেরিফের নভেম্বরকে রীতিমতো কাঠাফাটা জুলাই বলে ভুল হচ্ছে। সাগরপাড়ে হয়তো গরমটা কম হবে।

ড্রাইভার নিজে উদ্যোগে আলাপী হয়ে কথা জুড়েছে। আমরা পথের ক্লান্তিতে কুপোকাত। মাঝে মাঝে হ্যাঁ-হুঁ করছি ভদ্রতার খাতিরে। আর সে বকেই চলছে। পুরো ক্যানারি আইল্যান্ড নাকি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফল। আগ্নেয়গিরি এই দ্বীপমালাকে সাগর থেকে টেনে তুলেছে। বলা যায় না, কবে আবার আগ্নেয়গিরির মাথা বিগড়ে যায় আর দ্বীপগুলোকে গলন্ত লাভার স্রোতে তলিয়ে ফেলে। সবই প্রকৃতির লীলা। আসতে না–আসতেই গরম লাভায় ডুবিয়ে মারার কথায় সামান্য চুপসে গেলাম। এ কেমন অভ্যর্থনা রে বাবা!

টেনেরিফে পেশাদার পর্যটন অঞ্চল। পাহাড়ি পথের দুপাশে ক্লাব আর অল-ইনক্লুসিভ রিসোর্টের ছড়াছড়ি। মোট কথা, প্রমোদ দ্বীপ। সেখানে ছাও-পাও নিয়ে গিয়ে কতখানি আমোদ করা যাবে, ভেবে কপালে তিন-চারটে ভাঁজ পড়ল।

প্রায় এক ঘণ্টা পর হোটেলে পৌঁছে অবশ্য মুচকি হাসি ফুটল। সামনেই উথালপাতাল ঢেউ আছড়ে পড়েছে সৈকতে। জায়গাটা কোলাহল থেকে বহু দূরে। আমোদ-প্রমোদের মতো চটুল শব্দগুলো ঢেউয়ের ঝাপটায় কই যে ভেসে চলে গেল, হদিসই পেলাম না। তাজা নোনা বাতাস নিমেষেই ক্লান্তি ঘুচিয়ে কর্পূরের মতো উড়িয়ে দিল। দীর্ঘ যাত্রার শেষে শুরু হলো আসল ভ্রমণ। (চলবে)

* লেখক: গবেষক, ইনস্টিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি