একা ছাদে

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

হাঁটতে হাঁটতে মাথার ওপরে আকাশটাকে আরও একবার দেখে নেয় আত্রেয়ী। এত কাছ থেকে আকাশ দেখতে বেশ লাগে। উড়ে যাওয়া মেঘ, পাখির ডানা, দূরে আরও দূরে জেট প্লেনের সাদা ধোঁয়া পথ বিছিয়ে হারিয়ে যাওয়া। সপ্তম তলার ছাদের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হাঁটে আত্রেয়ী। কখনো জোরে কখনো অলস পায়ে। চলতে চলতে মাঝেমধ্যে মোবাইলের pedometer app থেকে দেখে নেয় আর কটা স্টেপ বাকি। কত স্টেপ কমপ্লিট করতে হবে তাকে আর, সারা দিনে ঠিক যতটা পা ফেলা প্রয়োজন তার। মেয়ে বলে দিয়েছে, গাফিলতি নয়, আলসেমি নয়; এইটুকু নিয়ম করে করতেই হবে তাকে। তার কারণ আছে, যে শরীর এত দিন ইচ্ছেমতো যা খুশি করতে অভ্যস্ত ছিল, আজকাল সেও দেখি একটু অনিয়মেই গোলমাল পাকায়। অগত্যা তখন ডাক্তারের কাছে ছুটতেই হয়।

ডাক্তার চোখ গোল করেন, ‘আপনার সুগার আছে না? তাহলে? এত অনিয়ম করেন কেন? সারা দিনে অন্তত ৪৫ মিনিট হাঁটবেন, বুঝেছেন? ব্রেকফাস্টটা খেয়ে ওষুধ খাবেন। কটায় ব্রেকফাস্ট খান?’

আমতা আমতা করে আত্রেয়ী, ‘মানে ওটা একটু দেরি হয়ে যায়।’

‘না, দেরি করবেন না। সাড়ে আটটা থেকে নয়টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট মাস্ট। দিনে দুটো ফল খাবেন। আঙুর যদি খান তা এক মুঠোর বেশি না, বুঝেছেন? মিষ্টি মাঝেমধ্যে খেতে পারেন, তবে সেদিন ভাত বা রুটি কম খাবেন। পা দেখি, পা ফোলা আছে কি? না, পা ঠিকই আছে। নেক্সট টাইম কিন্তু চোখটা দেখিয়ে আনবেন।’

আস্তে আস্তে বলেন আত্রেয়ী, ‘কেন, চোখ তো ঠিকই আছে!’

‘হ্যাঁ, ঠিক আছে জানি। তবু সুগার থাকলে বছরে একবার নিয়ম করে চোখ দেখানো, রেটিনা চেকআপ খুব জরুরি বুঝলেন?’

আত্রেয়ী বোঝে, সবই বোঝে কিন্তু নিয়ম করে, সময় মেনে খাওয়া, শোওয়া, হাঁটা, শরীর নিয়ে এত আদিখ্যেতা কেন জানি না ভালো লাগে না তার। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে, দুজনেই বিদেশে। এখন আর অত চিন্তা কী? আগে যখন ওরা ছোট ছিল, তখন একটু শরীর খারাপ হলেই ভয় করত। যা–ই হোক, তবু মানতে হয় কারণ ওরা দুশ্চিন্তা করে। মাকে নিয়ে বেজায় চিন্তা ওদের, ‘মা খেয়েছ?’ ‘মা ঘুমিয়েছ?’ ‘মা, এখন তুমি কী করছ?’ তার একটু শরীর খারাপ হলেই ছেলেমেয়ের কাজকর্ম, পড়াশোনা সব মাথায় ওঠে। ফোন, স্কাইপ চলতে থাকে দিনে রাতে। না, আত্রেয়ী প্রতিজ্ঞা করেছে, শরীরের অবহেলা আর করবে না সে।

ছাদে পায়চারি করতে করতে এই শেষ বিকেলে রোজই দুটো বকের বাসায় ফেরা দেখার প্রতীক্ষায় থাকে আত্রেয়ী। তিনটে নয়, চারটে নয়, ঠিক দুটো মোটে বক, দক্ষিণ থেকে উত্তরে উড়ে চলে যায়। দক্ষিণ দিকে হয়তোবা কোনো পুকুর বা ঝিল আছে আর উত্তরে ওদের বাসা, তাই দিনের শেষে ওখানেই ফিরে যাওয়া। ফটফটে সাদা ডানা মেলে কী স্বচ্ছন্দে ওরা আকাশ পেরিয়ে চলে, আত্রেয়ী চেয়ে চেয়ে দেখে যতদূর দেখা যায় ওদের। মানুষের নাম, গোত্র, ধর্ম আরও কত কী থাকে কিন্তু পাখি, সে তো শুধুই পাখি, টিয়া, বক, ময়না চেনার সুবিধার জন্য এসব নাম তো মানুষেরই দেওয়া। মানুষ তো কত সব নাম দেয় তাদের পোষা পাখিদেরও কিন্তু আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো বা গাছের ডালে দোল খাওয়া পাখিটিকে ভালো লাগলেও থোড়াই তাদের নাম দেওয়া যেতে পারে! আর সেসব নামে ডাকা যেতে পারে! এই যে দুটো বক সন্ধের ঠিক আগে রোজ উড়ে চলে যায় ফ্ল্যাটের ছাদের ওপর দিয়ে আত্রেয়ী কি ওদের কোনো নাম দিতে পারে? আর সেই নাম ধরে ডাকতে পারে! তা ছাড়া আত্রেয়ী ওদের চিনলেও ওরা কি চেনে আত্রেয়ীকে!

আত্রেয়ী একলা ছাদে আকাশ দেখে। আত্রেয়ী আকাশ দেখতে ভালোবাসে। সে জানলার ফাঁক দিয়েই বলো অথবা বারান্দার গ্রিলের মাঝখান দিয়ে আর ছাদ হলে তো কথাই নেই। এক সম্পূর্ণ ভালো লাগা মেখে আকাশ ধরা দেয় তার চোখে। আত্রেয়ীর কাছে আকাশ দেখা মানে মুক্তির নেশাকে জাগিয়ে রাখা, বাঁচিয়ে রাখা। কিছু মানুষ আবার আকাশের মতো হয়। মুক্ত, স্বাধীন, অমলিন। আর তাদের খুব ভালো লাগে আত্রেয়ীর। যেমন শাহানা দি। আকাশপথেই আলাপ হয়েছিল বছর দশেক আগে। নেপাল বেড়াতে যাওয়ার সময়, প্লেনে। সেই থেকে কীভাবে বন্ধু হয়ে গেল দুজনে! এক বড়সড় বিজ্ঞাপন সংস্থার মালকিন শাহানা দি। বেশ কিছু বেসরকারি সন্ধ্যার (এনজিও) সঙ্গেও জড়িয়ে আছেন তিনি। যথেষ্ট কর্মমুখর জীবন যাকে বলে। প্রায়ই ঘুরছেন দেশ–বিদেশে। শাহানা দির যেটা সবচেয়ে আকৃষ্ট করে আত্রেয়ীকে তা হলো, আত্মনির্ভরতা আর ইতিবাচক চিন্তাধারা। শাহানা দির সঙ্গে কথা বলেই যেন কত শান্তি! মন খারাপ থাকলে তা ভালো হয়ে যায় নিমেষেই। দেখা সাক্ষাৎ খুব কমই হয় দুজনের। কিন্তু ফোন, হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগটা বেশ ভালোই আছে। এই তো সেদিন ফোনে হঠাৎই বেশ অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘মনের গভীরে লুকোনো সত্যিটাকে খুঁজে বের কর আত্রেয়ী।’
‘আমি সত্যিটাকেই যে খুঁজছি, তা তুমি কি করে বুঝলে শাহানা দি!’
‘কেন? ট্যারো কার্ড করে। সেদিন তোর গলা, তোর কথা শুনে তোকে কেমন ডিপ্রেসড লাগছিল, তাই ভাবলাম তোর ট্যারো করি।’
‘কী আশ্চর্য, তুমি এই সবও করো নাকি, মানে মানো নাকি!’
এবার জলতরঙ্গের মতো শোনাল শাহানা দির হাসি। ‘আরে জানতে কী লাগে! মনটাকে শান্ত করে একটু ধ্যান, এই তো, আরকি!’
‘না, আমি বলছি তুমি এই সব মানো? মানে বিশ্বাস করো বুঝি!’
‘হ্যাঁ মানি, মানতে, বিশ্বাস করতে ভালো লাগে। আমার খুব মিলে যায় যে।’
‘বেশ তাহলে বলো আমারটা কী দেখলে!’
‘দেখলাম তোর মুন কার্ড এল। মুন কার্ড মানে জানিস তো?’
‘নাগো।’
‘বেশ। কার্ড দেখাচ্ছে ম্লান আলোয় পাহাড়ের দিকে চলে যাওয়া এক পথ, যা বড়ই অস্পষ্ট। দুপাশে দুটো টাওয়ার। একদিকে একটা নেকড়ে আর একদিকে একটা কুকুর দাঁড়িয়ে যথাক্রমে চিহ্নিত করছে মনের বন্য আর শান্ত দিক। কোন দিকে যাবি, চয়েসটা তোর একান্তই। তোর ভেতরে দুটো সত্তা সমানে লড়াই করে চলেছে। একজন বন্য বিবাগী আর একজন কঠোর রক্ষণশীল। দুটো সত্তাকেই তুই লালন করছিস অন্তরে। তুই কাউকেই হারাতে চাস না আসলে। দ্যাখ, মানুষের ভেতরে কমবেশি দ্বন্দ্ব তো থাকেই, থাকবেই কিন্তু সেটা যখন প্রবল হয়ে ওঠে, তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া বেশ কঠিন হয়ে পরে।’

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

আত্রেয়ী চুপ করে শোনে। শাহানাদি বলে চলেন, ‘একদিকে তুই চলতে চাস চিরাচরিত নিয়মকে ঠেলে কিন্তু আর একদিক থেকে তোর রক্ষণশীলতা এসে তোর পায়ে শিকল পরিয়ে দেয় সযত্নে।’

মুঠোফোন টুংটাং বাজে, ইনকামিং কল আলো ছড়ায় স্ক্রিনের বুকে, নামটা দেখে আত্রেয়ী ওটা রেখে দেয় লিফটের ঘরের সিঁড়িতে। ‘কোন দিকে যাবি চয়েসটা তোর একান্ত...’ শাহানা দির কথাগুলো মনে পড়ে। হু হু বাতাসে যেন বৈরাগ্য জাগে। সূর্য সরে যায় অহংকারী ইমারতের আড়ালে ধীরে ধীরে। দু–একটা শালিক কিচমিচ ডাকে এদিক–ওদিক থেকে। ছাদের কলের ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়া জলে দিন শেষের তৃষ্ণা মিটিয়ে উড়ে যায় কাক দূরে। চারপাশে গাঢ় কমলা আলো ছড়িয়ে শহরের গায়ে গোধূলি এসে নামে। ‘নিশা নামে দূরে শ্রেণিহারা একা ক্লান্ত কাকের পাখে; নদীর বাতাস ছাড়ে প্রশ্বাস পার্শ্বে পাকুড় শাখে। হাটের দোচালা মুদিল নয়ান, কারও তরে তার নাই আহ্বান; বাজে বায়ু আসি বিদ্রূপ-বাঁশি জীর্ণ বাঁশের ফাঁকে; নির্জন হাটে রাত্রি নামিল একক কাকের ডাকে।’ যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘হাট’। আশ্চর্য বিষণ্ন লাইনগুলো! সেই কোন ছোটবেলায় পড়েছিল এখনো কেমন মনে আছে স্পষ্ট! আসলে যা কিছু প্রিয়, তা তো লুকিয়েই থাকে মনে। গান, কবিতা, কথা, ঘটনা এমনকি বিশেষ কিছু সম্পর্কও; সে সম্পর্কের কোনো নাম হয় না, নাম দেওয়া যায় না, নাম থাকাটা খুব সহজ হয় না। আর দিলেও প্রশ্ন থাকে লোকে কীভাবে, কীভাবে সেটাকে নেবে...তার চেয়ে থাক না শুধুই মনে।

‘আমার জীবন নিয়ে একটা গল্প লিখবে? আমি জানি আত্রেয়ী এটা তুমিই একমাত্র ভালো পারবে।’ অন্তর্মুখী চরিত্রের এক মানুষ বলে চলে তাঁর শৈশব, কৈশোর থেকে আজকের পোড় খাওয়া জীবনের নানা জানা–অজানা কথা। আত্রেয়ীর কাছে অকপটে জানায় সে তাঁর সুখ, দুঃখ, যন্ত্রণা, হতাশা এমনকি আশা আর অহংকারের কথাও। জীবনের ভালো লাগা এক–একজন এক–এক রকমভাবে খোঁজে। নীল আকাশের নিচের মানুষগুলো কত আকাঙ্ক্ষা, কত শখ যে লালন করে! কেউ পাহাড়ে চড়ে, কেউ বালি দিয়ে শিল্প গড়ে, কেউ আকাশ অভিযানে যায়, কেউ ভেসে থাকার টানে সাগরে হারাতে চায়। আত্রেয়ী লিখতে ভালোবাসে। লেখাটা তার প্যাশন। তার ভালো লাগার জগৎ। সম্পূর্ণ লেখাগুলো স্বস্তি দেয় তাকে। সহজেই পৌঁছে যায় পাঠকের হৃদয়ে। আর অসম্পূর্ণ লেখাগুলো তার দিকে চেয়ে থাকে হাঁ করে। রাতে তারা আত্রেয়ীর খাটের পাশের টেবিলে ঘুমায়। অনেক সময় ঘুম ভাঙিযে আবার ডেকেও তোলে। আত্রেয়ী চশমা হাতড়ায়, কলম খোঁজে, কোনো খাতার কোনো লেখাটা ডাকছে তাকে খুঁজে বের করে শান্ত করতে হবে যে! সৃষ্টির এই তাড়না আত্রেয়ীর বড় আপনার। ভালোবাসা, ভরসা, আশা আর স্বপ্নের ভান্ডার। আত্রেয়ী লেখা শুরু করে। কারও বিশেষ আন্তরিক অনুরোধে এই লেখায় হাত দেয় সে। এ কাহিনির নায়ক তার চেনা চরিত্র। আসল নাম পাল্টে আত্রেয়ী তার নাম রাখল সম্বুদ্ধ।

সম্বুদ্ধর কথা ও কাহিনি বেশ এগিয়ে চলল। টুকরো টুকরো কথায় ছোট ছোট মুহূর্ত সেজে উঠতে লাগল।
‘ঘুমিয়ে পড়েছিলে? ঘুম ভাঙালাম?’
‘না না।’
‘আচ্ছা, তোমাদের ওখানে কি বৃষ্টি হচ্ছে?’
ফোন কানে নিয়ে ঝটপট বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার বাইরে চোখ রাখে আত্রেয়ী। ‘কই না তো। তবে হ্যাঁ ভীষণ মেঘ করেছে। মনে হচ্ছে এখনই নামবে। আপনি কোথায়?
‘এই তো অফিসে বসে বৃষ্টি দেখছি আর ভাবছি মেঘগুলো সব হু হু করে তোমার বাড়ির ওপর দিয়েই এদিকে আসছে।’
‘বা, আমার বাড়ির ওপর দিয়েই যে আসছে কী করে বুঝলেন!’
‘কারণ আমার অফিসের উত্তর দিকে তোমার বাড়ি যে।’
‘ওহহো, তবেই হয়েছে, সব মেঘই কি উত্তর দিক থেকেই আসছে!’
‘হ্যাঁ, সে রকমই দেখছি যে।’ সম্বুদ্ধ হাসতে হাসতে বলে।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

হাঁটতে হাঁটতে আত্রেয়ী দাঁড়িয়ে পড়ে। সন্ধের আলো–আঁধারে স্নিগ্ধ আকাশে একটা তারা জ্বলজ্বল করে। এমন এক তারা দেখলেই ঠাম্মার কথা খুব মনে পড়ে। ঠাম্মা বলত, এক তারা দেখলে নাকি দোষ হয়। সে সময় আরও একটা কি দুটো তারাকে আকাশের বুক থেকে খুঁজে নিতে হয় আর তা না পেলে মনে মনে তিনজন ব্রাহ্মণের নাম নিতে হয়। কিন্তু এক তারা দেখায় দোষ কেন, আত্রেয়ী তা জানে না আজও। ঠাম্মা এমন কত কি যে বলত! সেসব দিনে সন্ধে নামার একটু আগে থেকেই তাদের বাগানের সন্ধ্যামালতী ফুলের ঝাড়গুলো যেন সব রঙের পসরা সাজিয়ে বসত। নিভে আসা দিনের আলোয় হলুদ, রানি, সাদা রঙের কত অজস্র ফুল যে পাপড়ি মেলত! ঠাম্মা বলত, ‘সন্ধে লেগেছে।’ ঠাম্মা বলত, ‘সন্ধে দিতে হবে।’ তার মানে ঠাকুর ঘরে প্রদীপ আর ধূপ জ্বালিয়ে শাঁখ বাজাতে হবে। আর তারপর বাড়ির সব ঘরে ঘরে সেই ধূপ একবার করে ঘুরিয়ে আবার ঠাকুর ঘরে রেখে আসতে হবে। সন্ধে দেওয়া অবশ্যই একটা কাজ ছিল বটে। একটু বড় হওয়ার পর মা এই কাজটা ভাগ করে দিয়েছিল তাদের দুই বোনের মধ্যে। একদিন দিদি আর একদিন সে, এভাবে তারা দুই বোন দিত সন্ধে। চারতলার চিলেকোঠায় ঠাকুরঘর। তিন দিকে জানালা, জানালা খুললেই দুরন্ত দাপট হাওয়ার। আত্রেয়ীর পছন্দ ছিল সেই চিলেকোঠা। এখানে দাঁড়ালে দূরে কারখানার উঁচু চিমনির তারগুলোতে টিয়া পাখিদের লাইন ধরে বসে থাকা, কালবৈশাখীর পাগলপারা রূপ দেখা, শ্রাবণের অঝোরধারার খেলা, শীতের ধূসর সাঁজবেলা অথবা আর কিছুই নয় দুচোখ। ভরে শুধু আকাশ দেখা। আকাশের কত রং!, সব দিন, সব ঋতুতেই আকাশ বড় সুন্দর! একা এবং প্রান্তর ছুঁয়েও...।

সম্বুদ্ধও যে আকাশ যে দেখতে ভালোবাসে, এ কথা সে একবার বলেছিল আত্রেয়ীকে। ল্যান্সডাউনে ১২ তলার ওপরে তার সাজানো অফিসের লাগোয়া ছোট্ট এক ছাদ আছে। সম্বুদ্ধর বহু পরিশ্রমে তিলতিল করে গড়ে তোলা এই অফিসের নামটাও বেশ সুন্দর ‘সার্থক’। সন্ধের পর অফিসের কর্মচারীরা সব চলে গেলে সম্বুদ্ধ এসে দাঁড়ায় এই ছাদে। নিচে ব্যস্ত রাজপথ আর মাথার ওপর তারার আলোয় সেজে উদার আকাশ বড় প্রিয় তার। সম্বুদ্ধর কথা শুনতে শুনতে কখনো মুগ্ধতা, কখনো চঞ্চলতা, কখনো স্বস্তি, কখনো ভালো লাগা ছুঁয়ে যেত আত্রেয়ীকে। আত্রেয়ী বুঝেছিল যে সম্বুদ্ধ হলো খাঁটি সোনা, এতটুকু খাদ নেই যার ভেতরে। এ সোনা দিয়ে অলংকার গড়া যায় না ঠিকই কিন্তু গুপ্ত সম্পদের মতো একে লুকিয়ে রাখা যায় গোপনে, সযত্নে। আর তাই বুঝি নিজের মনের সিন্দুকে আত্রেয়ী রেখে দিয়েছিল সম্বুদ্ধকে।

এ সমাজ সংসারের ওপর অনেক রাগ, অনেক অভিমান সম্বুদ্ধর। অভিযোগ বুকের ভেতরে জমে উঠেছে পাহাড়ের মতো। সাফল্যের একটুখানি জমির জন্য একসময় প্রচুর কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। আজ অর্থ, প্রাচুর্য, সম্মান সবকিছু এলেও শান্তি নেই মনে। তার মনে হয় তার জন্য যে যতটুকু করে, সবটাই স্বার্থের আর অর্থের লোভে। ‘আমি কী পেলাম’ গোছের এক চিন্তা মাঝেমধ্যেই পীড়িত করে তাকে। তার অসুখী দাম্পত্য জীবন তাকে আরও বেশি করে ঠেলে দেয় একাকিত্বের দিকে। সম্বুদ্ধ ফিরে পেতে চায় তার হারিয়ে যাওয়া প্রথম প্রেমকে। সম্বুদ্ধ ডুবে থাকতে ভালোবাসে তার প্রথম প্রেমের স্মৃতিতে।

২৫ বছর আগের কথা, সে তো প্রায় গত জন্মেরই কথা! সত্যি তেমন করে আর কিছু মনে পড়ে না, হয়তো মনে রাখতে চায়নি বলেই ভুলে গেছে সেই মেয়ে। তবু কেউ একজন বারবার বলে চলে, তুমি এই বলেছিলে, তুমি সেই করেছিলে...মনে পড়ে? জীবন তো নদীর মতো। ভেসে চলে। কী হবে সেসব মনে রেখে! যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। অতীতকে বর্তমানে টেনে এনে লাভ কী আছে! কিন্তু কারও কাছে সেই স্মৃতি ফিরিয়ে আনা খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কেউ যেন হিপনোটাইজ করে চলেছে তাকে বারে বারে, যেন সে জাতিস্মর, এভাবে একদিন, কোনো একদিন তার সবকিছু মনে পড়ে যাবে। মেয়েটি বোঝাতে পারে না সম্বুদ্ধকে যে বিগত দিনের কথা ভুলেই সে ভালো আছে। সম্বুদ্ধ বোঝাতে পারে না মেয়েটিকে যে তার জন্য শুধু তার জন্যই সম্বুদ্ধর নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করে। সম্বুদ্ধ মেয়েটির সামাজিক অবস্থান নিয়ে ভাবতে চায় না। তার কাছে আর যা কিছু, সবকিছু বাদ দিয়ে ‘ভালোবাসি’ শব্দটাই শুধু প্রগাঢ় হয়ে মেয়েটিকে জড়িয়ে থাকে। আত্রেয়ী বোঝে সম্বুদ্ধর এই ভাবনা খুব স্বাভাবিক না। কিন্তু সে-ই বা কী করবে? সম্বুদ্ধকে সে কী করে বোঝাবে যে অনুভূতি বাঁচিয়ে রাখে ভালোবাসাকে, শরীর না। যা ফুরিয়ে যায়, তা ভালোবাসা না। শুধু শরীর দিয়ে ভালোবাসাকে বেঁধে রাখা যায় না। মন দিয়ে, অনুভূতি দিয়ে তাকে অনিঃশেষ করতে জানতে হয়। সবাই পারে না। যারা পারে, তারাই জানে এর পূর্ণতা কোথায়।

‘ভাবছি একটা নতুন কিছু করব।’
‘নতুন কর্মযজ্ঞ?’
‘বলতে পারো। আসলে এই একঘেয়ে জীবন আর ভালো লাগছে না। ঠিক করেছি একটা আশ্রম বানাব।’
‘আশ্রম! হঠাৎ আশ্রম কেন?’
‘ইচ্ছেপূরণ। মনের মধ্যে অনেক দিন ধরেই ছিল।’
‘ভালো। কোথায় বানাবেন সে আশ্রম?’
‘শহর থেকে দূরে। জায়গাটা এখনো ঠিক করিনি।’

এক বিরল চরিত্র সম্বুদ্ধ। সে নাকি বাকি জীবনটা শহর থেকে দূরে কোথাও আশ্রম বানিয়ে থাকবে! এ সংসার থেকে তার মন নাকি একেবারে উঠে গেছে। কী বলবে ভেবে পায় না আত্রেয়ী। সে তো একজন লেখিকা, সাইকিয়াট্রিস্ট তো নয়!
‘মানে আপনি তাহলে একরকম পালিয়ে যাবেন বলেই ঠিক করেছেন? কিন্তু কেন?’
‘আমার কিছু ভালো লাগছে না। আর শোনো, এটাকে পালানো বলে না, নিজের মতো করে বাঁচা বলে।’ খুব শান্ত করে বলে সম্বুদ্ধ।
‘নিজের মতো করে বাঁচতে আপনাকে কে বাধা দিয়েছে?’
‘না, এই শহরে থেকে সেটা সম্ভব হবে না। আমি পারব না।’
‘দূরে গেলেই কি পারবেন?’
‘চেষ্টা করে দেখি।’
‘কোথায় যাবেন?’
‘দেখা যাক। ভাবছি পাহাড় টাহাড়ের দিকে কোথাও একটা।’...
‘বয়স হচ্ছে। পাহাড়ে বাস করা কিন্তু অত সহজ না।’
‘কেন? কেন সহজ না?’
‘অন্য সবকিছু না হয় ছেড়েই দিলাম কিন্তু বারো মাস ঠান্ডায় থাকা সহ্য হবে কি আপনার?’
‘হবে। আমি ঠান্ডা এনজয় করি। ঠান্ডা আমার ভালো লাগে।’
‘কার ওপরে রাগ করে এমন সিদ্ধান্তটা নিলেন?’
‘কারও ওপর কোনো রাগ নেই। সবটাই আমার ইচ্ছা। কেন ঘর ছেড়ে মানুষ কি বাইরে থাকতে পারে না।’
‘না পারে না। তার পেছনে জোরদার কোনো কারণ থাকে। এই রকম আপনার মতো না।’
‘কারণ কে সব সময় জোরদারই হতে হবে তার কোনো মানে নেই। কারণ, কারণ-ই’ খুব উদাস শোনায় সম্বুদ্ধর গলা।
‘যাক গে, বাড়িতে বলেছেন আপনার এই আশ্চর্য ইচ্ছের কথা? কী বলল? মেনে নিল তারা।’
‘না, এখনো বলিনি। এবার বলব। আর মেনে নেবে না কেন? আমি সবাইকেই তো তাদের প্রাপ্য দিয়েই যাব। টাকা, পয়সা, সম্পত্তি। আর কী? আর কী চাই! সুখে থাকো, সুখে থাকো সব। এই মানুষটাকে আর ওদের কিসে দরকার বলো?’
উফ, কী ভীষণ হতাশায় ডুবে যে কথাগুলো বলছে সম্বুদ্ধ! সত্যি ওর কাউন্সেলিং প্রয়োজন।
‘দেখুন, এইগুলো কিন্তু কোনো সুস্থ চিন্তা না। আমার মনে হয় একটু কাউন্সেলিং করলেই এই হতাশাটা কেটে যাবে আপনার।’
‘কোনো প্রয়োজন নেই, আমি যথেষ্ট সুস্থ আছি আর সুস্থ সিদ্ধান্তই নিয়েছি।’
‘বেশ, তাহলে আপনার যা ইচ্ছে হয়, তা–ই করুন। আর যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন, তখন সবাইকে ফেলে আমাকেই বা জানাচ্ছেন কেন?’
‘তার কারণ তুমি লেখিকা এই গল্পে সম্বুদ্ধের ঠিকানাটা তোমার জানা দরকার।’
‘না কোনো দরকার নেই। কারণ সম্বুদ্ধর এই সব ছেড়েছুড়ে দূরে চলে যাওয়ার ব্যাপারে লেখিকার এতটুকুও মত নেই।’

আমি তোমাকে বিরক্ত, বিব্রত করতে চাই না আত্রেয়ী। তুমি শুধু সম্বুদ্ধর ঠিকানাটা তোমার কাছে রাখো। এটা আমার অনুরোধ।
আত্রেয়ী চাইল এই গল্প অসমাপ্ত রেখে দিতে কিন্তু সম্বুদ্ধ কোনোভাবেই রাজী হলো না তাতে।

বড় জেদি আর একগুঁয়ে এক চরিত্র সম্বুদ্ধ। সে নতুন কর্মযজ্ঞে ঝাঁপ দিয়েছে। সে সত্যি সত্যিই শহর ছেড়েছে। ল্যান্সডাউনে নিজের হাতে গড়া ঝা–চকচকে অফিস স্ত্রীকে দিয়ে এক প্রত্যন্ত গ্রামে আশ্রম বানিয়ে সে আছে...। একে শুধু একটা খেয়ালই বা বলা যায় কীভাবে! আত্রেয়ীর সত্যিই খুব আশ্চর্য লাগছে, সম্বুদ্ধ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সেখানে দিব্যি আছে! কত দিন হয়ে গেছে অমন নির্জন একটা গ্রামে, আচ্ছা সম্বুদ্ধর কি কান্না পায় না সন্ধে হলে! এই শহর, নিজের ফ্লাট, অফিস, প্রিয়জন, পরিজন সত্যি, সত্যিই কি সবকিছুর আকর্ষণই হারিয়েছে সে! আত্রেয়ী বোঝে সম্বুদ্ধ আসলে কাজের মধ্যে ডুবে অনেক কিছু ভোলার চেষ্টা করছে।

অলঙ্করণ মাসুক হেলাল।
অলঙ্করণ মাসুক হেলাল।

আত্রেয়ী খাতার বুকে কথা রাখে। কথায় ভাসে, কথায় ডোবে। কথা ছুঁয়ে থাকে তাকে। কথা রয়ে যায় তার সঙ্গে। একটা শান্ত নদী আত্রেয়ীর বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে আর প্রয়োজনে জেগে ওঠে। শীতের দুপুরে অরণ্যের আলোছায়ায় সেই নদীর জলে একটা নৌকা ভেসে চলে। সেই নৌকায় বসে কেউ একজন কিছু শোনায় তাকে। আবছা তার অবয়ব, ভরাট তার কণ্ঠস্বর। নৌকার আর একদিকে বসে আত্রেয়ী খুব মগ্ন হয়ে সেই মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করে। মানুষটা কি শোনাচ্ছে তাকে? কবিতা? হ্যাঁ, একের পর এক তার নিজের লেখা কবিতা। কখনো পাহাড়ি পাইনের সারি ছাওয়া পথে দেখা হয় তার সঙ্গে। সে গেয়ে ওঠে। অপূর্ব গুনগুন সেই সুর আত্রেয়ীর বড় ভালো লাগে। আত্রেয়ী সে গানের মানে, সে গানের ভাষা খোঁজে। সে সুরের রেশ রয়ে যায় তার মনজুড়ে।

সম্বুদ্ধ তার কাজের আগামী পরিকল্পনা ও তার বিস্তারিত বর্ণনা আত্রেয়ীকে লিখে জানিয়েছে।

পড়ন্ত বেলার রোদ আশ্রমের গোলাপ বাগানে খেলা করছে। সম্বুদ্ধর ভিডিও ক্যামেরা আশ্রমময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। সম্বুদ্ধ হোয়াটসঅ্যাপে আশ্রমের প্রচুর ছবি আর ভিডিও আত্রেয়ীকে পাঠিয়েছে। আত্রেয়ী, দেখব না দেখব না করেও মন দিয়ে সেই সব দেখেছে। দূরে দূরে পাহাড়ের সারি, আশ্রম বানানো হয়েছে, যেখানে সেটা সমতল ভূমি। পাহাড়ে নয় কিন্তু পাহাড়ের কাছাকাছি। সম্বুদ্ধ বরাবরই ভালো কাজ করতে ভালোবাসে। সমাজের জন্যে বিশেষ করে নিজের তুষ্টির জন্য মহৎ কিছু করার ইচ্ছেটা তার বহুদিনের কিন্তু তাই বলে এভাবে! স্বেচ্ছা নির্বাসনে গিয়ে! সম্বুদ্ধর সাধের ঠিকানা আত্রেয়ী অবাক হয়ে দেখে। এখানে গ্রামের অভাবী নারী–পুরুষদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া থেকে শুরু করে দরিদ্র ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, দুস্থ মানুষদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা—সবই ব্যবস্থা আছে। সন্দেহ নেই পুরোটাই এক অসামান্য প্রচেষ্টা। আশ্রম ঘিরে সবুজের অপরূপ স্নিগ্ধতা, মাঝে চোখ জুড়ানো বাগান, গোলাপের বাহারে ভরা। পাঁচিলের ধারে ধারে ফল আর ফুলের প্রচুর গাছ লাগানো হয়েছে। দু তিনজন মালী সেখানে কাজ করছে। আশ্রমের বড় একটা ঘরে ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা মাদুরে বসে কেমন মিষ্টি সুরে নামতা পড়ছে। একজন মাঝ বয়সী শিক্ষক একটু দূরে আসন পেতে বসে আছেন। পরপর চারটে ঘরে গ্রামের মেয়ে বউরা মেশিনে কাপড় বুনছে। সম্বুদ্ধর নির্দেশে এদেরই মধ্যে একজন এসে কয়েকটা শাড়ি ক্যামেরার সামনে তুলে ধরল। বাহ, কী সুন্দর! ক্যামেরা এগোচ্ছে। অতিথিদের থাকার জন্য গোটা ছয়েক ঘর, পরিচ্ছন্ন, সাদামাটা, ছিমছাম। দোতলায় মন্দির। সিঁড়ির দুপাশে মহাপুরুষদের ছবি ও বাণী। কোথাও কোনো বাহুল্য অথবা অযথা চাকচিক্য নেই। যতটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই। সম্বুদ্ধ জানিয়েছে ওখানে সম্বুদ্ধর সঙ্গে আলাপ হয়েছে স্থানীয় সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের, যিনি অবসরে যাওয়ার পর এই আশ্রমের কাজে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। সম্বুদ্ধ ভয়েস মেসেজ পাঠিয়েছে। সম্বুদ্ধ তার নতুন ঠিকানায় আত্রেয়ীকে অন্তত একবার ঘুরে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

সম্বুদ্ধ লিখেছে, ‘এক আত্রেয়ী ছাড়া সম্বুদ্ধকে এ জীবনে আর কেউ কখনো বোঝেনি। অন্তত একবার এসো আত্রেয়ী। তুমি একবার এসে দেখে গেলে শান্তি পাব আমি।’

আত্রেয়ী যায়নি। আত্রেয়ী এর কোনো উত্তরও দেয়নি।

অনেক চেষ্টা করেও সন্ধের আকাশে একের বেশি তারা খুঁজে পায় না আত্রেয়ী। আর তাই সেই শান্ত তারাটির দিকে চেয়ে বলব না বলব না করেও তিন ব্রাহ্মণের নাম বলে সে। ‘কেন’র উত্তর নাই–বা মিলল, ‘দোষ’ কিসের নাই–বা জানল, তবু ঠাম্মার কথা তো রাখা হলো। সিঁড়ির ওপরে রাখা মোবাইলটা ঘন ঘন বেজেই চলেছে। আত্রেয়ী ওটা সাইলেন্টে রেখে ছাদের দরজাটা বন্ধ করে।

*লেখক: গল্পকার