টেনেরিফের বতুতা বাহিনী-২

টেনেরিফের কালো সৈকত। ছবি: আদিবা আমাথ
টেনেরিফের কালো সৈকত। ছবি: আদিবা আমাথ

৪.

দলবিহীন একলা ডাকাতকে দুর্ধর্ষ লাগে না। কেমন মিনমিনে সিঁধেল চোর মনে হয়। বেড়াতে এলেও দলবল লাগে। নইলে ঠিক পর্যটক পর্যটক ভাব আসে না। ভবঘুরে-ভ্যাগাবন্ড মন হয়ে বড়জোর। হোটেলে পা রাখা মাত্র আমরা তাই দল ভারী করে ফেলে জাতে উঠে গেলাম। আদিবা আর আকরাম তাদের পুঁচকে ছানা আমালিয়াকে নিয়ে আমাদেরই অপেক্ষায় বসে ছিল। শুধু বগলে জুতা চেপে ইবনে বতুতা সেজে বেরিয়ে পড়া বাকি।

ঘাড়ের বয়সী এই তরুণ দম্পতির সঙ্গে আগেও এদিক–সেদিক যাওয়া হয়েছে। বছরখানেকের ছোট হলেও মনের দিক থেকে কাছাকাছি বয়সের। তাই একসঙ্গে পথ চলতে বেশ লাগে। আরেকটা ব্যাপার আছে। আদিবা-আকরামের ভেতর বউ-জামাই ভাবটা প্রবল। আকরাম কারণ ছাড়াই হম্বিতম্বি করছে তো আদিবা আবহমান বাঙালি নারীর রূপ ধরে হাসিমুখে চুপ করে আছে। আসলে এটা একধরনের ভেক। আদিবার সঙ্গে থাকলে আমিও এই ভেক ধরি। ছেলের বাবাকে ইচ্ছামতো কর্তৃত্ব ফলাতে দেওয়া হয়। সব সিদ্ধান্ত তাদের হাতে। বউদের এই ‘জি জাহাঁপনা’ চেহারা ভালো লাগে না, এমন বাংলাদেশি ছেলে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাই খোশমেজাজের স্বার্থে তাদের দিন কতকের জন্য সিংহাসনটা ধার দিতে কোথাও বাধে না।

চোখে–মুখে পানির ঝাপটা মেরে জাহাঁপনাদের পিছু পিছু আমরা বেগমরা বাচ্চাকাচ্চা কোলে নিয়ে আবার তৈরি হয়ে নিলাম। হাতে আজকের পুরো বিকেলটা রয়ে গেছে। খরচ না করা অবধি শান্তি মিলছে না। ডেকে আনা ট্যাক্সিতে চেপে সৈকতের দিকটায় চললাম। যেতে যেতে পুরোটা সময়ে হাতের ডানের পাহাড়ের সারি হাতছানি দিয়ে ডাকল। পাহাড়ের মাথায় ঘোলাটে মেঘের আনাগোনা। মোটামুটি বিশ্বাস হয়ে এল তার চূড়ায় বুঝিবা কোনো ডাইনি বুড়ির রাজ্য। অথচ পাহাড়ের আঁচলেই সৈকত। আর সেখানে দিব্যি আয়েশি রোদের ছড়াছড়ি। যেন পাশাপাশি দুই সমান্তরাল জগৎ। আলো আর আঁধারে কি অদ্ভুত হাত–ধরাধরি।

বিকেলটাকে গিলে খেতে ব্যস্ত ডুবন্ত সূর্য। ছবি: লেখিকা
বিকেলটাকে গিলে খেতে ব্যস্ত ডুবন্ত সূর্য। ছবি: লেখিকা

৫.
সৈকতে নেমে আরেকবার চমক লাগল। কোথায় সাগরের তীরঘেঁষা সোনার কুচির মতো বালুর রাশি। এখানে বালু নিকষ কালো। যেন এই বালুকাবেলা পৃথিবীর কোনো অংশ না। ভাড়া করা হলুদ ট্যাক্সিটা ১০ ইউরোর বদলে আমাদের আরেক গ্রহে পৌঁছে দিল নাকি?

আমাদের ঘোর কাটছে না। এই সুযোগে ছানা দুটো ছুট লাগিয়েছে। খোলা বেলাভূমি পেয়ে ইচ্ছামতো দৌড়ে বেড়াচ্ছে। সৈকত কালো না ধলো, এই মাথাব্যথায় ফায়দা কী? তারা বরং দুই হাত দুই পাশে ছড়িয়ে দৌড়ে পাখি হয়ে উড়ে যাওয়ার চেষ্টায় মগ্ন। তবে তীর থেকে বেশ তফাতে বলে ঢেউয়ের ভয় নেই। বড়রা তপ্ত বালুতে পা ছড়িয়ে বসেছি। পাখি হয়ে আমাদের কাজ নেই। হাড়গুলো বুড়ো হয়ে যাচ্ছে, জিরাতে পারলে বাঁচি।

ছোট্ট একটা নোটিশ বোর্ড চোখে পড়ল এক কোনায়। কৌতূহলী হয়ে উঠে গেলাম। বালুরহস্য বোঝা গেল এতক্ষণে। আগ্নেয়গিরির জমাট বাঁধা লাভা আর ভেঙে গড়িয়ে পড়া পাথরের কুচি জমে জমে এই সৈকতের সৃষ্টি। তা–ও ভালো, জানা গেছে। নইলে ভূতের জায়গা বলে মনে হচ্ছিল।

তপ্ত নিকষ বালুকাবেলা। ছবি: লেখিকা
তপ্ত নিকষ বালুকাবেলা। ছবি: লেখিকা

প্রবাসী হওয়ার প্যারা আছে। পড়াশোনা কী চাকরি, সবখানেই এক শর ওপর এক শ দশ ভাগ ঢেলে দিতে হয় নিজেকে প্রমাণের চেষ্টায়। তাতে জীবনের রস কিছুটা হলেও শুকিয়ে আসে। আজকে অনেকদিন পর শুকিয়ে আসা প্রাণটাকে সাগরতীরে বসে ইচ্ছামতো ভিজিয়ে নিলাম।

ডুবন্ত সূর্য পুরো বিকেলটা গিলে খেয়ে ঢেকুর তুলবে তুলবে করছে। আমাদেরও আমোদ একেবারে কম হয়নি। আরাম করে হাড় জিরিয়ে আর লাল-কমলা কতগুলো আইসক্রিম খেয়ে নবাবি কায়দায় সময় পার। তারপর জবজবে আঠালো হাতের তালুতে বাচ্চাগুলোকে আটকে নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।

এখানকার হোটেলগুলোও যেমন। যাব্বাবাহ! কাচতোলা লিমুজিন গাড়ি ঢুকছে আর বেরোচ্ছে কেবল। উঁচু দালানগুলোর গায়ে পাঁচতারা যেন একদম ছিল ছাপ্পড় মারা। তেমনই একটা পাঁচিলঘেরা ঝাঁ–চকচকে বড়লোকি হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আধা ঘণ্টা লাগিয়ে অনেক ফোন খরচের পর আরেকটা লক্কড়ঝক্কড় হলুদ ট্যাক্সি জোটাতে পারলাম। তারপর ‘এই সব দামি হোটেল আসলে ভালো না, লোকে কেন যে শুধু শুধু পয়সা জলে ফেলতে আসে’ ইত্যাদি তুচ্ছতাচ্ছিল্য কথাবার্তায় নিজেদের দৈন্যতা কোনো রকম ঢাকাঢুকি দিয়ে ফিরে চললাম আমাদের দুই কি তিন তারকা সস্তা হোটেলের ডেরায়।

‘কাঁচা পেঁপে’ রেস্তোরাঁর আধকাঁচা, কিন্তু সুস্বাদু সি ফুড। ছবি: আদিবা আমাথ
‘কাঁচা পেঁপে’ রেস্তোরাঁর আধকাঁচা, কিন্তু সুস্বাদু সি ফুড। ছবি: আদিবা আমাথ

সস্তা হোটেলের পেটের ভেতর রেস্তোরাঁ নেই। তবে যে যার ঘরে রেঁধে খাবার ব্যবস্থা আছে। ক্লান্তিটা বড্ড বেশি, নইলে সে চেষ্টা করে দেখা যেত। ঠিক করলাম, সবচেয়ে কাছের রেস্তোরাঁয় গিয়ে হামলে পড়ব। টেবিল-চেয়ার পর্যন্ত কামড়ে খেয়ে রেখে আসব। এক রকম একটা জ্বালাও-পোড়াও ধরনের খিদে নিয়ে বেরোলাম আবার। আমাদের হতাশ করে দিয়ে সব মিলিয়ে গোটা চারেক রেস্তোরাঁ পাওয়া গেল। লোকে গিজগিজ। তিল ধারণের জায়গা নেই।

ইতস্তত করছি কী করব, এমন সময়ে কোনের দিকে পুরোনো চেহারার রেস্তোরাঁ চোখে পড়ল। ভেতরটা অন্ধকার, ভিড় কেমন বোঝার উপায় নেই। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। নামফলকটা বলিহারি ঠেকল। কাসা পেপে (Casa Pepe)। অত সাধের স্প্যানিশ নামটাকে আমরা আমাদের সুবিধামতো কাঁচা পেঁপে বানিয়ে নিলাম। পেঁপের দেখা না মিললেও সেখানে আধকাঁচা সি ফুডের দেখা মিলল। গোলমরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে আর অলিভ অয়েলে চুবিয়ে সেগুলোকে মুখে পুরে কচরমচর চিবিয়ে ঘোরাঘুরির ইতি টানলাম সেদিনের মতো। তবে তার ফাঁকে পরের দিনের ছক এঁটে নিতে ভুললাম না। চলবে...।

আরও পড়ুন:
টেনেরিফের বতুতা বাহিনী-১
লেখক: গবেষক, ইনস্টিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি