এক ছাতার আড়ালে আধাআধি ভেজা

বর্ষা এলেই মনে পড়ে যায় ১৯৯৯ সালে ‘দাহেক’ সিনেমার কথা। তুমুল বৃষ্টিতে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে একে–অপরের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন সোনালি বেন্দ্রে আর অক্ষয় খান্না। ট্রেনে, বাসে, অটোয় চেপে শেষ পর্যন্ত একে অন্যের কাছে পৌঁছান। কিন্তু বর্ষায় তুমুল আবেগ আর জলের ফোঁটা যখন মাখামাখি হচ্ছে, তখন চোখে লেগে থাকে সোনালির লম্বা চুল ঝাঁকিয়ে বৃষ্টি অতিক্রম করার চেষ্টাটা। একটা সময় আমরা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এভাবেই চুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ওই গানই গুনগুন করে গাইতাম, ‘এক মহব্বত কা দিওয়ানা ঢুন্ডতা সা ফিরে, কোই চাহত কা নজরানা দিলরুবাকে লিয়ে’।

আমাদের স্বপ্নের দৃশ্যকল্পের সেই বলিউডি নায়িকা সোনালি বেন্দ্রেও ক্যানাসারের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে চুল কেটে ফেললেন। আসলে জীবনে বাস্তবের সঙ্গে সংগ্রাম করতে গিয়ে কত কিছু ছেঁটে ফেলতে হয়। কৈশোরে বা যৌবনে বর্ষা নিয়ে যে মন খারাপ করা রোমান্টিকতা ছিল, তা কি আর আজকের বাজারে অবশিষ্ট আছে?

একটা সময় ছিল, যখন বর্ষা মানেই জল–থই থই। সেই জলে লাফালাফি, দাপাদাপি। যখন স্কুলে পড়তাম, তখন এর মজার ভাগ নিতে পারতাম। বর্ধমান শহরের যে স্কুলে পড়েছি, সেখানের পরিবেশে ছিল গাছগাছালি আর পুকুরে পরিবৃত্ত। শহরের একটি বাইরের দিকে হওয়ায় সেখানে গ্রাম্য পরিবেশের অনেকখানি উপলব্ধি করতে পারতাম। স্কুলের হেডমাস্টার মশাই বলতেন, নৈমিষারণ্য। তাই বৃষ্টি নামলে ক্লাসরুমে আর বসে থাকতে ইচ্ছা করত না। পড়াশোনা শিকেয় তুলে ফুটবল নিয়ে নেমে পড়তাম মাঠে। জ্বর, ইনফেকশন, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার তোয়াক্কা না করে চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাপাদাপি। সেখানকার শিক্ষকেরা ছেলেবেলার ওইটুকু দুষ্টুমি করতে দিতেন। জল-কাদায় মাখামাখি হয়ে বাড়ি ফিরতাম। সাদা জামায় লেগে থাকা মাটি তুলতে তুলতে মায়ের বকুনির হাত থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হতো বাবাকে।

তখনো আমরা জানতাম না সিগমুন্ড ফ্রয়েড নামে এক সাহেব এই কাদাজলে বল নিয়ে মাতামাতি করার সঙ্গে জীবনের অবদমিত কামনা এবং বাসনাকে কীভাবে জড়িয়ে দিয়ে গিয়েছেন। আমাদের কাছে তাই বৃষ্টি আর তার পরবর্তী মাঠে নেমে পড়াটা ছিল জীবনের অনাবিল আনন্দ। কিন্তু আমাদের এই মফস্বল শহরেও এখন আর বল নিয়ে দাপাদাপি করাটা ‘ফ্যাশন’ নয়। এখন মোবাইলে ‘টেম্পল রান’, ‘পাবজি’ আর ‘ফ্রি ফায়ার’ রয়েছে। জীবনের অবদমিত কামনা-বাসনার সঙ্গে বর্ষার মাঠে আর ফুটবলের সম্পর্ক এখন খুঁজতে যাওয়া অনেকটাই বৃথা।

তারপর স্কুল পেরিয়ে যখন আমরা কলেজে পা রাখলাম, তখনো কি আমরা কেউ কখনো বৃষ্টিতে বর্ষাতি নিয়ে বেরিয়েছি? কো-এডুকেশনে পড়ার রোমাঞ্চ আর সদ্য গড়ে ওঠা ভালোবাসায় বর্ষা এনে দিত এক অপরিসীম আনন্দ। আসলে এক ছাতার তলায় কিছুটা আড়াল করে আর কিছুটা ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফেরার বা না ফেরার রোমাঞ্চটাই ছিল আলাদা। তত দিনে গুলজারের লেখা আশা ভোসলের সেই গান আমাদের হৃদয়ে, মস্তিষ্কে একদম গেঁথে গিয়েছে। ‘এক অকেলি ছত্রি মে যব আধে আধে ভিগ রয়ে থে, আধে সুখে আধে গিলে, সুখা তো ম্যায় লে আয়ি থি, গিলা মন শায়দ বিস্তরকে পাস পড়া হো, উয়ো ভিজওয়া দো’। অতএব, ছাতার তলায় কারও সঙ্গে অর্ধেক ভিজতে ভিজতে আর অর্ধেক আলাপে ব্যস্ত থাকার স্বপ্ন বুনে যাওয়াই তখন ছিল আমাদের জীবন। এখন ভেজা হোক বা শুকনা, কোনো কিছুই আর ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের কাছে রেখে আসার ঝুঁকি কেউ নিতে চাইবে না। ফেরত পাঠানোর আশা ভুলে যান, সেই স্মৃতিকে ‘সোশ্যাল মিডিয়া’য় তুলে দিয়ে দুঃস্মৃতিতে পরিণত করার উদাহরণই যে চারপাশে অনেক বেশি। আজকের ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক আমাদের অতখানি নিশ্চিন্ত থাকার, বৃষ্টিস্নাত দিনের স্মৃতি রোমান্থন করে নিভৃতে হাঁটার ‘ইজাজত’ দেয় না।

এই বদলে যাওয়া বর্ষা এখন আমাদের জীবনে তাহলে কী রকম? শহরে বর্ষার নদীর তীরে গিয়ে বসার লোক এখন অমিল। হঠাৎ করে বাসে উঠে শান্তিনিকেতন যাওয়ার কথা ভাবার লোকও হয়তো মিলবে না। এখনকার নবীন প্রজন্ম অনেক স্বচ্ছন্দ বর্ষায় ওয়াটার থিম পার্কে পার্টি করতে যেতে। এখন বর্ষায় মোটরবাইক নিয়ে হাইওয়ে ধরে গতির নেশায় অন্য জনপদের দিকে ধেয়ে যাওয়াটাই দস্তুর। সময় বদলেছে, শহর বদলেছে, বদলে গিয়েছে আমাদের চারপাশের পছন্দ-অপছন্দগুলোও। এখন বর্ষা মানে অন্য অনুষঙ্গ, অন্য নেশা।

তারপর যখন কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছালাম, দেখলাম গোলাপবাগের দেখা বর্ষা অন্য সবকিছুর থেকে আলাদা। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ক্যাম্পাস যেহেতু বধর্মান মহারাজাদের বাগান ছিল, তাই আমাদের কাছে বর্ষা মানেই সবুজের সমাহার। যাঁরা কখনো বর্ষায় গোলাপবাগ বা তারাবাগে থেকেছেন, তাঁরা জানেন এই বিশ্ববিদ্যলয়ে বর্ষা কাটানোর মাহাত্ম্যটা কী! তাই আজও স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছে বর্ষায় গোলাপবাগে কাটানোর টুকরা টুকরা ‘মন্তাজ’। এক ঝাপটা বৃষ্টির পরে গোলাপবাগের গাছাগাছালির, চারপাশের যে ‘মেকওভার’ হয়, তা হয়তো বলিউডের আচ্ছা আচ্ছা ‘সেট ডিজাইনার’দের চোখও ধাঁধিয়ে দিতে পারে। অনেক কিছু বদলে গেলেও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যলয়ের এই সবুজ, আরও সবুজ চেহারাটা গত কয়েক দশকে এতটুকু বদলায়নি। বর্ষা সেই সবুজ, রোমান্টিক পেলবতাকে আজও বাড়িয়ে দেয়।

এখন করোনাকালে যদিও গৃহবন্দী বর্ষাযাপনে ভরসা বলতে ব্যালকনি অথবা জানালা থেকে বৃষ্টি দেখা। আরও একটি উপায় অবশ্যই আছে, যদিও তাতে বৃষ্টির ছাঁট মাখার সুযোগ নেই। সেটি হলো সোশ্যাল মিডিয়ার বর্ষাযাপন। সত্যি বলতে কী, এই বর্ষায় আমার কোনো উচ্ছ্বাস নেই। বন্দিজীবন, বর্ষার স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

মুক্তির জন্য ছটফট করতে করতে কবিতার কাছে, গানের কাছে নতজানু হয়ে বসি। খুঁজে পাই কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দর সেই আশ্চর্য চরণ, ‘মেঘৈর্মেদুরম্বরং বনভূবশ্যামাস্তমালদ্রুমৈঃ’। সংস্কৃত এই শ্লোকে বর্ষার চিরচেনা ছবি, মেঘে ঢাকা কোমল আকাশ আর শ্যামশোভাময় বন তমালের কী লাবাণ্যভরা রূপ! কতকাল আগে কেটে গেছে জয়দেবের কাল, আজও সেই নির্জন বর্ষার ছবিটা তেমনই জীবন্ত! বহু বছরের ওপার থেকে আজও বয়ে আনে সে যুগের সেই মেঘমেদুর দিন, বর্ষাস্নাত তরুরাজির পেলবতা। আজকের ঘন মেঘে ঢাকা দিনটির সঙ্গে বর্তমান আর অতীত মিলেমিশে একাকার হয়ে বন্দিজীবনে টাটকা বাতাস বয়ে আনে।