আমার না দেখা পল্লবের আম্মু

আমি তোমাকে দেখিনি। কখনো দেখব না। কিন্তু কেন যেন মনে মনে দেখেছি পল্লবের চোখ দিয়ে। মিষ্টি মায়া ভরা মুখ, চোখ দুটোতে দুষ্টুমি ভরা হাসি। কিশোরী তুমি ভালোবেসে বিয়ে করেছ ওর বাবাকে। গোপালগঞ্জ থেকে চলে এসেছ খুলনা। ভৈরব নদীর কাছে উত্তাল জোছনা দেখে মুগ্ধ হয়ে থেকে গেলে। জোছনাময়ী, ছোট্ট গোলপাতার নীড়ে শুরু হয়েছিল তোমার সংসার। সুদূর হাওয়াই দ্বীপের কটেজ গুলির মতো।

তোমার গোছানো ছোট্ট কুটির দেখে মুগ্ধ হতো সবাই। চাঁদের আলোতে বসত সংগীত সন্ধ্যা। কিন্নর কন্ঠে প্রকৃতি হয়ে উঠত অনেক বেশি সুন্দর। ‘মম চিত্তে, নিতে নিত্তে কে যে নাচে তা তা থই থই, তা তা থই থই, তা তা থই’ বা ‘মোমের ও পুতুল, মমীর দেশের মেয়ে নেচে যায়’। তোমার কলকাতার ওস্তাদরা কত না খুশি হতেন তাঁদের ছাত্রির এ গান শুনে। বা উর্বশীর মতো রূপ নিয়ে ভরাট গলায় আবৃতি করতে তুমি। মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত। ধীরে ধীরে পল্লবের আব্বু বাড়িয়ে তুললেন সম্পদ। আর তুমি গড়ে তুললে বিশাল এক লাইব্রেরি। এর মধ্যে কোল আলো করে এলো রাজকন্যা দু’জন। তারপর পল্লব। ও যে কি দুরন্ত। অপূর্ব গান আর আবৃত্তির গলা নিয়ে সে পৃথিবীতে এসেছে। গাইবে নিজের ইচ্ছে মতো। এত ভালো ছাত্র কিন্তু পড়বে পরীক্ষার আগের দিন শুধু।

কলেজে উঠে পল্লব কিনল মোটর সাইকেল। শুরু করল রাজনীতি। তুমি কিছু বললে না। সবকিছু থাকল তার মঙ্গল কামনা মনে মনে সব সময়। ভয় হতো কিন্তু ওর মায়াবী চোখের কাছে আর মায়ের ভালোবাসার কাছে শাসন করার ইচ্ছেটা উড়ে গিয়েছিল। তারপর জানলে তুমি আমার কথা। হ্যাঁ আমি মম। পল্লবের প্রথম প্রেম। ওর মাতাল ভালোবাসা। পল্লব তোমাকে বলত রোজ কেমন করে প্রতিটা ক্ষন সে আমার সাথে থাকত কলেজে। ও আর কাওকে আমার আশেপাশে ঘেঁসতে দিত না। আমার একটু ভয় ভয় লাগত ওকে। যখন তখন ভালোবাসি বলত। কবিতা আর ফুল দিত, এক গাদা বন্ধু নিয়ে ঘুরত। আমার ছেলে বন্ধুরা ভয়ে কেউ ক্যাম্পাসে আমার সাথে কথা বলত না। ও ঝাড়ি দিত। একদিন ওর বন্ধু এসে ক্লাসে বলে বসল পল্লবের সাথে কথা বল বাইরে এসে। না করতেই বলে বসল ‘তোমার কি গায়ের চামড়া ছিলে যাবে একটু কথা বললে?’ বাইরে গিয়ে ওকে বললাম, ‘আপনি একটু কম বিরক্ত করলে ভালো হয় না’?

সেদিনের পর থেকেও আর কখনও সরাসরি কথা বলেনি। ভালোবাসা নিয়ে ছায়া হয়ে থেকেছে। জানতাম না মা তুমি সব সব জানতে। ও আমাকে রাজহংসী ডাকত। কতভাবে ভালোবাসবে সব তোমাকে জানাত। তুমি খুব হাসতে, বলতে ‘ও যে কি সুখী হবে তোকে বিয়ে করে।’ পল্লব বলত ও নাকি মিশর থেকে এক ঝাঁক রাজহাঁস এনে দেবে আমাকে। আমি হাঁটব আর রাজহাঁসগুলো আমার সাথে হাঁটবে। বাসার সামনে লোকের পাশে আমি বসব। ওরা জলকেলি করবে। আমার জন্য একটা কলেজ করে দিবে তুমি। আমি সেখানে পড়াব। ওর মোটর সাইকেলের পিছনে চড়ে আমি যদি কলেজ থেকে বাসায় যাই, যদি কস্ট হয় আমার? শুনে হেসে হেসে বলতে ‘ওর জন্য গাড়ী কিনে দেব বাবা, চিন্তা করিস না।’

ওর এত ক্ষমতা থাকার পরও মন জয় করতে চেয়েছিল সে আমার। জোর করে তুলে এনে ভালোবাসা আদায় করতে চায়নি। কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গিয়েছিল। পল্লব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী তরুণ নেতা। সাংবাদিক হিসাবে নিজেকে গড়তে ব্যস্ত। আমাকে ঘরে তুলবে সে। ও যোগ্য হবার আগেই আমি চলে এসেছি অনেক দূরে। ওকে একটু একটু ভয় পেতাম। যদি জোর খাটায়? আসলে প্রতিভাময় প্রেমিক তরুণ ভালোবাসার কাছে অনেক দুর্বল ছিল। ও আমাকে ফুল হিসাবে দেখত। ছিঁড়ে নস্ট করতে চায়নি। বিকশিত হতে দিয়েছে। অনেক দিন পর বন্ধু হয়েছি আমরা। ওর কাছে তোমার গল্প শুনে একটু আদর পেতে ইচ্ছে করেছে। তুমি তো নেই। চলে গেছ আকাশের ঠিকানায়। আমার ভালোবাসা জেন। তোমার আদরের পল্লব অনেক ভালো আছে ওর বউ বাচ্চা নিয়ে। ও হ্যাঁ, আমাকেও ভালো রেখেছে বন্ধু।