মিসির আলির মীমাংসিত রহস্য, লুৎফুর ভাইয়ের চলে যাওয়া

লেখক
লেখক

মিসির আলি সাহেব অতিথি টিচার হিসেবে তিন মাসের জন্য এসেছেন সানদিয়াগো শহরে। ছাত্রী জয়ার জোরাজুরিতে তার বাসাতেই উঠতে হয়েছে তাঁকে। খুব একটা গৃহী মানুষ নন তিনি। কিন্তু ছাত্রীর আপ্যায়ন মন্দ লাগছে না খুব একটা।

প্রথম দিন লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের এয়ারপোর্ট থেকে জয়া তাঁকে পিক করে পাহাড়ের মাঝে এবং সমুদ্রের ধার ঘেঁষে ড্রাইভ করে এনেছে। পুরোটা পাহাড় ফুলে ফুলে সাজানো। আড়াই ঘণ্টার পথ ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন জানেন না। পাহাড়ের মাথায় বাড়িতে ফিরে ড্রাইভ ওয়েতে পার্ক করে জয়া তাঁকে ডেকে তুলল, ‘স্যার বাসায় পৌঁছে গেছি আমরা’ । বাসায় ঢোকার মুখে এক গুচ্ছ নীল গোলাপকে যেন সাজিয়ে গেছে নীল ফুলদানিতে। দেখে জয়া একটু বিব্রত হলো। বাসায় ঢুকে খেয়ে সাওয়ার নিয়ে মিসির আলি সাহেব বসে গেলেন স্লাইডগুলো আরেকটু গুছিয়ে নিতে অতিথি রুমে।

পরদিন জয়া তাঁকে নামিয়ে দিয়ে গেল ইউ সি এস ডি ক্যাম্পাসে। একটু হাঁটতে হলেও ফুল, পাখি আর চঞ্চল ছাত্রদের কলকাকলিতে খুঁজে খুঁজে ক্লাসরুম বের করে নিতে বেশ লাগল তাঁর। ক্লাস শেষে ক্যাফেটেরিয়ায় খেতে গেলেন তিনি। ফ্যাকাল্টির অনেকেই এসেছেন তাঁকে ঘুরে দেখাতে ক্যাম্পাস। কিন্তু বেষ্ট সেলার বই ‘হিডেন লাভ অব ম্যানকাইন্ড’ যা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির পাঠ্য তার লেখককে কাছে পেয়ে ছাড়তেই চাইছে না যেন তাঁরা। বিকেলে জয়া নিয়ে এল বাসায়। তাঁর মতো জয়ার ও আর্লি ডিনার করা অভ্যাস। ডিনারের পর ব্যাক ইয়ার্ডে বসে জয়া মনে হোল নিজের কিছু কথা শেয়ার করতে চায়। মিসির আলি বুঝলেন ভালোবাসা সংক্রান্ত কিছু। কন্যা সম জয়ার দ্বিধা মনে কি এক স্নেহের জন্ম দিল তাঁর।

এরপরের মাস তিনেক চলে গেল ঝড়ের বেগে। ক্লাস আর তার ফাঁকে ফাঁকে পাহাড় আর সমুদ্রের শহর সান দিয়াগো। বেড়ালেন মন ভরে, জয়া দেশকে অনেক মিস করে জানলেন। সাফল্য আর তার সঙ্গে একাকিত্ব তো আছেই। দেশে জমিতে বসা জয়ার বাবা-মা আমেরিকা যাবেন না বলে জানিয়েছেন তাকে। মাঝে মাঝে এক গুচ্ছ নীল গোলাপকে যেন রেখে যেত পোর্চে, সঙ্গে ছোট্ট চিরকুট ‘রাজকন্যা তোমার জন্য’।

দেশে ফেরার আগের দিন জয়া চোখ মুছে বলল, ‘স্যার আর কটা দিন থেকে গেলে হতো না?’ স্মিত হেসে মিসির আলি সাহেব বললেন, মা আর একা থাকতে হবে না তোমাকে। নীল গোলাপ তার সঙ্গে এরামিস ডেভিনের মিষ্টি গন্ধের রহস্য ভেদ করেছি আমি। তোমার অফিসের বস জামিল, সে বোধ হয় শুনেছিল তোমার বিয়ে বিদ্বেষ জাতীয় কথা। তাই নীল গোলাপ যা তোমার পৃথিবীর সবচেয়ে পছন্দ দিয়ে যাচ্ছে নীরবে গত ছয় মাস। অপেক্ষায় আছে পাবে না জেনেও। সেদিন তোমার অফিসে গিয়েছিলাম না? ওর তাকানো আর পারফিউম সব ফাঁস করেছে সব। মা প্রকৃত ভালোবাসা আসে হঠাৎ হঠাৎ, মুঠো ভরে নিও।’

বিমানবন্দরে নেমে টেক্সট পেলেন মিসির আলি স্যার নীল গোলাপগুলো আজ হৃদয়ে স্থান পেয়েছে, সঙ্গে জামিল ও ।

মিসির আলির স্রষ্টা হ‌ুমায়ূন আহমেদের ৮ ম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হবে। শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি। আর কোনো নতুন বই মেলায় কখনো আসবে না, আসবে না কোনো নতুন মিসির আলির গদ্য। আকাশের ঠিকানায় ভালো থাকুন স্যার।

সন্দেশ প্রকাশনীর কর্ণধার লুৎফুর রহমান চৌধুরি চলে গেছেন আকাশের ঠিকানায় গত মাসেই। অসম্ভব প্রতিভাবান এ মহারথীর সঙ্গে পরিচয় খুব অল্প দিনের। একজন নব্য লেখকের বই প্রকাশে যে প্রফেশানালিজম দেখিয়েছেন, আমার অনেক কিছু শেখার ছিল ওনার কাছে, দুর্ভাগ্য হলো না। ভাই, ভালো থাকুন বেহেশতের বাগানে ফুল হয়ে।