একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গল্প

মজিদ চাচাকে কদিন ধরেই দেখছি, আমি যখন মোবাইলে ফেসবুক বা ব্রাউজিং করি সে উঁকিঝুঁকি দেয়। ভাবসাব এমন কিছু বলতে চাচ্ছে। আমি তাঁকে চাচা বলে ডাকি। অনেক দিন ধরেই আমাদের কোম্পানিতে আছেন। আমি যোগ দেওয়ারও আগে থেকে। এই সাইটটা চালুর পর আমার সঙ্গে পরিচয়। তাঁর ইটের গাঁথুনি অনেক চমৎকার।

আজ যখন আমার মোবাইলে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল, বলে বসলাম।

-কী দেখছেন চাচা? কিছু বলবেন?
-বাবা আপনে কী ফেচবুক চালান?
আমি হেসে জবাব দিলাম, জি চাচা, আপনি শিখতে চান নাকি?

-আরে না, আমার বোতাম আলা মোবাইল চালাইতে খবর অইয়া যায়। ফেচবুক কেমনে চালামু! তই একখান কথা।
-কী চাচা?
গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে মজিদ চাচা বলেন।
-বাড়িতে ফোন করলে আপনের চাচি কয়, পোলা নাকি হারা ক্ষণ ফেচবুক চালায়। পড়ালেহায় খেয়াল কম। আমার পোলারে আপনের ফেচবুকে পাওয়া যাবে?

চাচার ছেলের নাম লিখে সার্চ দিলাম, আমজাদ হোসেন নামে অনেককে পেলেও চাচার ছেলে নাই সেখানে।

মজিদ চাচা ততক্ষণে ছেলেকে ফোন করে বসেছেন। ফেচবুক কী দি চালাস তোর ভাইয়া রে ক দেহি, বলেই মোবাইল টা আমাকে ধরিয়ে দিলেন।
-ভাইয়া স্লামালাইকুম। কেমন আছেন?

চাচার ছেলে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। স্মার্টই মনে হলো।
-কী আমজাদ তোমাকে খুঁজে পাচ্ছি না। কী নাম ফেসবুকে তোমার? চাচা দেখতে চাচ্ছে একটু।
-জি ভাইয়া আমজাদ খাঁন নিবিড় লিখে খোঁজেন, পাবেন।

খুঁজতেই পেয়ে গেলাম। চাচাকে বললাম সে নাম দিয়েছে আমজাদ খাঁন নিবিড়। তাই প্রথমে পাওয়া যায়নি। এই যে এটা হচ্ছে আপনার ছেলের ফেসবুক।

-কী কন! ওর নিবিড় নাম তো আমরা রাখি নাই। আর আমরা খাঁন বংশও না।
-আরে চাচা, ফেসবুকে চাঁন মিয়ারা খাঁন মিয়া হয়ে যায়, মর্জিনা হয়ে যায় মেরিনা।
-আমার পোলার ফেচবুকে কী আছে বাবা?

শেষ স্ট্যাটাস লিখছে সে ‘উফফ! এত্তো গরম! বাসায় থাকা কষ্টকর, মনে হচ্ছে কড়াই তে ফ্রাই হচ্ছি, পাপাকে বলতে হবে এসি কিনে দিতে।’

চাচাকে কথাটা বললাম, চাচা উল্টো আমাকে প্রশ্ন করে বসল- পাপা কে? এই নামে তো কেউ নেই আমাগো জানা হুনায়।

-পাপা মানে আপনি, আজকালকার পোলাপাইন বাবাকে পাপা ডাকে।
-কিন্তু ফোনে তো সে আমাকে বাপজান কয়!
-চাচা, ফেসবুক আর বাস্তব এক না।

সেদিনের মতো আলাপচারিতা শেষ। পরদিন যখন কাজে আসেন, দুপুরের খাবারের বিরতির সময় গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে চাচা সোজা আমার কাছে আসলেন।
-হ বাবা দেশে অনেক গরম, আপনের চাচির সঙ্গে কথা হইছে।
-জি চাচা, তবে এ দেশের চেয়ে অনেক কম।
-আমারে একটা দরখাস্ত লেইখা দেবেন বাবা, তিন হাজার দিরহাম অ্যাডভান্স লইতে চাই। চার ঘণ্টা ওভার টাইম করে শোধ করে দিমু।
-কেন চাচা, হঠাৎ এত টাকা?
-বাসায় এসি লাগাইতে কইছি। পোলামাইয়া কষ্ট করতেছে গরমে।

লিখে দিলাম আবেদন, সঙ্গে অ্যাকাউন্টস-এ একটু সুপারিশও করলাম। এক বছরের বেশি লেগে যাবে তাঁর এ টাকা শোধ করতে।

রাতে বাসায় শুয়ে শুয়ে যখন ফেসবুকে ঢু মারছিলাম। চাচার ছেলের প্রোফাইল ঘাটতে ইচ্ছা হলো। গিয়ে দেখলাম স্ট্যাটাস দিয়েছে সে।

‘ফিলিং কুল, এসির বাতাস তো নয় যেন বাঁশির সুর! আমার ঘুম আসে ক্যারে এত জলদি। থ্যাংকস পাপা.....’

সকালে সাইটে গিয়ে চাচাকে বলতেই চাচার চোখেমুখে সে কি তৃপ্তি। মনে হচ্ছে সুখের ঘুম তিনিই ঘুমিয়েছেন সারা রাত।

সাইটের নরমাল ওয়ার্কিং আওয়ার শেষ। আমি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, শ্রমিকদের নিতে আসা মিনিবাস টি ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছেড়েও দিয়েছে, মজিদ চাচাসহ আরও কজন ওপর থেকে দাঁড়িয়ে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে। তাদের যাওয়ার উপায় নেই, ওভার টাইম করতে হবে তাঁদের। অনেক দেনা যে জমে গেছে .....

*লেখক: কর্মকর্তা, জুলেখা হাসপাতাল, দুবাই