অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব কি বিশ্বাসঘাতকতার ছাড়পত্র!

সেই আদিমকাল থেকেই মানুষ যাযাবর। বিভিন্ন কারণে তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে। এই স্বভাবটা হয়তো-বা তারা জিনগতভাবেই পেয়ে এসেছে। সময়ের ধারাবাহিকতায় সভ্যতার অনেক উন্নতি হয়েছে। মানুষের জীবনে এসেছে অনেক মৌলিক পরিবর্তন। মানুষের সমাজব্যবস্থা ধীরে ধীরে সমাজতন্ত্র থেকে পুঁজিবাদের কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করেছে। সমাজে তৈরি হয়েছে শ্রেণি ব্যবধান। দেশে দেশে তৈরি হয়েছে জীবনযাত্রার ব্যবধান। প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের জীবনে এসেছে অভাবনীয় গতি। সেই গতির সঙ্গে তাল মেলাতে মানুষ হাঁপিয়ে উঠলেও থেমে যাওয়ার অবকাশ নেই। কারণ থেমে গেলেই অন্যের চেয়ে পিছিয়ে পড়বে। দিনে দিনে মানুষের জীবনযাত্রা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। নিজের, নিজের পরিবারের, সমাজের, জেলার, দেশের বৃহত্তর অর্থে মহাদেশের স্বার্থ সবাই আগে দেখে এখন। সামগ্রিকভাবে এখন কেউ আর সমগ্র পৃথিবীর ভালো চিন্তা করেন না। হাতে গোনা যে দু-একজন এগুলো নিয়ে ভাবেন বা কথা বলেন, তাঁদের দেওয়া হয় পাগল আখ্যা। 

দিনে দিনে পৃথিবীর অবস্থা এমন একটা পর্যায়ে গেছে যে এখন একটা দেশ তার নিজের নাগরিকদের অধিকারের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য অন্য আরেকটা দেশের মানুষদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিতে পিছপা হয় না। তাই দেশে দেশে যুদ্ধ লেগেই আছে। আর বিশ্বের অস্ত্রের মজুত এমন পরিমাণে বেড়ে গেছে যে সেই অস্ত্রগুলো ব্যবহার করার জন্য হলেও যুদ্ধ অবধারিত হয়ে দেখা দিয়েছে। সেটা করতে গিয়ে বিশ্ব মানবতার কতখানি ক্ষতি হচ্ছে, সেটা থোড়াই কেয়ার করছে সবাই। একটা দেশের মধ্যে যেমন সরকারব্যবস্থা থেকে শুরু করে সবকিছুই ধনীদের স্বার্থের সুরক্ষা দিতে ব্যস্ত, ঠিক তেমনি বৈশ্বিকভাবেও সব ধরনের সংগঠন ধনী দেশগুলোর স্বার্থ সুরক্ষা দিতে গিয়ে তাদের ক্রীড়নক হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর মানুষগুলো উন্নত জীবনের আশায় দেশান্তরী হচ্ছে। তবে এখানে একটা কথা বলে নেওয়া জরুরি সেটা হচ্ছে, এই প্রবণতা শিক্ষিত মানুষদের মধ্যেই প্রকট। তাঁরা যেহেতু জানেন বিশ্বের কোন দেশে কী বাড়তি সুবিধা আছে, তাই তাঁরা সেগুলো লুফে নেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন। অবশ্য অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত মানুষেরাও দেশান্তরি হন, তবে সেটা শুধুই জীবিকার তাগিদে। তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করে সমুদয় অর্থ নিজ দেশেই প্রেরণ করে থাকেন।

আমার জন্ম বাংলাদেশের অজগাঁয়ে। পদ্মা নদীর চর এলাকা চর ভবানীপুরে জন্ম এবং শৈশবের বেড়ে ওঠা যেখানে, সভ্যতার ছোঁয়া বলতে ছিল ব্যাটারিচালিত রেডিও আর টর্চলাইট। খেলাধুলার সব উপকরণ আমরা প্রকৃতি থেকেই সংগ্রহ করতাম। নদীর পাড়ে বিভিন্ন ফসলের খেত পাহারা দেওয়ার সময় নদীর অপর পাড়ের কোনো টিনের চালা রোদে ঝিলিক দিয়ে উঠলে আমরা সেটা নিয়ে নানা কাল্পনিক গল্প জুড়ে দিতাম। আর দেখা যেত কুষ্টিয়া শহরের ওয়্যারলেস টাওয়ার। খুবই অবাক হতাম আমরা, এত বড় একটা জিনিস কীভাবে বানিয়েছে সেটা ভেবে। আর রোজার সময় ইফতারের রেফারেন্স ছিল কুষ্টিয়া শহরের রেনউইক কারখানার টানা হুইসেল। এই হুইসেলের শব্দ নদীর অপর পারে থেকেও আমরা শুনতে পেতাম। বাড়ির পাশেই ছিল নদীর ঘাট। সেই ঘাট দিয়ে পারাপার হতো নানান ধরনের মানুষ। কিছু মানুষকে দেখতাম খেয়া পার হয়ে নদীর পাড়ে অপেক্ষারত পালকিতে চড়ে যাত্রা করছেন দূরে কোথাও। বড়রা বলতেন, তাঁরা যাচ্ছেন পাবনায় ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের আশ্রমে।

আমাদের গ্রামের অবস্থানটা ছিল খুবই অদ্ভুত জায়গায়। প্রশাসনিকভাবে আমাদের গ্রামটা ছিল কুষ্টিয়া সদর মৌজার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু কুষ্টিয়া থেকে যেতে দিন শেষ হয়ে যেত। কুষ্টিয়া শহর থেকে গড়াই নদ পার হওয়ার পর হরিপুর। হরিপুরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়ার পর পড়ত পদ্মা নদী। পদ্মা নদীর অপর পারে ছিল আমাদের গ্রাম। পদ্মা নদী বর্ষার সময় রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। তখন দিনে একবার শুধু খেয়া পার করা হয় অনেক ঝুঁকি নিয়ে। তখনো ইঞ্জিনের নৌকার চল হয়নি। দাঁড় আর পালের ওপর ভরসা করে যাত্রা করতে হতো। আর বছরের অন্যান্য সময় পুরো পদ্মা নদীতে বালির চর ধু ধু করে। সেই বালির চর হেঁটে পার হতে গিয়ে আমাদের পায়ের তলা পুড়ে পাতিলের তলার মতো কালো হয়ে যেত। অন্যদিকে, সড়কপথে আমরা সহজেই পাবনায় যেতে পারতাম, তাই প্রশাসনিকভাবে সব কর্মকাণ্ড কুষ্টিয়া মৌজার অন্তর্ভুক্ত হলেও সব কর্মকাণ্ড ছিল পাবনাকেন্দ্রিক।

এমন একটা জায়গায় শৈশবের রংধনু রঙিন দিনগুলো পার করার প্রভাব পড়ে আমার পুরো জীবনবোধে। গ্রামের মানুষদের সরলতা এবং আতিথেয়তা আমাকে সব সময়ই মুগ্ধ করে। এরপর একসময় জীবনে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে চাকরিজীবনে প্রবেশ করলাম কিন্তু সেই গ্রামীণ আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে সৎ জীবন এবং জীবিকার জন্য বেসরকারি চাকরিতে যোগদান। এরপর দেখলাম বেসরকারি চাকরি হচ্ছে গ্রামের সেই শিয়ালের গল্প। শিয়াল সুখেশান্তিতে ছিল আকাশে। জমিনে উলুর ধবধবে সাদা ফুলের খেত দেখে সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করে তাদের যেন পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর সৃষ্টিকর্তা তাদের ইচ্ছা পূরণ করেন কিন্তু শর্ত দেন, আর তারা আকাশে ফিরে আসতে পারবে না। পৃথিবীতে এসে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে আকুতি জানায় তাঁর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য কিন্তু সৃষ্টিকর্তা রাজি হন না। তারপর থেকে তারা রাতের বেলায় দল বেঁধে আকাশের দিকে মুখ করে হুক্কা হুয়া ডেকে চলেছে। বেসরকারি চাকরিও অনেকটা সে রকম। জীবন থেকে সমস্ত শক্তি শুষে নেবে কিন্তু সামান্য ভুল হলেই দেবে ছুড়ে ফেলে। এটা বুঝতে বুঝতে আমার ১০ বছর লেগে যায়। যখন বুঝতে পারলাম তখন আবার বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগদান করলাম অনেকটা সেই জল ঘোলা করে খাওয়ার মতো।

সরকারি চাকরি করতে গিয়ে সেই প্রথম বাংলাদেশের সরকারব্যবস্থা এবং আমলাতন্ত্রের সংস্পর্শে এলাম। এর আগেই অবশ্য বেসরকারি চাকরির সূত্রে পুরো বাংলাদেশ ঘুরে দেখা হয়ে গেছে। দেশের প্রকৃতি অতি মনোরম। প্রকৃতি তার সৌন্দর্যের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে বাংলাদেশকে সাজিয়েছে। আর তার সঙ্গে আছে সবচেয়ে বড় সম্পদ বাংলাদেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, যাঁদের দুবেলা অন্ন সংস্থান করতেই দিন শেষ হয়ে যায়। অন্ন সংস্থান না হলেও তাঁদের কোনো আক্ষেপ নেই। তাঁরা বলেন, সৃষ্টিকর্তা কপালে রাখেন নাই তাই পান নাই বলে নির্ভাবনায় ঘুমিয়ে পড়েন। পরের দিন এমনকি পরের বেলা কী খাবেন, সেটা পর্যন্ত নিয়ে তাঁরা ভাবেন না। আমি শুধু তাঁদের হাড়ভাঙা খাটুনি দেখতাম আর ভাবতাম, কেন তাঁদের ভাগ্যের চাকা ঘোরে না। তখন বুঝলাম, প্রথমত তাঁরা নিজেরা চান না আর দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের সরকারব্যবস্থাও চায় না তাঁদের উন্নতি হোক। কারণ, তাহলে দারিদ্র্য দেখিয়ে বছর বছর যে হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ত্রাণ এবং ঋণ সহায়তা পাওয়া যায়, সেটা বন্ধ হয়ে যাবে আর সেটা বন্ধ হলে ধনীদের আরও ধনী হওয়াও বন্ধ হয়ে যাবে। সরকারি চাকরিতে এসে এই সত্যটা আরও বেশি করে উপলব্ধি করলাম।

যা-ই হোক, দেশের কল্যাণ, দশের কল্যাণ এগুলো আসলেই এখন শুধু আভিধানিক শব্দ। আসল কথা হচ্ছে, নিজে বাঁচলে বাপের নাম। আমরা দেশের পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষা আমাদের পদে পদে স্বার্থপরতার এই শিক্ষাটা দিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য শুধু দেশের দোষ দিয়েই বা কী হবে, পৃথিবীব্যাপীই এখন এটা অপ্রিয় সত্য। তবে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় শ্রেণিবৈষম্যটা খুবই প্রকট। এখানে ধনীরা দিনে দিনে আরও ধনী হচ্ছে আর গরিবেরা দিনে দিনে আরও গরিব হচ্ছে। ধনী-গরিবের একটা ভারসাম্য রাখার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের কিন্তু রাষ্ট্র যেহেতু ধনিক শ্রেণির নিয়ন্ত্রণ করে, তাই গরিবের সামান্যতম স্বার্থও সেখানে প্রাধান্য পায় না। ন্যূনতম মৌলিক অধিকারগুলোর নিশ্চয়তাও রাষ্ট্রযন্ত্র দিতে পারছে না। অবশ্য গরিবদের এগুলো নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই কারণ তারা জানেই না যে তারা অধিকারবঞ্চিত। তারা এটাকে তাদের নিয়তি ধরে নিয়েই বেঁচে থাকে। আর কোনো কিছু না পেলে সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচার দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

উচ্চতর শিক্ষা আমাদের সব সময়ই নিজেদের উচ্চ শ্রেণির মানুষ ভাবতে শেখায়। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা, কথা বলা বা সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপনকে দেখা হয় দুর্বলতা হিসেবে। আর পাশাপাশি বাড়িয়ে দেয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাটাও বহুমুখী। আরও ডিগ্রির উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আরও উঁচু বেতনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আরও নিরাপদ জীবনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সর্বোপরি নিজের বুড়ো বয়সের একটা তেলতেলে ভবিষ্যতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অবশ্য এর সবগুলোকে ঢাকতে আমরা বলি যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা নিরাপদ ভবিষ্যৎই আমাদের লক্ষ্য। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নিজে আমরা যে সিস্টেমে বেড়ে উঠি, বড় হয়ে যাওয়ার পর রাতারাতি সেই সিস্টেমকে দূষিত আখ্যা দিতে ভুল করি না। কিন্তু একটা ব্যাপার আমরা ভুলে যাই সেটা হলো, যে যত বেশি প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে মানুষ হবে, সে তত বেশি কষ্টসহিষ্ণু হবে এবং জীবনে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। দেশের সর্বোচ্চ সুবিধাদি ভোগ করেও আমরা কি এক অলীক অনিশ্চয়তায় ভুগি এবং আরও নিরাপদ ও নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় আমরা দেশান্তরি হয়।

দেশান্তরি হওয়ার পরই আমাদের দেশপ্রেম রাতারাতি শত সহস্রগুণে বেড়ে যায়। তখন দেশের রাজনীতি থেকে শুরু করে সমাজনীতি—সবকিছু নিয়েই চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গরম করে রাখি। বিষয়টা অনেকটা প্রচলিত প্রবাদটার মতো, ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি।’ দেশকে আমরা যদি এতটাই ভালোবাসতাম, তাহলে কেন দেশ ছাড়লাম। এটা আসলে অনেকটা দেশ ছাড়ার ক্ষততে মলম লাগানোর মতো ব্যাপার। নতুন দেশে এসে অনেকেই তাঁদের স্বপ্নের জীবিকা খুঁজে পান না। কিন্তু আর দেশেও ফিরে যেতে পারেন না, কারণ দেশে ফিরে গেলে যে পরিমাণ সমালোচনা শুনতে হবে, তার চেয়ে বিদেশেই কোনোরকম একটা কাজ জুটিয়ে জীবনটা চালিয়ে নেওয়াই শ্রেয়। অন্ততপক্ষে পরবর্তী প্রজন্ম একটা নিরাপদ জীবন পাবে, সেই আশায় বুক বাঁধা। দেশে জীবনের অর্ধেকটা পার করে বিদেশে এসে থিতু হলেও স্মৃতিরা তাড়িয়ে বেড়ায় অহর্নিশি। অবশ্য সবাই যে একই রকমভাবে অনুভব করেন, সেটা বলা যাবে না। বিভিন্নজনের বিদেশে আসার প্রেক্ষিত যেমন ভিন্ন, তেমনি ভাবনাও ভিন্ন।

বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য অবশ্য বিদেশযাত্রা মোটেও খারাপ কিছু নয়। কারণ দেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নির্ভর করে পুরোপুরিভাবে বিদেশে অবস্থান করা বাংলাদেশিদের আয়ের ওপর। আর বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিদেশযাত্রা মোটেও খারাপ কিছু না। কারণ দেশ এখন আর ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বাংলাদেশিরা যেখানেই গেছেন, সেখানেই একটা মিনি বাংলাদেশ তৈরি করে নিয়েছেন। দেশের মানুষের পাশাপাশি বিদেশিরাও সমানতালে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তবে সেখানে শ্রমিক শ্রেণির প্রাধান্য। শিক্ষিত উচ্চাকাঙ্ক্ষী শ্রেণিটা দেশের টাকায় একদিকে যেমন প্রায় বিনা পয়সায় ডিগ্রি অর্জন করেছে, ঠিক তেমনি দেশের সহায়-সম্পত্তিও বিক্রি করে অনেক সময় বিদেশে নিয়ে যায়। অন্যদিকে শ্রমিকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে অর্থ উপার্জন করেন সেটা সর্বতোভাবে সঞ্চয় করে দেশে পাঠানোর চেষ্টা করেন।

যা হোক, দেশ ছাড়ার পর একেকজনের অনুভব একেক রকম। আমার ব্যক্তিগত অনুভব হচ্ছে বিদেশের সবকিছুর মধ্যেই দেশের ছায়া খুঁজে পাই। দেশের গ্রামীণ দুরন্ত শৈশবের আদলে সন্তানদের একটা শৈশব উপহার দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি, যেটা হয়তোবা দেশে থাকলেও সম্ভব করতে পারতাম না। আসলে বিদেশে আপনি যদি সৎ এবং পরিশ্রমী থাকেন, তাহলে জীবনটা মোটামুটি সরলরেখার মতো মসৃণ। দেশে থাকলে এসবের পাশাপাশি আত্মীয়তার জোর, রাজনৈতিক দাপট, এমন আরও হাজারটা বিষয় মোকাবিলা করতে হতো। কিন্তু এখানে সেগুলো বলতে গেলে অনুপস্থিত। আর আমার মতো মানুষদের জন্য একটা নতুন দেশ দেখা এবং জানাও হয়ে যায়। আর অস্ট্রেলিয়ার বাড়তি সুবিধা হচ্ছে এখানকার বহুবিধ সংস্কৃতি এবং বহু দেশের মানুষ। অস্ট্রেলিয়াতে থাকলে আসলে বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই মানুষের দেখা পাওয়া যায়। আমার তাই এখন পর্যন্ত বিরক্ত লাগতে শুরু করেনি, হয়তোবা কখনো বিরক্ত লাগবেও না। নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, তাঁদের সম্পর্কে জানা আমার অন্যতম প্রিয় শখ। এক-একটা নতুন মানুষ আমার কাছে এক-একটা নতুন বইয়ের মতো। তাঁদের জীবনের বাঁকে বাঁকে গল্প ছড়ানো।

প্রবাস জীবনের পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। নিয়মানুযায়ী গত সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্বের জন্য শপথ নিলাম আমরা পুরো পরিবার। তখন বারবার আমার মাধ্যমিকের কথা মনে পড়ছিল। আমাদের হাইস্কুলের নাম জগতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। সেখানে টানা কয়েক বছর আমি শপথ বাক্য পাঠ করানো এবং জাতীয় সংগীত গাওয়ানোর কাজটা করেছিলাম। সেই শপথের কথাগুলোও মোটামুটি একই রকম ছিল। করোনার কারণে শপথ গ্রহণের কাজটা হলো অনলাইনে। আমরা তিনজন একসঙ্গে শপথ নেওয়ার পর অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো আজ বেলা ১টা ৬ মিনিট থেকে তোমরা অস্ট্রেলিয়ান। তোমাদের নাগরিকত্বের সনদ তোমাদের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে, তখন তোমরা পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে পারবে। এরপর বলা হলো, নাগরিক হওয়ার পর আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য কী হবে।

আমার বারবারই মনে হচ্ছিল, যে দেশটার আলো-বাতাসে জীবনের অর্ধেকটা সময় পার করলাম, যে দেশের সাধারণ মানুষের টাকায় নিজেকে বিশ্ব দরবারের যোগ্য নাগরিক হিসেবে তৈরি করলাম, তাদের জন্য ঠিক কতটা কী করতে পারলাম। তখন বারবারই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার একটা সংলাপ মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল

‘বাংলা বিহার উড়িষ্যার হে মহান অধিপতি,
তোমার শেষ উপদেশ আমি ভুলিনি জনাব’

আমিও তো ছোটবেলায় পাঠ করা শপথের কথা রাখতে পারলাম না। নিজ দেশের সঙ্গে কি আমি বিশ্বাসঘাতকতা করলাম। আর নতুন নাগরিকত্বের সনদ কি আসলে আমার সেই বিশ্বাসঘাতকতার সনদ?