অস্বস্তিতে আছি, ক্লান্তি আর যাচ্ছে না

>করোনাভাইরাসে পাল্টে গেছে জীবনের বাস্তবতা। আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। করোনায় জীবন নিয়ে লিখছেন অনেকেই। এই চিকিৎসকও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর সিরিজ লিখছেন। আজ পড়ুন দশম পর্ব।

কীভাবে কীভাবে দশদিন চলে গেল! আজ কত তারিখ ঠিক জানি না। দেখেই বা কি লাভ? সকালে নামতে দেখি ছেলেমেয়ের বাবা নাশতা বানাচ্ছে! আজ সূর্য কোনদিকে উঠেছে কে জানে। তবে উইকএন্ডে করে মাঝে মাঝে। জানতে চাইলাম কি বানায়? পটেটো.. হ্যাসব্রাউন, মানে কুড়মুড়ে আলুর ভাজি, বললাম টার্কি লিংক্স আছে যদি বানাতে চায়! আর একটু ফাইনালি দেশীস্টাইল আদা চা। ডিম করবে কি না, এটা-সেটা করবে কি না জানতে চাইছে। যা বানিয়েছে তাই সই।

আসলে ও অনেক কাজ করে। আমার মুখে শুনতে শুনতে সবাই ভাবে, তেমন কোনো কাজ করে না। তেমন কোনো কাজ পারে না তবে, ঘর গোছানো, পরিষ্কার রাখা, রেঁধে দিলে স্বেচ্ছায় সব হাঁড়িপাতিলসহ কিচেন ক্লিন করা, লন্ড্রি সব করে। অফ কোর্স ওয়াশিং মেশিন জিন্দাবাদ! ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা, আমার বাবা-মায়ের দেখাশোনা, নিজের মা-কোনোটাই বাদ যায় না। সবকিছুই তার নখদর্পণে। আবার আমার গাড়িতে তেল লাগলে, সময়ের আগেই ট্যাংক ফুল করে রাখে। যতই বলি, আমি আসলেই ভীষণ ভাগ্যবান! আমার মনে হয় না, এর চেয়ে উত্তম কিছুর আশা আমি কখনোই করেছিলাম! শ্ শ্ শ্ - এটা আমাদের সিক্রেট! আমরা দুজনেই দুজনের ওপর চাপ দেওয়ার কোনো চেষ্টা করি না। জীবন ক্ষণিকের, তার মাঝে বন্ধুর মতো এক সাথে সময় কাটানোর চেয়ে আর কিছু চাইবার নেই!

নাশতা করে, আমি সেইরকম অস্বস্তিতে আছি, টায়ার্ডনেস আর যাচ্ছে না। কতক্ষণ পোর্চে বসার চেষ্টা করলাম! তারপর আবার সোফায়!

মেয়ে অফকোর্স কনজেস্টেড! নাশতা করে সবাই সবার মতো ব্যস্ত। মেয়ে বেনজিকে নিয়ে হাটতে গেল, টেক্সট পাঠাচ্ছে, হরিণ ওদের কাছে এসেছে!

দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, কারও খাওয়া নেই- ভাবলাম স্যুপ করি। সেটা বাদ দিয়ে ভাবলাম হালিম করি- স্যুপ ভাবটাও আসবে, সবার পছন্দের ও হবে। মিক্স করে প্রেশার কুকারে দিতেই ও এসে বাকিটা করে দিল। ফ্রেশ ধনেপাতা আর কাঁচামরিচ আনতে আর দোকানে পাঠাতে ইচ্ছে হলো না, নেইবারের বাগান থেকে নিয়ে আসতে বললাম! ওর বাগানে মিন্ট আর কাঁচামরিচ দুটো আনতে আনতেই হালিম তৈরি। সবাই খেয়ে দেয়ে নিয়ে আবার যার যার মতো হাওয়া। ও এখনো কিচেনে পরিষ্কার করায় ব্যস্ত। ভাবলাম এর মাঝে আমি একটু ঘুমিয়ে নেব। কনজেশন আছে। আমি এখন বিরক্ত ওষুধ খেতে খেতে। পানিটা বেশি করে খেতে চেষ্টা করছি, সঙ্গে গেটোরেড ( স্পোর্ট ড্রিংক-কিছুটা ইলেকট্রোলাইট), মনে হচ্ছে পানির ওপরই বসবাস।

দু’দুটো নিম্নচাপ চলছে আমেরিকাতে। একটা হাওয়াইতে, আরেকটা টেক্সাসে। গতকাল ঘণ্টাখানেক বজ্রপাত হয়েছে, কোনো বৃষ্টি হয়নি।

লেখক
লেখক

আজ যেন সুদে আসলে বজ্রপাতের পর একপশলা বৃষ্টি। যেমন এল, তেমন চলেও গেল। বৃষ্টি থামতে বাইরে কিছুটা ঠান্ডা হয়েছে। মনে হোল লিলি প্যাডের মাছগুলোকে গতকাল খেতে দিইনি। আজ দেওয়া উচিত।

শাপলা পন্ডের পাশে বসে, মাছেদের খাবার দিলাম। সবাই খেতে এসেছে! মনটা ভালো হয়ে গেল। সঙ্গে দেখলাম নতুন সদস্য পানিতে- ব্যাঙ। আবার একটা লিলিতে ফুল ও ফুটেছে। না শাপলা এখনো হয়নি।

ভাবছিলাম এর মাঝেই পদ্ম গুলো দিয়ে দেব! তবে হরিণ খেয়ে ফেলবে, সে ভয়েই লাগানো হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয়, কি অল্পে আমরা খুশি হয়ে যাই! এই যে সন্ধ্যায় বসে, রঙিন মাছ গুনছি! তারা এই সন্ধ্যায় খুশি মনে আমার লিলি প্যাডে খেলে বেড়াচ্ছে - আমি সেটা উপভোগ করছি! মেয়ের কন্ডিশন আরও খারাপ হতে পারত! আমাদের কন্ডিশন খারাপ হতে পারত! আমরা মোটামুটি স্ট্যাবল- আলহামদুলিল্লাহ! প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে কতজন নাই হয়ে যাচ্ছে! প্রতিদিন মনটা খারাপ হয়ে যায়- এত দিন অপরিচিত মণ্ডলে করোনা ছিল - এখন আমরাও সেই ব্রাকেটে!

মাঝে মাঝে অনেক পুরোনো কথা মনে হয়, আমরা ৮৮ সালে বন্যার কারণে নিজেদের বাসাতে উঠে গেলাম, খিলগাঁও থেকে! খিলগাঁও তখন সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু! আর যেখানে গেলাম....? পাঁচটি ঘর ডিফেন্সের লোকজন ছাড়া আমাদের মেশার মতো কেউ নেই! আমি তখনো স্কার্ট পড়ি। পাড়া ভরে দৌড়ে বেড়াই। নতুন স্কুল, নতুন পরিবেশ- ভাগ্যিস আমার ক্লাসে তিন চারজন পড়ত! তাদের মাঝে দুজনের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল। নতুন পরিবেশে আমার মা ম্যানেজ করতে ঠিক হয়তো পারেনি। অনেকগুলো বছর অসুস্থ ছিল। ছোট ভাইটার টাইফয়েড হলো! তাকে নিয়েও অনেক দিন মাকে হাসপাতালে কাটাতে হলো! আমরা ছোট ছোট মানুষগুলোই রাঁধতাম, বাড়তাম। গেটে তখন তালা দিয়ে ভেতরে থেকে যেতাম-যখন বাবা-মা বাইরে থাকত। আজ বাংলাদেশের ব্যস্ততম নগরী সেটা- কত বছর পর যখন সেখানে গেলাম...ইটের নগরী চিনতেই পারি নাই!

ছোটবেলায় রোদ বৃষ্টি সহ্য হতো না!

মেয়েটাকে দেখছি নিচ থেকে, বাগানে বসে। জীবন, কখন কোথায় কাকে নিয়ে যায়!

এর মাঝেই পড়ছি, দেশি বস্তিগুলোতে নাকি করোনা নেই! ভীষণ ইন্টারেস্ট নিয়ে পড়ছি! অসম্ভব ব্যাপার আমার কাছে। যেরকম ছোঁয়াচে রোগ! না হয়েই যায় না।

পড়তে পড়তেই আবিষ্কার করলাম- আমি ঠিকই ভাবছি। স্ল্যামগুলোতে পরীক্ষাই করা হচ্ছে না। এরা আশপাশের দোকান থেকে ফ্লুর ওষুধ কিনে খাচ্ছে। কেউ অসুস্থ হলে বাইরে প্রকাশও করছে না ভয়ে, তাদের নাকি মনে হচ্ছে- হাসপাতালে গেলেই মারা যাবে! বা তাদের মেরে ফেলবে। যেখানে জীবনের নিরাপত্তা নাই - অবিশ্বাস সর্বত্র! সত্যি থেকে মিথ্যা আঁকড়ে পড়ে থাকা।

এই লাখো মানুষের কোনো করোনা টেস্ট নাই! আমরা কি ভীষণভাবে অবহেলিত! স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যব্যবস্থা বলে মুখে ফেনা তুলে কি লাভ!প্রদীপটাতেও সরিষার তেলের অভাব! নিচের অন্ধকারের কথা আর নাই বলি!

আমাদের এখানে স্বাস্থ্য বিভাগ ফ্রী টেস্ট করাচ্ছে! সঙ্গে যোগ দিয়েছে কিছু ফার্মেসি! অফকোর্স সরকার তার জন্য পে করছে। অনলাইনে গিয়ে যে কেউ টেস্ট করাতে পারে। ইনস্যুরেন্সও পে করছে!

স্বাস্থ্যব্যবস্থা! মানুষের জন্য করা, জবাবদিহি আর দায়িত্বশীলতা-এ সব কথা বোধ হয় আমাদের জন্য নয়! কখনো হবে না! আমরা ঠগি হই! ঠগি থাকি! মানুষ? মানুষ হই না! ধর্ম বর্ণ, জাত, পাত, পয়সা-কতভাবে বিভাজন করি। গরিব আত্মীয়দের পরিচয় দিই না, পাশে বসিয়ে আপন বলে মেনে নিই না। নিজেরা ছাড়া কাউকে মানুষ বলে মনে করি না। এর মাঝে এসেছে আরেকটি বন্যা! সেও নাকি আটাশীর মতো বা তার চেয়েও খারাপ হবে! চলবে...