কোরবানির ঈদ: মায়ার খাসি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ঈদ মানেই আনন্দ। ছোটবেলার ঈদের আনন্দ ভোলার নয়। তখন স্কুলে পড়ি। কামদিয়া দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থানার সর্বপশ্চিমের একটি হাইস্কুলের নাম কামদিয়া। কামদিয়া গ্রামের নামানুসারেই এই স্কুলের নামকরণ। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস। ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে ক্লাস করি তখন (বাই-লেটারাল)। ক্লাস শেষে ছেলেরা তাদের রুমে বসে থাকত। আর মেয়েরা মেয়েদের কমনরুমে ফিরে যেত। পরবর্তী ক্লাসের জন্য বেল পড়লে স্যারদের সঙ্গে মেয়েরা আবার ক্লাসে আসত। আমাদের স্কুলটি ছিল সুশৃঙ্খল। আমি এসএসসি পাস করেছিলাম এ স্কুল থেকেই।

এই স্কুল থেকে আমাদের গ্রামের দূরত্ব ছিল দু-তিন মাইল। আলিগ্রাম। আমাদের গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ে আমরা একসঙ্গে সে সময় হেঁটে গল্প করতে করতে স্কুলে যেতাম। কখন যে স্কুলে পৌঁছে যেতাম আবার কখন যে স্কুল শেষে বাড়িতে ফিরে আসতাম, আমরা তা টেরই পেতাম না। মাঝপথে কাদা থাকায় জুতা হাতে করে নিয়ে চলতাম আমরা। স্কুলে পৌঁছালে টিউবওয়েলের পানিতে পা ধুয়ে তারপর জুতা পরে ও ক্লাসে ঢোকা।

ঈদ আসার দু–এক সপ্তাহ আগে থেকেই আমাদের ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে সামনে ঈদ নিয়ে নানান কথা শুরু হয়ে যেত। কেউ বলত যে এবার সে ঈদে উঁচু উঁচু জুতা কিনবে, কেউ কিনবে শার্ট, কেউ পাঞ্জাবি। কিন্তু এসবে আমার তেমন আগ্রহ ছিল না। আমার আগ্রহজুড়ে থাকত কোরবানির খাসি।

কামদিয়াতে সপ্তাহে দুদিন হাট বসত—শনি ও বুধবার। কামদিয়ার হাট। বিশাল বড় হাট। অত্র এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বড় হাট কামদিয়ার হাট। কোরবানির ঈদ এলে কামদিয়া হাইস্কুল মাঠেই কোনো কোনো বছর গরু–ছাগলের হাট বসত। আমি অপেক্ষা করতাম, কোরবানির সেই হাটে আব্বা আসবে, দাদা আসবে, নানা আসবে, চাচা আসবে। তারা বেছে বেছে কোরবানির পশু কিনবে।

আমার বাবা গরুর মাংসের খাদক নয়। তবে খাসির মাংস এক কেজি এক বৈঠকেই শেষ। ব্যাপক খানেওয়ালা মানুষ আব্বা। তাই ঈদে আমাদের কোরবানি হতো খাসি। দাদা ও চাচারা মিলে দিত গরু কোরবানি। সে সময় আমার প্রধান কাজ ও দায়িত্ব ছিল কোরবানির খাসি কেনার পর সেই খাসির দড়ি হাতের সঙ্গে বেঁধে কামদিয়ার হাট থেকে আমাদের গ্রাম পর্যন্ত নিয়ে আসা। সেই নিয়ে আসার মধ্যে কী যে মজা, তা বলে শেষ করা যাবে না।

রাস্তায় যার সঙ্গেই দেখা হতো, খাসির দাম জিজ্ঞেস করত। আমি গর্বের সঙ্গে খাসির দাম বলে আনন্দ পেতাম। তারপর বাড়িতে খাসি আনার পর থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত খাসির দেখাশোনার দায়দায়িত্ব অটোমেটিক আমার ওপর বর্তাত। স্বল্পকালীন এই সময়ে কোরবানির এই খাসির সঙ্গে আমার এক ধরনের প্রেম, ভালোবাসা, মায়া সৃষ্টি হয়ে যেত। সেই ভালোবাসার তাগাদায় খাসিকে প্রতিদিন গোসল করাতাম, গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির আম–কাঁঠালের কচি কচি পাতা কেটে এনে খাসিকে খাওয়াতাম। ভীষণ আনন্দ পেতাম তাতে। খাসি ভ্যা ভ্যা করলেই মনে হতো যে সে ক্ষুধার্ত, তার খাদ্য দরকার। গাছের পাতা এনে খাওয়াতাম। খাসির চোখ দিয়ে পানি পড়লে আমার চোখ দিয়েও পানি পড়ত। গভীরভাবে কষ্ট পেতাম। ছোট বালক বিধায় সেই কষ্ট কাউকে না বলে মনের মধ্যেই কষ্টে হারিয়ে যেত। মায়া জন্মাত খাসির প্রতি। ভীষণ মায়া।

যখনই ভাবতাম এই তো আর দুদিন বা তিন দিন পরেই ঈদের নামাজ হবে। তারপর মাঠ থেকে বাড়িতে এসে এক এক করে রাস্তার ওপরে লাইন করে গরু–ছাগল কোরবানি হয়ে যাবে। এক সপ্তাহজুড়ে যে ছাগলকে আমের পাতা কাঁঠালের পাতা নানান মানুষের বাড়ির গাছ থেকে চুরি করে এনে এনে খাইয়েছি, সেই খাসিও কোরবানি হয়ে যাবে। সেসব ভেবে আমার মনের মধ্যে তখন আঁতকে উঠত। আসলে সেসব চিন্তায় সে সময়ের এই ছোট বালকের আগের রাতের ঘুমই হারাম হয়ে যেত।

সেই স্কুলজীবনের এক ঈদের কোরবানির কথা বলি। খাসির প্রতি অত্যধিক প্রেম–ভালোবাসা থাকায় আমার আব্বা একবার ছোট্ট দুটি বাচ্চা খাসি আমাকে কিনে দিয়েছিলেন। সেই বাচ্চা খাসি দুটোকে আমি এবং আমার মা খাইয়েদাইয়ে বেশ ডাঙ্গর করেছিলাম। একটি ছিল কালো খাসি। অন্যটি সাদা খাসি। দুটো খাসিই একই মায়ের সন্তান বিধায় এবং একই সময়ে জন্ম বিধায় তারা একইভাবে বড় হতে লাগল আমাদের বাড়িতে।

সাদা খাসিটির গায়ে আমি গোলাপি রং দিয়ে সাদা ও গোলাপির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে গ্রামের সবাইকে আকৃষ্ট করে ফেললাম। এই খাসি দুটির প্রতি আমার যে দরদ, তা গ্রামবাসীর নজরে পড়েছিল। তাই খাসি দুটিকে আমি দড়ি দিয়ে আটকিয়ে রাখতাম না। সারা দিন খাসি দুটি খেয়েখুয়ে আবার বাড়িতে ফিরে আসত। কারও খেতের ফসল খেলেও সবাই জানত যে এটা আমার খাসি। তারা আবার তা আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিত।

বছর দুয়েক পর খাসি দুটি সত্যি সত্যিই আরও ডাঙ্গর হয়ে উঠল। পেলেপুষে বড় করা এত আদরের খাসি দুটির ভাগ্যও নির্ধারিত হয়ে গেল। আমার আব্বা সেবার কোরবানির জন্য খাসি দুটিকে নির্ধারিত করে ফেললেন। কোরবানির পশু কেনার টাকাও তাতে বেঁচে গেল, আবার শখের জিনিসও কোরবানি দেওয়া হলো। আব্বার সে সিদ্ধান্তে আমার কষ্টের সীমা আর রইল না। কিন্তু তাতে কী? আমার কষ্ট কে দেখে? আমার মতো ছোট বালকের কষ্ট দেখার ও মূল্যায়ন করার মানুষ তখন পরিবারে ছিল না।

কোরবানির দিন যত ঘনিয়ে আসতে লাগল, খাসি দুটির প্রতি আমার মায়া ও ভালোবাসা গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগল। এত মায়ার জিনিস সেবার কোরবানি হয়ে গেল। আমার মনে কষ্ট ঘনীভূত হলো।

তারপর কত বছর অতীত হয়ে গেল। সেই বালক থেকে কিশোর হয়েছি, বড় হয়েছি। দেশে–বিদেশে কত ঈদ করেছি, দেখেছি। প্রতিবছর কোরবানি হয়, ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী কোরবানি দিয়েছি। কিন্তু সেই ছোটবেলার ওই খাসি দুটোকে আজও ভুলতে পারিনি। বড়ই মায়ার খাসি ছিল। ভালোবাসার খাসি।

পরিশেষে বলব, কোরবানির মাধ্যমে প্রতিবছর কত নিরীহ গরু, ছাগল, দুম্বা কোরবানি হয়, কত মায়াবী পশুর জীবন চলে যায়। আমরা সেসব কোরবানির মাংস খেয়ে আনন্দে নেচেও উঠি। অথচ আমরা কি একবার ভেবে দেখি, কোরবানির মূলে যে উদ্দেশ্য থাকে, তা আমরা হাসিল করতে পারি? মানুষ হিসেবে মানুষের ভেতরে শুধু মায়াই থাকে না, থাকে পশুত্বও, সেই পশুত্বকে কি আমরা কোরবানির মাধ্যমে বিসর্জন দিতে পারি? একটি সুস্থ সামাজিক সমাজ গড়ার জন্য?

লেখক: বোস্টনের একটি ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মরত। [email protected]