বাংলায় বিদেশি শব্দ বাহাস

ইদানীং ‘রমজান’ নাকি ‘রমাদান’ কিংবা ‘ঈদুল আজহা’ নাকি ‘ঈদুল আদহা’ শব্দের ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক, হাসাহাসি, বিকৃতকরণ এবং পাণ্ডিত্য দেখা যায় অনেকের মধ্যে। কোনো কিছু না জেনে ভুল-শুদ্ধ তর্কে ব্যস্ত সবাই।

পৃথিবীর সব ভাষাই নিজস্ব গতি-প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে বিদেশি শব্দ আত্মস্থ করেছে। ঠিক তেমনি আমাদের বাংলা ভাষাও বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ আত্মস্থ করে সমৃদ্ধ হয়েছে। তার মধ্যে ইংরেজি, ফারসি, উর্দুর প্রভাব অন্যতম।

ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের মূল স্রোত যখন প্রথম আসে, তখন তা পারস্য ভাবধারায় প্রভাবিত ছিল। আব্বাসীয় খিলাফতকালে (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.) পার্সিয়ান ভাষা আরবের প্রশাসনিক ভাষায় পরিণত হয়। তখন বহু আরবি শব্দ মধ্যযুগীয় পার্সিয়ান ভাষায় পরিবর্তিত হয়। এই পার্সিয়ান বা ফারসি ভাষা ব্যাপকভাবে গৃহীত হয় ইরান, তুরস্কসহ ভারত উপমহাদেশের মতো অ-আরব দেশগুলোয়। তুরস্কের খিলজি ডায়নেস্টি বাংলায় ইসলামিক শাসন নিয়ে আসার পর ইসলামের ব্যাপক রূপান্তর ঘটে। কারণ তখন বেশির ভাগ ইসলামিক স্কলার ও ইমাম পারস্য শিক্ষিত ছিলেন।

রমাদান, ঈদুল আদহা কোরআনের আরবি শব্দ, যা পরে ফারসিতে রূপান্তরিত হয়। যেমন রমাদান হয় রমজান, সাওম রোজা হয়ে যায়, সালাত নামাজে পরিণত হয়, দুহর হয় জোহর, ওদু হয় অজু। ‘আল্লাহ হাফেজ’ না বলে অনেকে ‘খোদা হাফেজ’ বলেন। আপনি বাংলায়, উর্দুতে, ফারসিতে কিংবা কোরআনের ভাষা আরবি যে ভাষাতেই বলেন, সবই কিন্তু সঠিক। সেই হিসেবে ‘রমজান’ হচ্ছে আরবি শব্দ রমাদানের বাংলা রূপ, ঠিক তেমনি ঈদুল আদহার বাংলা রূপ ঈদুল আজহা এবং সেটা অবশ্যই অশুদ্ধ নয়। তবে কেউ যদি কোরআনে উল্লিখিত আরবি শব্দের বিশুদ্ধ উচ্চারণে আগ্রহী হন, তাহলে সেটাকে আগ্রাসন বলার সুযোগ কতটুকু? কারণ বিশুদ্ধ উচ্চারণের তাগিদ কোরআন ও হাদিসে রয়েছে।

কবি নজরুল ফারসি ও উর্দুতে পারদর্শী ছিলেন। তাইতো তিনি শত শত গজল লিখে বাংলার গালিব হয়ে আছেন। নজরুলের বিখ্যাত গান ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’-এ ‘রমজান’ ‘রোজা’ শব্দের ব্যবহার বাংলা ভাষায় পারস্য ভাষারই ছাপ বহন করে। নজরুল ‘রমজান’ লিখেছেন বলে ‘রমাদান’ অশুদ্ধ হয়ে যায়নি।

মানুষ এখন পড়ছে, জানছে এবং জ্ঞান অর্জন করছে, যার ফলে এক শ-দেড় শ বছর ধরেই উপমহাদেশের ইসলামে আবারও আরবিকরণের একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যার মূল কারণ কোরআনের বাণীর ভাষা আরবি।

তবে প্রতিটি ভাষারই উচিত তার নিজস্বতা ধরে রাখা। ঈদুল আদহা কিংবা রমাদানের পাশাপাশি ঈদুল আজহা, কোরবানির ঈদ, বখরি ঈদ, রোজার ঈদ, রমজান প্রভৃতি শব্দগুলোকে যেন আমাদের জড় মূল থেকে উপড়ে ফেলে না দিই।