সৌদি আরব ও বাংলাদেশে ঈদ সংস্কৃতির যে পার্থক্য

উচ্চশিক্ষার জন্য এ বছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা সৌদি আরবেই উদযাপন করেছি। তা ছাড়া এর আগেও কিছুদিন সৌদি সংস্কৃতি কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। সেই সুবাদে সৌদি আরব ও বাংলাদেশে ঈদ সংস্কৃতিতে আমার কাছে যে পার্থক্যগুলো পরিলক্ষিত হয়েছে, তা তুলে ধরছি—

*সৌদি আরবে ঈদের নামাজ সূর্যোদয়ের ১৫ থেকে ২০ মিনিট পরেই শুরু হয়ে যায় এবং সরকারিভাবেই অঞ্চলভিত্তিক এই সময় নির্ধারণ করা থাকে। সব মসজিদে একই সময়ে জামাত শুরু হয়। বৃহত্তর মক্কা অঞ্চলের সময়ের আলোকে এবার কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটিতে আমরা ঈদের নামাজ পড়েছি ভোর ৬টা ৮ মিনিটে। বাংলাদেশে ঈদের জামাত তুলনামূলক একটু দেরিতে হয় এবং জামাতের সময়ও বিভিন্ন রকম।

* সৌদি আরবে ঈদের দিন ফজর থেকেই সব মসজিদের মাইক থেকে তাকবির ধ্বনি (আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু…) দিতে থাকে, যা ঈদের জামাত শুরুর আগ পর্যন্ত চলে। এর ফলে চারদিকে একটা পবিত্র আবহ ও উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হতে থাকে। আমাদের দেশেও তাকবির ধ্বনি দেওয়া হয়, তবে সেটা মসজিদের মাইকে প্রচার করতে খুব একটা দেখা যায় না।

* সৌদিতে ঈদের নামাজের আগে ইমাম কিংবা বিশিষ্টজন কর্তৃক কোনো ধরনের আলোচনা বা বয়ান করা হয় না, যা বলা দরকার সালাত–পরবর্তী খুতবায় বলা হয়। এখানে ঈদ জামাতে কোনো প্রকার টাকা কালেকশন করারও প্রয়োজন হয় না, আর এ দুটিই বাংলাদেশে রয়েছে।

* ঈদ উপলক্ষে সেমাই নাশতা–জাতীয় খাবারের প্রচলন এখানে নেই। তবে রয়েছে আরবীয় ঐতিহ্যবাহী নানা খাবার। তা ছাড়া ঈদের নামাজ–পরবর্তী ফ্রিতে উন্নত চকলেট–জাতীয় মিষ্টান্ন বিতরণ করতে দেখা যায়।

* ঈদ উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানাতে এখানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পরিভাষা ‘কুল্লু আম ওআনতুম বিখাইর’ এবং ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওমিন কুম সালিহাল আমাল’। বাংলাদেশে বেশি ব্যবহৃত হয় ‘ঈদ মোবারক’, যদিও আরবি পরিভাষাগুলো ইদানীং বাংলাদেশে জনপ্রিয় হচ্ছে। ঈদ শেষে কোলাকুলিকে সৌদি সমাজে বৈধ মনে করা হলেও ঈদের সুন্নাহ মনে করা হয় না, তাই এসবের প্রচলন কম।

* ঈদ উপলক্ষে গণপরিবহনের ভাড়া কিংবা দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কোনো প্রবণতা এখানে লক্ষ করিনি। বাংলাদেশে এটি একটি বড় সমস্যা।

* ঈদুল আজহায় বাংলাদেশের মতো প্রতিটি বাড়ির সামনে কোরবানির পশু জবাই করা হয় না; বরং প্রতিটি এলাকায় সরকার–নির্ধারিত Slaughter House রয়েছে। সবাইকে সেখানেই পশু জবাই ও প্রসেসিং করতে হয়। এ জন্য ঈদুল আজহা–পরবর্তী পরিবেশদূষণের প্রশ্ন নেই। ঈদুল আজহায় দরিদ্রদের মধ্যে কোরবানির মাংস বিতরণ বাংলাদেশি সমাজের একটি চমৎকার দিক, সৌদি আরবেও বিতরিত হয়। তবে আমাদের দেশের মতো এত ব্যাপক ও উৎসাহমুখর নয়।

* প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ঈদ পুনর্মিলনীর আয়োজন সৌদিতে স্থানীয়দের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না, যদিও পারিবারিক পর্যায়ে ঈদ গ্যাদারিং রয়েছে। বাংলাদেশে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে ঈদ পুনর্মিলনী জাতীয় প্রোগ্রামের ব্যাপক প্রচলন লক্ষ করা যায়।

* রমজানে সৌদিতে ব্যাপক হারে ইফতার বিতরণ করতে দেখা যায়, তবে ইফতার প্রোগ্রাম/পার্টি নামে কোনো আলোচনা অনুষ্ঠান এখানে দেখা যায় না। কখনো ইফতার উপলক্ষে একত্র হলে ইফতার–পূর্ব সময়টা সবাই ব্যক্তিপর্যায়ে জিকির ও দেয়া–কালামে ব্যস্ত থাকে। বাংলাদেশের ইফতার প্রোগ্রাম ব্যাপক হারে দেখা যায় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলোর সঙ্গে সাধারণত সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পৃক্ত থাকে।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, কিং আব্দুল আজিজ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব। [email protected]