দায়িত্ব-কর্তব্য ভুলে ঠকানোর খেলায় আমরা

>করোনাভাইরাসে পাল্টে গেছে জীবনের বাস্তবতা। আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। করোনায় জীবন নিয়ে লিখছেন অনেকেই। এই চিকিৎসকও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর সিরিজ লিখছেন। আজ পড়ুন ১৩তম পর্ব।

সকালে ঘুম ভাংতে শুনি মেয়ে কাশছে। বাবার টেক্সট, দেখি ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসেছে। ফ্রেশ হতে নেমে দেখি নাশতা এনেছে, আজ চাও বানিয়েছে। ছেলে আমাকে নামতে দেখতেই তাড়াহুড়োয় খাবার শেষ করে নিচে চলে গেল। চা নিয়ে আমি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম, ওর ওষুধ খেয়েছে কি না। কেমন বোধ হচ্ছে, বলে নসিয়া মানে বমি ভাব আছে আজ! আসলে এই বমিভাবটা ভীষণ জ্বালায়, টায়ার্ডনেসের ওপরে। কাজ থেকে সিএফও ফোন দিল কি অবস্থা জানার জন্য। অবকোর্স কাজে ফেরত গেলে সবাই খুশি। ফুলটাইম কাজ করার জন্য বলেই নয়-একটা বিশাল লোড থাকে আমার উপরে। বলে দিলাম আমি হয়তো কিছু সময় নিব! মেয়েটা অসুস্থ! সবাই ঠিক না হলে আসতে দেরি হবে। আর আমি নিজেও এখনো দুর্বল।

করোনা সিম্পটম সবাই জ্বর কাশি নিয়ে ব্যস্ত! জ্বর না হলেও যে সিভিয়ার সিম্পটম হতে পারে-নিজেদের দেখেই বুঝতে পারছি। বলল তুমি জানাও আমাকে, তোমার ইচ্ছেমতোই ফিরো। আমার আর ভালো লাগে না। ওষুধে অভুক্তি চলে এসেছে! হুম করোনার স্পেসিফিক চিকিৎসা নেই- তবে সিম্পটমের জন্য কত শত ওষুধ খেতে হয়। তার সঙ্গে যাদের ক্রনিক সমস্যা, সেসব কন্ডিশনও নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। করোনার ট্রিটমেন্টের প্রধান খরচ সেখানে। নিউমোনিয়ার চেয়ে বেশি আমি দেখি নরমালী সাইনাসের ইনফ্লেমেশন হয়, ব্রংকিয়াল ইনফ্লেমেশন হয়ে, ক্ষণে ক্ষণে মনে হয় শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তবে অবশ্যই নিউমোনিয়া বাঁধানোর মানে নেই। যাদের এজমা বা শ্বাসকষ্টজনিত ধাত, তাদের অবশ্যই এক্সট্রা সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। শ্বাসকষ্টের মতো কষ্ট হয় না!

আমি আসলেই অধৈর্য হয়ে যাচ্ছি।

বরকে বললাম চেক করতে, আমি আজকে চেক করতে পারব কি না আমার স্ট্যাটাস। মানে করোনার স্ট্যাটাস! পজিটিভ হয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না। চেক করে বলছে, আজ করলে চল! রেজিস্ট্রার করে দিয়েছে আমাকে।

ওরও কাশি সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। গত কয়দিনে আমি ঘরের বাইরে যাইনি। মাস্ক পড়ে এই প্রথম বাসার বাইরে যাচ্ছি। বমি ভাব, দুর্বলতা টের পাচ্ছি। বললাম ওরও আজ টেস্ট করা উচিত! কথায় কথায় বলছে, গলাতে লাগছে...আমি শিওর এখনও ও পজিটিভ আসবে! তবে ও খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে- আমরা ঘরে মা মেয়ে দুজন পজিটিভ- পসিবিলিটি যে ওর পজিটিভ আসবে-সেটাই বেশি। বললাম ওর জন্যও রেজিস্ট্রার করতে। রাজি হতে চাচ্ছে না।

তবে টেস্ট সেন্টারে যেতেই, সেখানকার লোক বলল, যদি ও টেস্ট করাতে চায়, তাহলে সমস্যা নেই- টেস্ট যারা করছে, ওদের বললেই হবে। লোকটা মজা করছে, তুমি পজিটিভ, এখন এরেও পজিটিভ করে দিবা তো। আর এর মাঝে কয়েক মিনিটে গাড়িতে বসেও রেজিস্ট্রার করে নিতে পারে। রেজিস্ট্রার করে নিতে বললাম। গত সপ্তাহে মেয়ের সঙ্গে টেস্টে নেগেটিভ ছিল-তবে সেটা বদলাতে তো বেশি সময় লাগে না। এই দু সপ্তাহে প্রথম মনে হচ্ছে আমাদের কনভারসেশন চলছে। রেজিস্ট্রার হতে হতেই দুজনের টেস্ট হয়ে গেল। আগামী সপ্তাহে মেয়ের রিচেক করাব। সঙ্গে ছেলেরও। গাড়িতে এসিতে বসেও আমি ঘামছি। দুর্বলতা টের পাচ্ছি।

ও বলছে, তুমি তাহলে আমাকেও পজিটিভ করে দিলা? বললাম সমস্যা নেই, সে জন্য তাকে স্যুপ কিনে দিতে পারি! সুপ খেয়ে ভুলে গেলেই চলবে! রেজাল্ট পেতে দু একদিন লাগবে। ওই যে বললাম, সবাই পজিটিভ, আনটিল প্রুভেন আদার ওয়াইজ!

প্রতিদিন দেখি দুনিয়ার সবখানে হাজমত স্যুট পরে সবাই কোভিড রোগী ট্যাকল করে, আমরা একমাত্র আমেরিকাবাসীরাই মনে হয়, টি শার্ট পরে, একখান কোনোরকম মাস্ক আর ফেসশিল্ড দিয়ে, হাতে কোনোরকম গ্লাভস পরে করোনার স্যাম্পল কালেক্ট করি! আমি নিজেও এর বেশি কিছু পড়ে করোনা রোগীর ট্রিটমেন্ট দিই না।

এই স্যাম্পল কালেক্ট যারা করছে, তাদের জন্যও মন খারাপ হল- আমি চাই না এরা ভুল করেও পজিটিভ হোক।

থাই সুপ আর খাবার পিক করে বাসায় এসে দেখি, মেয়ে শুয়ে আছে, ভালো ফিল করছে না। আমিও এতক্ষণ বাইরে থেকে ফিরে আর এনার্জি পাচ্ছি না। বমিভাব টা বাড়ছে। ছেলের জন্য টেনশন হচ্ছে-ও লাস্ট পারসন! আমি চাই না ও সিক হোক। পুরোটা সময় আমাদের কাছ থেকে দূরত্ব মেনটেইন করছে। অথচ প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা পাশাপাশি বসা আমাদের অভ্যাস!

আগামীকাল আবার আমার বাবার এক টেস্ট ছিল, ভাগ্যিস পিছিয়েছে সপ্তাহখানেক। সবাই মিলে অসুস্থ হওয়ার দরকার নেই।

দেশে শুনি ফুপাতো ভাই ভাবি করোনায় হসপিটালে ভর্তি। ভাবি নার্স, ভাই ফ্যামিলি প্লানিংয়ে। গত সপ্তাহে ফোন দিয়েছিল-কথা হয়নি। এর মাঝে নাকি আবার এপেনডিক্সের অপারেশনও হয়েছে। ওদের বাসা লকডাউন করে গেছে।

এটা আরেকটা ভোগাস ব্যাপার দেখি হয় দেশে। বাসা লকডাউন! কেন?

লেখক
লেখক

আমার বাসায় কেউ অসুস্থ হলে- পরিচিতদের আমরা নিজেরাই আসতে না করে দিই। প্রতিবেশীদের সঙ্গে দূর থেকেই কথা বলি দরকার হলে। ওরাও এটা-সেটা দিতে হলে দরজার সামনে রেখে যায়, কোনো সংস্পর্শ নাই। তবে দেশে কেন এই লকডাউন? তারপর সেসব পরিবারদের হেনস্তা করানো হয়? তারা তো অলরেডি সাফার করছে! তাদের তাদের মতো থাকতে কেন দিই না? হয়তো মানসিকতা বুঝতে পারছি না!

এই যেমন আমার বাসায় গত দু সপ্তাহে আমরা কাউকেই এলাও করি নাই। হয়তো আরও কয়েক সপ্তাহ এভাবেই থাকব। আমি আমার প্রতিবেশীর থেকে বেশ দূরত্বে অবস্থান করি। গতকালও আমার প্রতিবেশী আমার পোর্চের টেবিলে ওর গাছের লাউ রেখে গেছে। অনেকগুলো হয়েছে বলে। আবার আমার বান্ধবী ঈদ বলে সকালে নাশতা বানাবে। জানে আমরা সিক- ভালো হচ্ছি। ওরা সবাই নেগেটিভ। আমাদের ঈদে নাশতার জন্য বলেছে- আমি সঙ্গে সঙ্গেই বলেছি, আমাদের এ অবস্থায় সবার নেগেটিভ না হওয়া পর্যন্ত দেখা না হওয়াই উচিত। আমি কিন্তু আবেগে, উচ্ছ্বাসে, ধর্মীয় গাম্ভীর্যে বলতে পারতাম, কপালে যা আছে, ঠিক আছে, ঈদ আসছে; আসব। কিন্তু সেটা করা আমার দিক থেকে রেসপন্সিবল ব্যবহার নয়! আমার বা আমার পরিবারের কারণে আরও কারও পরিবারে করোনা আসুক, সেটা আমি চাই না। তার জন্য তাদের সেফটির জন্য আমাকে আমার কর্তব্য ঠিকমতো করতে হবে। এটা আমার ফিলসফি। হয়তো, এখানেই আমাদের লোকজনের সমস্যা। আমরা নিজেদের কথা ভাবি শুধু, সঙ্গে অন্যদের যে অসুস্থ বানাচ্ছি তার জন্য গিল্টি ফিল করি না। এই মানসিকতা কি লকডাউনে সারে? আমার বাসায় সবাইকে যতটা দূরত্ব মেনটেইন করতে হবে করছি, মাস্ক পরে চলার চেষ্টা করছি। রেসপনসিবিলিটি মেনটেইন করার পরও যদি কারও করোনা হয়- সেটা ভিন্ন। নিজের কাছে দায়বদ্ধতা যেন সজ্ঞানে কাউকে অসুস্থ না করি- এই মানসিকতা না ডেভেলপ করলে, লকডাউনে লাভ নেই। দায়িত্বশীলতা সবার হওয়া উচিত! আমার বাবার বাসা থেকে খাবারও দরজার বাইরে থেকেই নিয়ে আসছে! তারাও মাস্ক, গ্লাভস পরেই খাবার দিচ্ছে।

এত অল্প সময়ে সারা পৃথিবীজুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে করোনা। স্বেচ্ছায় নয়, বাধ্য হয়ে স্কুল, কলেজ, অফিস আদালত বন্ধ! বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের লস প্রতিটি দেশ বাধ্য হয়ে মেনে নিচ্ছে প্রতিটি দিন। লাখো জনগণ নাই হয়ে গেছে কয়েক দিনের ব্যবধানে- প্রকৃতির এই অমোঘ শক্তিকে কীভাবে আমরা অস্বীকার করব? এর মাঝেও থেমে নেই ঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প! যেন আমরা একটা এজে দাঁড়িয়ে আছি- নিক্তির কাঁটা একটু একচুল এদিক-ওদিক হলেই আমরাও নম্বর হয়ে যাব- তারপরও ঠকানোর প্রবৃত্তি বন্ধ নেই। রেসপন্সিবিলিটি, দায়িত্ব, কর্তব্য ভুলে মানুষ ঠকানোর খেলায় মেতে আছি!

নাকি ভুলে যাচ্ছি, নিজেদেরই ঠকাচ্ছি?

ঈদে পশু কোরবানির জন্য আমরা উন্মুখ থাকি! তার মাংস পেতে আমরা উন্মুখ! তবে তার যে প্রধান শিক্ষা, নফসের কোরবানি, সেটা কি আমরা ভুলে যাচ্ছি না? হয়তো আমরা একদিন আবার নরমাল পৃথিবীতে ফিরব, হয়তো কখনোই নয়- কিছু নতুন জিনিস কিন্তু শিখতে পারি। ভালো মানুষ হতে শিখতে পারি! ভালো ব্যবহার শিখতে পারি- মানুষদের সম্মান করতে শিখতে পারি! কত কিছুই পারি! সৎ হতে পারি। পারি না কি? চলবে...