বিষন্ন ঈদ

>করোনাভাইরাসে পাল্টে গেছে জীবনের বাস্তবতা। আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। করোনায় জীবন নিয়ে লিখছেন অনেকেই। এই চিকিৎসকও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর সিরিজ লিখছেন। আজ পড়ুন ১৫তম পর্ব।

ঘুম ভাঙল পতিদেবতার দর্শনে। ঈদ মোবারক বলতে এসেছে। এর মাঝে ফোনের শব্দ পেয়েছি, হয়তো মায়ের বাসার ফোন। রান্না করার কথা।

পরবর্তী লাইন সে যা বলল, তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের টেস্ট রেজাল্ট এসেছে, দুজনই পজিটিভ! তার পজিটিভ মনে দাগ ফেলেনি, জানা ছিল পজিটিভ হবে। তবে দুসপ্তাহ পরও আমি পজিটিভ?

আর ফাইনালি বলল, আমার মেজ মামা আর নেই। আমাদের রাতে, মানে তাদের দিনে, মামা বাইকে কোথাও যাচ্ছিলেন, হানিফ পরিবহনের গাড়িচাপা দিয়ে গেছে! আমি কতক্ষণ চুপ হয়ে থাকলাম। মামাতো বোন মাত্র ডাক্তার হলো, গত সপ্তাহে আকদ হয়েছে! আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। বড় আদর করতেন আমাদের। ফোন দিলাম মাকে। কান্নার শব্দে আর কিছু জিজ্ঞাসা করা হলো না! তারপরও বলে, ঈদের খাবার সব রেডি, নিয়ে যেতে বল। আমি ভাবতে পারছি না, মা কীভাবে এই নিউজের পরও রেঁধেছে! আমি রাঁধতে না করতে জন্যই ফোন করেছিলাম!

ফোন রেখে আবারও ফোন দিলাম, জানালাম তাদের মেয়েজামাই পজিটিভ। এক্সট্রা কেয়ারফুল থাকে যেন।

বাবার আজ কাজ আছে, কাল জেনেছিলাম! ফোন দিলাম খবর জানে কি না। বলে কাজে যায়নি, খবর পেয়ে কাজে জানিয়ে ছুটি নিয়েছে। থাকুক বাসাতেই। আমার পক্ষে মায়ের পাশে গিয়ে বসা সম্ভব নয়! শি নিডস মেন্টাল সাপোর্ট। ছোটভাই তার, হাজারো স্মৃতি বেড়ে ওঠার। এটা মনে করে দেখি আমার চোখেও পানি!

জীবন জীবিকার তাগিদে, একঘরে, এক প্লেটে খেয়ে বড় হলেও ভাই বোনদের মাঝে কতশত দূরত্ব চলে আসে! তারপরও সেই বিনি সুতোয় যে রক্তের বন্ধন, সেটার টান একটু ভিন্নই। এই প্রথম মৃত্যুর মিছিল শুরু হলো আমাদের পরিবারে। বয়স তার বেশি নয়, পঞ্চাশের আশপাশে! সুস্থ মানুষ নাই হয়ে গেল! সবার অভিমান, অনুযোগ আর ছোঁয়াছুঁয়ির ঊর্ধ্বে এখন। মামা আমার কবিতে লিখত, ছবি আঁকত অল্প বয়সে। অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল, জীবনে কম কষ্ট করেনি, তবু মুখের হাসি কখনো কমেনি। আজ যখন আনন্দ করার কথা, নাই হয়ে গেল! আমরা কত প্ল্যান করি, সবচেয়ে বড় প্ল্যান তো যার হাতে, তার মতেই সব হয়! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ ওনার দোষত্রুটি ক্ষমা করে, বেহেশত নসিব করুন।

মামা আমাদের গল্প বলতেন, সেই ছোটবেলা বোনকে দেখতে, একাকী কত কষ্টে বোনের শ্বশুরবাড়ি যেতেন। গাড়ি ছিল না, মধুখালী স্টেশনে নানির হাতে বানানো খাবার নিয়ে অপেক্ষায় থাকতেন! বাড়ি থেকে বের হয়ে নৌকা, তারপর হয়তো গরু বা ঘোড়ার গাড়িতে মাগুরা, সেখান থেকে বাস, ফেরি, ট্রেন, গরু–ঘোড়ার গাড়িতে, বোনের শ্বশুরবাড়ি। তাও যদি সময়মতো ট্রেন ধরতে পারত! নয়তো সারা দিন রাস্তায় হয়তো অভুক্ত থেকে যেতে হতো। নানির বাড়িতে তার হাতে আঁকা সুন্দর একটি ছবি ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখা দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। আজ তিনিও ফ্রেম হয়ে গেলেন। আমার সঙ্গে শেষ দেখা ৯-১০ বছর আগে। যাক, জান্নাতে নানা–নানির সঙ্গে ভালো থাকবেন! এ জীবনের যাত্রা শেষ মামা! কোন দুঃখ–কষ্ট আপনায় আর ছোঁবে না।

লেখক
লেখক

আমাদের পরিবারে সড়ক দুর্ঘটনা বিশাল একটা সমস্যা করে আছে অর্ধশতাব্দীজুড়ে। আমার দাদার, আমিসহ আমার ভাইদের। বাবা মরতে মরতে বেঁচে গেছেন। বোনজামাই আর এবার মামা। সড়ক দুর্ঘটনাগুলো আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে। নিরাপদ সড়কের দাবি আমাদের পরিবারের কান্না, হতাশা আর দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে মিশে আছে! যার পরিবারে এখনো কোনো এক্সিডেন্ট হয়নি, তারা আসলেই ভাগ্যবান। হাত–পা ভাঙার কষ্ট, জীবনে কোনো দিন আর হাঁটতে না পারার কষ্ট, তার সঙ্গে হাজারো কর্মঘণ্টা নষ্ট, মানসিক, অর্থনৈতিক ক্ষতির কী যে এক বিশাল বার্ডেন; যার হয়নি, তার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আর এই যে কর্মক্ষম একজন মানুষের মৃত্যু, তার এবং তার পরিবারের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ এবং পরিবারটির নির্ভরশীলতার জায়গা নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার যে দায়ভার, তার দায়ভার আপনি, আমি, সড়কব্যবস্থা, রাষ্ট্র—কেউ অস্বীকার করতে পারি না।

দুই বছর হয়ে গেছে বাচ্চাগুলো নিরাপদ সড়কের আন্দোলন করেছিল, সেদিনও রাস্তায় পিষ্ট হয়েছে বাচ্চাগুলো, তাদের স্বপ্ন, তাদের পরিবার! আর কত? আর কত শুধু খামখেয়ালির বসে বা উত্তেজনায় আমরা এক–একটি জীবনের ওপর গাড়ি তুলে দেব? কবে আমরা একটু অন্যের জীবনটাকে রেসপেক্ট করতে শিখব? কবে আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান দেব? একটু যথাযথ ড্রাইভিং ট্রেনিং দিলেই সড়কের এক্সিডেন্ট চার ভাগের তিন ভাগ কম হবে। যথাযথ রাস্তার নিয়ম শিখতে ড্রাইভারদের মাসখানেকের কম বৈ বেশি লাগে না। তাঁদের চক্ষু পরীক্ষা, শুনতে পাওয়ার পরীক্ষা, মানসিক, শারীরিক ফিটনেস টেস্ট বাধ্যতামূলক করা উচিত। সঙ্গে রিটেন এবং প্র্যাকটিক্যাল ড্রাইভিং টেস্টে পাস করাটাও। এটা একটি দেশের রেভিনিউ বাড়ানোর জন্যও দরকারি। প্রতি তিন–চার বা পাঁচ বছর পরপর পরীক্ষা দিয়েই ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করলে আমার মনে হয় অবস্হার বা ব্যবস্থার উল্লেখজনক পরিবর্তন আসবে।

এর সঙ্গে কন্ডাক্টরদের বাধ্যতামূলক কিছু টেস্ট দরকার। ফিটনেস টেস্ট, রিটেন টেস্ট রাস্তার নিয়ম–কানুনের ওপর টেস্ট করা উচিত। অ্যাটলিস্ট তিন থেকে ছয় মাসের ট্রেনিং, কদিন পর এরাও ড্রাইভ করবে, এরা প্রত্যেকেই মানুষের জীবন নিয়ে প্রতিদিন খেলছে। হয়তো এ লেখা কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার চোখে পড়বে, হয়তো আমাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন হবে!

ঈদের দিনে আমরা শোক পালন করব।

এর মাঝে বান্ধবীর বাসা থেকেও খাবার পাঠিয়েছে, বন্ধুবরকে একদম সিঁড়ির কোনায় রেখে যেতে বললাম, করোনা আমাদের কী ভীষণ অসামাজিক করে তুলেছে। তবে তাই হোক। আমি চাই না এটা আমার পরিবারের থেকে অন্য কাউকে আক্রান্ত করুক। আমার বাসায় আমরা তিনজন এখন আক্রান্ত!

বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ফোন করছে, কতগুলো স্যাড নিউজ আর শেয়ার করব? শাশুড়িকে ঈদ মোবারক জানালাম, তাঁর ছেলের বা আমার কোভিডের কথা আপাতত জানানো যাবে না তাঁকে, হাসিমুখ দেখা ছাড়া আর কোনো কিছু চান না তিনি। সবাই সুস্থ হলে সে গল্প করব তাঁর সঙ্গে একদিন। শ্বশুরের কবর দেখে ফিরেছেন মাত্রই! চলবে...