যুক্তরাষ্ট্রেও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়, তবে...

>
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি
করোনাভাইরাসে পাল্টে গেছে জীবনের বাস্তবতা। আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। করোনায় জীবন নিয়ে লিখছেন অনেকেই। এই চিকিৎসকও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর সিরিজ লিখছেন। আজ পড়ুন ১৬তম পর্ব।

আজ বেশ ভালো বোধ করছি। সবাইকে নাশতা দেওয়ার মতো এনার্জিও আছে। সবাইকে নাশতা দিলাম। মেয়ে বেশ সাফার করছে, ব্যথা, এনার্জি লস, অল নাইন ইয়ার্ড। নাশতা করে ওষুধ খেতে বললাম।

যখনই খারাপ লাগছে, এসে জিজ্ঞাস করছে কেন এমন লাগছে, কেন অমন লাগছে? কী করবে? পুওর কিড! ঠিকমতো খেয়ে নিতে বলছি, এনার্জির জন্য। দুদিন আগে মাছ আনতে বলেছিলাম, ফ্রিজে ফেলে রেখেছি, আরেক দিন গেলে ঠিক নষ্ট হবে। রাঁধতে ইচ্ছা নেই, আবার সবার টেস্টেরও চেঞ্জ লাগবে। মাছ, সবজি সব নষ্ট হবে দেখে চুলায় প্যান বসালাম। আমেরিকান স্টাইল রেড স্ন্যাপার, হোল ফিশ ফ্রাই উইথ স্পিনাচ, মাসরুম, এসপ্যারাগাস, আলু আর সঙ্গে থাই টম ইয়াম স্যুপ। মেয়ে আর মেয়ের বাবার পছন্দ। ছেলেকে নিয়ে টেনশন। তবে ওকে এ বছর একটু একটু মাছ খেতে শেখাচ্ছি। কাঁটা ছাড়া মাছ একটু দিলে খেয়ে নেয়...দেখি কী করে!

ঘণ্টাখানেকে মাছ বেক করে খেতে ডাকলাম। সবাই আগ্রহ করেই খেয়েছে।

বিকেলে আমি আর মেয়ে ঠিক করলাম গাছ থেকে আঙুর তুলব! কী করব ভাবিনি। একটা নাসপাতিও ঝুলছে, মেয়েকে সেটাও তুলতে বললাম। সে কয়েকটা তুলে আর ইন্টারেস্ট পায়নি। সব ফেলে এসেছে। আমিও সময় নষ্ট না করে সব নিয়ে এলাম। এই আঙুর কেউ খাবে না। কাউকে দিতে সমস্যা নেই। কারণ, মুখে মাস্ক দিয়ে আর হাতে গ্লাভস পরে তুলেছি। তবে কাউকে দেব কি না, তারা সেটা কীভাবে নেবে, ভেবে আর তুলতে মন চায়নি।

রাতেরটা রাতে বোঝা যাবে। সন্ধ্যায় ফোন দিলাম এক মামাকে কী অবস্থা জানতে। মা এখনো কাঁদছে। দুই ঘণ্টা পর নানা–নানির পাশে মামার কবর হবে। লোকজনে বাড়ি ভরা।

জীবন! মামা তাঁর ছেলেমেয়ে অন্তঃপ্রাণ ছিলেন! আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করুন।

মামা জানালেন মেজ মামার হেড ইনজুরি হয়েছিল! আমাদের দেশে তেমন ট্রমা সেন্টার নেই। ফাস্ট ট্রাক কোনো ইমারজেন্সি বিভাগ নেই। আধা ঘণ্টার মধ্যে তেমন কোথাও নিতে পারলে হয়তো বেঁচে যেতেন! আফসোস!

ইন্টার্নি করার সময় দেখেছি, কত লিমিটেড ফ্যাসিলিটি এবং রিসোর্স নিয়ে আমরা কাজ করি। ডাক্তার, পেশেন্ট, সবাই ভুক্তভোগী! এই দুর্দান্ত স্মার্ট ডাক্তাররা তেমন সুযোগ–সুবিধা পেলে মানুষের জীবনের আমূল পরিবর্তন হতো! আফসোস, হবে না! যেখানে একটি পর্দা কেনার হিসাব লাখ টাকা আর মানুষের দাম শূন্য, সেখানে এসব আশা বাতুলতা।

ট্রমা সেন্টারের কথা বলি! গ্রেডি হসপিটাল আটলান্টার গ্রেড ওয়ান ট্রমা সেন্টার! আটলান্টার বাঘা বাঘা ডাক্তার এখানে অনেকটা স্বেচ্ছাশ্রম দেন! যেকোনো ট্রমাতে বা অ্যাক্সিডেন্টে এদের ইমারজেন্সি অ্যাম্বুলেন্স জানে তাদের কী করণীয়। এরাও পেশেন্টকে অল্প সময়ে এসেস করে যত দ্রুত সম্ভব সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে বেস্ট চিকিৎসা যেখানে পাবে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিয়ে যায়। এখানে ডাক্তার হিসেবে আমরা স্পেসিফিক করে বলি না, ইভেন অনেক সময়ই পেশেন্ট যদি দূরের কোনো হসপিটালে যেতে চায়, এরা সেটাও করে না। জীবন বাঁচানো ফরজ বলেই এরা এ কাজগুলো করে। যাদের ক্ষেত্রে সময় লাগতে পারে, তাদের এয়ার লিফট করে নিয়ে যায়, সেই হসপিটালে যেখানে পেশেন্টের প্রপার চিকিৎসা হতে পারে। আমার দেশে এসব ভাবাও যায় না। ভিখারির আকাশ–কুসুম আশা করা অনুচিত! যেমন আমার মামা হসপিটালের পথে রাস্তাতেই মারা গেলেন। হয়তো বেঁচে যেতেও পারতেন!

যেটা আমার ক্ষেত্রেও হতে পারত। দুইবার অ্যাক্সিডেন্টের ক্ষত মন এবং শরীর জুড়েই আছে! না গাড়ির মালিক চিকিৎসার দায়ভার নেন, না প্রশাসন রাস্তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, না আর কেউ। সিস্টেম! শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ক্ষতি; সঙ্গে জীবনহানি হলে একজন ব্যক্তি এবং তার পরিবারের যে নিদারুণ ক্ষতি, সেটা সে পরিবারেরই হয়! কেউ সেটাকে তলিয়ে দেখে না। কেউ তার পরিবর্তন আনতে আগ্রহী নয়। প্রতিবছর রোড অ্যাক্সিডেন্ট ও নৌডুবিতে যে বিপুলসংখ্যক জনগণ মারা যায়, তাদের জীবনের মূল্য ১০-৫০ হাজার টাকা?

তবে সেসব দরিদ্র জনগণ হয়তো সে কটা পয়সাকেই বড় বলে মেনে নিয়ে, মৃত্যুর সঙ্গে আপস করে! কী ভীষণ অন্যায়কে আমরা বছরের পর বছর সাপোর্ট করে যাই! সেটাকেই নরমাল বলে মানি।

এখানে মানুষ মরে না রোড অ্যাক্সিডেন্টে?

অবশ্যই মরে।

তবে! এখানে একটি তবে আছে!

প্রতিটি অ্যাক্সিডেন্টের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত হয়, দোষী ব্যক্তির শাস্তি হয়! তবে হাজারো মানুষ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসে, পরিবার তার আপনজনের সঙ্গে আরও কিছুদিন হেসেখেলে বেঁচে থাকে।

যেসব চালক ভুল করেন, নিয়ম না মেনেন, অহেতুক মানুষের জীবন নিয়ে খেলেন, তাঁদের রাস্তায় চালানোর অধিকার নেই। তাঁদের যথাযথ শাস্তির আওতায় আনা উচিত। এ দাবি তো আমাদের সবার। একটি জীবন বাঁচানোর জন্য একজন নতুন সেফ ড্রাইভার কী খুব অন্যায্য দাবি? তার খরচও কিন্তু বেশি নয়।

চালক, চালকের সহকারী এবং এসব পরিবহনের মালিকের সদিচ্ছা এবং আইন বিভাগের আন্তরিকতাই পর্যাপ্ত!

আমার কষ্ট হয়, যখন ১৩ বছরের শিশুকে নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচার করে মারা হয়; নতুন জন্ম নেওয়া একটি শিশু থেকে শতবর্ষী মা, ছেলেমেয়ে–নির্বিশেষে ধর্ষণের শিকার হয়, খুন হয়; সামাজিক, অর্থনৈতিক, শারীরিক, মানসিক বা বৈবাহিক সূত্রে ভায়োলেন্সের শিকার হয়; নির্যাতন বা মৃত্যুমুখে পতিত হয়। পুরুষেরাও সামাজিক, পারিবারিক সহিংসতা বা নির্যাতনের শিকার হয়। আমরা কিছু তো করতে পারি! আমরা অনেক কিছুই করতে পারি, কিন্তু করি না। কারণ, এই পরিবেশে থেকে প্রতিটি নির্যাতনের সঙ্গে ওঠ–বস করতে করতে এসব নির্যাতনকে আর নির্যাতন মনে করি না।

স্বাভাবিক ভাবি। তার সঙ্গে যোগ হয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অবস্থানও কম দায়ী নয়। তবে এসব ভাবা আমার কাজ নয়। আমার চিন্তা গরুর জোয়াল টানতে টানতে মানুষের ভালো থাকা কাঁধে ঘাটা পড়ে যায়! চামড়া মোটা হয় বটে, কষ্ট অভ্যাস হয় বলে; কষ্টটা কমে না! কষ্টটা মিথ্যে হয়ে যায় না। আসুন আমরা একটু বদলাই! কষ্টটাকে আসলে কষ্ট বলে বুঝতে পারা, সেটা স্বীকার করাটাই প্রথম সোপান। তারপর না হয় চিন্তা করবেন এই কষ্টগুলো কমাতে কী করা যায়।

তবে এই করোনাকালে মাস্ক পরেই শুরু করুন। সঙ্গে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। স্যানিটাইজারের ব্যবহারে সতর্ক হোন। এটি ভীষণ দাহ্য। যদি সাবান–পানি হাতের কাছেই থাকে এবং সেটি সহজেই ব্যবহার করতে পারেন, স্যানিটাইজার থেকে দূরে থাকুন। করোনার বিস্তার রোধ করুন। নিজেরা সুস্থ থাকুন। একটি মৃত্যু প্রতিরোধ করুন। ভালো থাকুন। চলবে...