প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক ৬-৩-৩ বছর

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বর্তমান বিশ্বের বিস্ময় চীন। কী অর্থনৈতিক, কী রাজনৈতিক কিংবা সামরিক, সব দিকেই পৃথিবীর প্রথম সারিতে চীনের অবাধ বিচরণ। যে চীনকে নিয়ে এত কথা, এত আগ্রহ, তাদের শিক্ষাব্যবস্থা আসলে কেমন? ধারাবাহিক লেখার প্রথম পর্বে থাকবে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্বে থাকবে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে। তৃতীয় পর্বে থাকবে চীনে বিদেশিদের জন্য উচ্চশিক্ষা এবং শিক্ষকতা পেশার সুযোগ নিয়ে।

লেখাটি তাঁদের জন্য, যাঁরা চীনের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে জানতে আগ্রহী। চীনের শিক্ষাব্যবস্থা আসলে কেমন? আমাদের সঙ্গে তাদের মূলত কী কী পার্থক্য রয়েছে?

শিক্ষা মন্ত্রণালয়
শিক্ষা মন্ত্রণালয় চীনের জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষার মান, পরিকল্পনা এবং সবকিছুর সমন্বয় করে থাকে। মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিটি প্রভিন্সে, স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে একটি শিক্ষা বোর্ড বা শিক্ষা অফিস আছে। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চীন সরকার ও জনগণ সম্মিলিতভাবে একটি দুর্দান্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করেছে। তবে চীনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, বিশাল জনসংখ্যা এবং কোথাও কোথাও নিম্ন-মাঝারি অর্থনৈতিক স্তরের কারণে সবার জন্য শিক্ষার বিকাশ এখনো অনেক সমস্যার মুখোমুখি। চীনা শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পরিকল্পনা, এমনকি জীবনের বিকাশ ও জীবিকার পরিকল্পনার জন্যও সহায়ক।

একবিংশ শতাব্দীতে চীন সরকার শিক্ষাকে উন্নয়নের অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতিগত অবস্থান ঠিক করেছে। ‘বিজ্ঞান ও শিক্ষার মাধ্যমে দেশকে পুনরুজ্জীবিত করার’ কৌশলগত নীতিকে সামনে রেখে শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়েছে। বর্তমানে সরকারের নীতিগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হলো শিক্ষা। বর্তমান বিশাল অর্থনীতির জিডিপির ৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করে চীন (যুক্তরাষ্ট্র ৬ দশমিক ২ শতাংশ, যুক্তরাজ্য ৪ দশমিক ২ শতাংশ)। ‘আধুনিকীকরণের চ্যালেঞ্জ, বহির্বিশ্বের মুখোমুখি এবং ভবিষ্যতের মুখোমুখি হওয়া’ চীনের শিক্ষাব্যবস্থার দিকনির্দেশনা এবং এটি শিক্ষামূলক সংস্কার ও নির্মাণের দিকনির্দেশকও বলা চলে। সরকারি ও বেসরকারি, সব ক্ষেত্রে সর্বস্তরের শিক্ষায় প্রণোদনাসহ প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

চীনা শিক্ষাব্যবস্থাকে নিম্নলিখিত পর্যায়ে বিভক্ত করা যেতে পারে:

প্রাক্–বিদ্যালয় শিক্ষা
চীনে যদি কখনো দেখেন ২-১৮ মাসের বাচ্চা মা–বাবা অথবা অভিভাবকের সঙ্গে কোনো প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। অনেক বড় শহরে জিম্বারু, কিন্ডিরু, কিন্ডিবেবি নামে অনেক প্রতিষ্ঠানের দেখা মেলে, যেগুলো মূলত শারীরিক গঠনের প্রতি জোর দেয়। মূলত ৩-৬ বছর বয়সী বাচ্চারা কিন্ডারগার্টেন বা প্রাক্‌–প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে শিক্ষাজীবন শুরু করে। চীনে সারা দেশে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কিন্ডারগার্টেন, ৯ লাখ প্রাক্‌-প্রাথমিক (শৈশবকালীন) শিক্ষক ও কর্মচারী এবং প্রায় ২২ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। শিশুদের ভর্তির হার প্রায় ৪৫ শতাংশ। বড় ও মাঝারি আকারের অর্থনৈতিকভাবে উন্নত শহরগুলোতে কিন্ডারগার্টেনগুলো সাধারণত বাচ্চাদের প্রাক্‌-বিদ্যালয়ের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে থাকে। এদের অধিকাংশই বেসরকারি খাতে পরিচালিত। শৈশবকালীন শিক্ষার বিকাশ শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে অগ্রসর হয় এবং কিছু শহরে প্রাক্‌-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার প্রথম বছরে ভর্তির জনপ্রিয়তা লক্ষ করা যায়। তা কী শেখানো হয় কিন্ডারগার্টেনগুলোতে? আসলে এ প্রশ্ন করা উচিত, কী শেখানো হয় না বাচ্চাদের। খুব ছোট থেকেই তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়, যেমন নিজে নিজে (চপস্টিক বা চামচ) খাওয়া, নিজে নিজে কাপড় পরিধান করা, নিজের বইপত্র ও খেলনা গুছিয়ে রাখা, সহপাঠীদের সঙ্গে মিলেমিশে খেলা, ক্লাসরুম মেনার ইত্যাদি। এক্সট্রা কারিকুলার হিসেবে থাকে নাচ, গান, বিভিন্ন দিবসে পারফরম্যান্স, কারাতে, কুংফু ইত্যাদি।

মোটকথা, শিক্ষাব্যবস্থার প্রাথমিক ধাপেই স্বাবলম্বী, বিনয়ী, সহযোগিতামূলক আচার–ব্যবহারের খুঁটি গেড়ে দেওয়া হয়। যেহেতু অধিকাংশ মা-বাবাই চাকরি, ব্যবসা বা অন্যান্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত, কিন্ডারগার্টেনগুলোতে বাচ্চারা সাধারণত সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত থাকে। বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনগুলো সাধারণত খুব খরচে হয় এবং প্রতিটি কিন্ডারগার্টেনে পর্যাপ্ত খেলাধুলার সামগ্রী ও উপকরণ রয়েছে।

প্রাথমিক শিক্ষা
সাধারণত ৬-১১ বছর বয়সী শিশুরা প্রাথমিক বিদ্যালয় শুরু করে। মোট ৫ লাখ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রয়েছেন ৬৫ লাখ শিক্ষক। ১৩ কোটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রয়েছে (শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনুপাত ১:২০)। স্কুলগামী বয়সী শিশুদের ভর্তির হার ৯৯ দশমিক ১ শতাংশ। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সাধারণত স্থানীয় সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়, তবে কিছু কিছু আবার ব্যক্তি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো দ্বারাও প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়। প্রায় প্রতিটি প্রাথমিক স্কুলেই বড় খেলার মাঠ থাকে। শারীরিক শিক্ষা, গণিতের বহুমুখী ব্যবহার ছাত্রছাত্রীরা প্রথমে এখান থেকেই লাভ করে, যেটা ভবিষ্যতে ম্যাথ অলিম্পিয়াড, প্রোগ্রামিং, শারীরিক কসরতের বিশ্বজুড়ে সুনাম দেখেই বোঝা যায়। চীনাদের গণিত শিক্ষা (এমনকি যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ) আমাদের থেকে একটু অন্য রকম। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ডিজিটাল খেলার সামগ্রী, কার্টুনের ব্যবহার প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অতিমাত্রায় লক্ষণীয়। স্কুলের সময় সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত হয়।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

মাধ্যমিক শিক্ষা

১২-১৭ বছর বয়সীরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে। জুনিয়র উচ্চবিদ্যালয়, সাধারণ উচ্চবিদ্যালয়, বৃত্তিমূলক উচ্চবিদ্যালয় এবং কারিগরি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত। ‘সাধারণ মাধ্যম’ বিদ্যালয়গুলোকে জুনিয়র হাইস্কুল এবং উচ্চবিদ্যালয়ে বিভক্ত করা হয়, যার প্রতিটিতে তিন বছর করে স্কুল–ব্যবস্থা রয়েছে। জুনিয়র হাইস্কুল স্নাতকদের (সম্পন্নকারী) কিছু অংশ উচ্চবিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। কিছু অংশকে ভোকেশনাল হাইস্কুল ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়। দেশে প্রায় ১ লাখ মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে সাড়ে ৯ কোটি শিক্ষার্থী রয়েছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো সাধারণত স্থানীয় সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়। খুব সম্ভবত, এ সময়ে চীনা ছাত্রছাত্রীরা তাদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করে। অত্যধিক পড়াশোনা আর হোমওয়ার্কে নাকাল ছাত্রছাত্রীরা তাদের মাধ্যমিকের সময়টাকে খুব বেশি উপভোগ করতে পারে না। যদি কোনো চীনা নাগরিক ইস্পাতসম কঠিন হয়ে থাকে, তার শুরুটা এখানেই হয়। আবার জাতিগতভাবে চীনারা যে খুব প্রতিদ্বন্দ্বিমূলক হয়, এটা খুব সম্ভবত এই সময়ে শিখে থাকে। অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী স্কুলের আবাসিক হলে থাকে এবং সপ্তাহান্তে বাড়ি ফেরে। সকাল ৭টায় নাশতার পর তাদের সংগ্রাম শুরু হয়, চলে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। সন্ধ্যা ৬টা-৭টায় রাতের খাবার শেষ করে আবার জমানো হোমওয়ার্ক ক্লাসে বসেই শেষ করে। সাধারণত একজন শিক্ষক থাকেন সে সময় দেখাশোনা করার জন্য। সবকিছু শেষ করে রাত ১০টায় ঘুমাতে যায়। পরদিন আবার সেই পড়াশোনার চাপ, বিরামহীনভাবে। এটার অন্যতম কারণ হলো গাও কাও (Gao Kao) বা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় (একটি আসনের জন্য ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অনুপাত) অংশগ্রহণ করে বলে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয় শিক্ষার্থীদের। সেদিক বিবেচনায় আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভাগ্যবান ভাবতেই পারে। প্রায় প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর কাছে এই মাধ্যমিক শিক্ষার সময় অপাংতেয় হিসেবেই বিবেচিত হয়।

পরিশেষে আমরা দেখতে পাচ্ছি, চীনের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের কিছুটা ফারাক রয়েছে। আমাদের দেশে যেমন মাদ্রাসা শিক্ষা, ইংরেজি ভার্সন, জাতীয় শিক্ষাক্রম রয়েছে, সেখানেও তেমনি উচ্চবিদ্যালয়, কারিগরি শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা নামে ভাগ করা রয়েছে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমাদের যেমন ১২ বছর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন (৫-৫-২) তাদের শিক্ষার্থীরাও ১২ বছর (৬-৩-৩) সম্পন্ন করে থাকে। চলবে...

*আগামী পর্বে পড়ুন: চীনের শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার

*লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, গুয়াংডং ইউনিভার্সিটি অব ফিন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিকস, চীন