ছলনাময়ী-২

অঝোরধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। শহরের পথ পানিতে তলিয়ে গেছে। সিটি করপোরেশনের লোক পানি সরানোর চেষ্টা করছে। পানিতে ডাস্টবিনের আবর্জনা ভেসে উঠছে। হলদে মলও দেখা যাচ্ছে। দেখতে বিশ্রী লাগছে। এমন সময় দুজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয় মুরাদের। বৃষ্টি অনেকটা কমে গেছে। বহুদিন পর বন্ধুরা মুরাদের দেখা পায়। কেমন আছিস বন্ধু? কত দিন দেখা নেই। তারপর কী করা হচ্ছে। তিন বন্ধুতে কিছুটা সময় আলাপচারিতা হয়। পরে পুরান টাউনে একটা চায়ের দোকানে বসে তিন বন্ধু মিলে চা খাই। এরই মধ্যে মোবাইলে মেসেজের রিংটোন বেজে ওঠে। মুরাদ মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে সেই মেয়েটির মেসেজ। যার জন্য সে শহরে এসেছে।

মেসেজে লেখা, ‘কেমন আছে? তুমি কি রাগ করেছ?’

সঙ্গের এক বন্ধু বলে, ‘কিরে মুরাদ কার মেসেজ?’

মুরাদ বলে, ‘একটা মেয়ের মেসেজ।’

আরেকজন বলে, ‘কী লিখেছে?’

মুরাদ আর কিছু না বলে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটতে থাকে। সিদ্দিক বাজারের গলি ধরে হাঁটছে। নাজিরা বাজারের মোড়ে এসে থামলো। হাজীর বিরিয়ানির হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হোটেলে মানুষের ভিড়। সারি সারি রিকশা জ্যামে আটকা। রাস্তার ওপাশে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে মুরাদ। এমন সময় মোবাইলে কল আসে। আলো নামের মেয়েটির ফোন। রিসিভ করতেই আলো বলে উঠে,

‘প্লিজ ফোনটা রাখবে না।’

মুরাদ বলে, ‘আশ্চর্য ফোন করেই এই কথা! আমি কি কখনো তোমার ফোন কেটে দিয়েছি?’

মুরাদের কথা শুনে আলোর মনে স্বস্তি মেলে। সে কত কিছুই না ভেবেছে। মুরাদ কি তাকে একেবারে ভুলে যাবে। আমি নাহয় আঁধারের যাত্রী। ও তো আলোর পথে হাঁটে। সেখান থেকে একটু আলো দিয়ে আমাকে আলোকিত করতে পারে না সে।

মুরাদ বলে, ‘ফোন করে কথা যদি না–ই বলো, তাহলে ফোন করলে কেন?’

আলো বলে, ‘কী করছ?’

‘নাজিরা বাজার হাজির বিরিয়ানির হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।’

‘বিরিয়ানির খাবে নাকি?’

‘খেতে পারলে ভালো লাগতে কিন্তু পকেট শূন্য। তাই দেখে ঘ্রাণ শুঁকছি। আর মনে মনে খাচ্ছি।’

‘কী সব বলছ, মনে মনে খেলে কী আর খিদে মিটবে?’

‘হ্যাঁ মিটবে! এই শহরে অনেকে মনে মনে উন্নত মানের খাবার খায়। যারা মনে মনে খায়, তারা অনেক বড় মনের মানুষ হয়। তাদের দুঃখ কষ্ট খুব কম হয়। আমি তাদের একজন হওয়ার চেষ্টা করছি।’

‘আমি তোমার কথা খুব কম বুঝি। আমি জানি তুমি একটা গভীর জলের মাছ। তোমাকে বোঝা এত সহজ না।’

‘তুমি যা ভাবছ, আমি তা কি না জানি না। তবে নিজেকে কখনো দুঃখী বলে মনে হয় না।’

‘তুমি অনেক ভালো মানুষ। তুমি চাইলে আমি তোমাকে বিরিয়ানির খাওয়ার টাকা দিতে পারি। আচ্ছা টাকা দিলে নেবে তো?’

মুরাদ একটা হাসি দিয়ে বলে, ‘তুমি দেবে কেন?’

‘বন্ধু হিসেবে দেব। তুমি নাহয় পরে শোধ করে দেবে।’

‘আমাকে ঢাকাপয়সা দিয়ে, আজ পর্যন্ত খুব কমসংখ্যক মানুষই তা ফেরত নিতে পেরেছে। আর তুমি যে ধরনের মেয়ে, তুমি তো নিতেই পারবে না। থাক বাবা তুমি বরং তোমাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকো। আমি ফোনটা রাখছি।’

ওপাশ থেকে আলো বলে, ‘ফোনটা কাটবে না বলছি। আগে বলো, আমি কী ধরনের মেয়ে?’

‘আসলে আমার মনে হয়েছে তুমি আমাকে টাকা দিলে ফিরিয়ে নিতে পারবে না। কেননা, ওই দিন তোমার কাছ থেকে ৫০ টাকা চাইতেই তুমি দিয়ে দিয়েছ।’

‘তোমার বিকাশ নম্বর আছে?’

‘হ্যাঁ, যে নম্বরে কথা বলছি, এটাই আমার বিকাশ নম্বর।’

সেন্ড মানির একটা মেসেজ আসে। এক হাজার বিশ টাকা। মানুষের আবিষ্কার কত দূর এগিয়েছে। বলতে না বলতে টাকা চলে এল। এরই নাম হলো আধুনিকতা। মুরাদ এক হাজার টাকা ক্যাশআউট করে হাতে নেয়। পকেট গরম আছে। এই সুযোগে ভালো কিছু খেয়ে নিতে হবে। সে ঠিক করেছে বিরিয়ানি আর খাবে না। হাঁসের মাংস দিয়ে গরম ভাত খেতে পারলে ভালো হতো। ঢাকার ঐতিহ্য এই পুরান টাউন। আর এই টাউনে অবশ্যই কোনো না কোনো হোটেলে হাঁসের তরকারি পাওয়া যাবে। বেশ কয়েকটা হোটেল দেখেছে, হাঁসের মাংস পেল না। এদিকে পেঠের খিদে বেড়ে চলেছে। বংশালে ইমাম আলী নামের একটা হোটেল আছে, সেখানে একবার হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছিল মুরাদ। সেখানেও হাঁসের মাংস পেল না। শেষ পর্যন্ত দুপুরের খাবার খাওয়া হলো না।

বিকেলে সুপরিসর নগর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলে আসে মুরাদ। সবুজ ঘাসের ওপর বসল। বসে থাকতেও ভালো লাগছে না। ক্লান্তিতে সারা শরীর জড়িয়ে আছে। শেষ পর্যন্ত নরম সবুজ ঘাসের ওপর নিজেকে সঁপে দেয়। মুরাদের দৃষ্টি আকাশের দিকে। কত সুন্দর আকাশ। সেই আকাশের বুকে উড়ে বেড়াচ্ছে বিহঙ্গ। বিহঙ্গের কিচিরমিচির শব্দ কখনো কখনো বড্ড বেশি ভালো লাগে। আবার বিরক্তও লাগে।

মুরাদ বুঝতে পারছে, তার খিদে বিদায় নিয়েছে। পকেটে দুটি পাঁচ শ টাকার নোট। পেট খালি। বিষয়টা ভাবতে একটা অন্য রকম অনুভূতির গন্ধ পাচ্ছে। কিন্তু মুরাদের হাঁসের মাংস খাওয়ার ইচ্ছেটা রয়ে গেল। আলোকে ফোন করলে কেমন হয়। আলোর হাতে রান্না করা হাঁসের তরকারি দিয়ে গরম গরম ভাত খেতে পারলে মন্দ হতো না। আমি ভাত খাচ্ছি এর মধ্যে লোডশেডিং হবে। ফ্যান বন্ধ হয়ে যাবে। গরমে আমার শরীর গেমে যাবে। আলো হাতপাখা দিয়ে বাতাস করবে। আমি আলোর সৌন্দর্য দেখতে ভুল করব না। খাবার শেষ আলোর হাতে একটা পান খাওয়া যেতে পারে। আলো নিজ হাতে পান বানিয়ে আনবে। আমি পান মুখে দিয়ে আলোর চলে যাওয়া আটকাতে পেছন থেকে ওর শাড়ির আঁচল ধরে টান দেব। আলো অবাক দৃষ্টিতে ঘুরে তাকাবে আমার দিকে। এক হাতে শাড়ির একটা অংশ বুকের ওপর ধরে রাখবে। আমি তাকিয়ে থাকব আলোর চোখের দিকে। আলোও তাকাবে আমার চোখের দিকে। দুজনের দৃষ্টির আলিঙ্গন হবে। পৃথিবীর আর যত সব তুচ্ছ হবে। হঠাৎ আলো বলবে চাঁদ কী করছ?

আমার ভালোবাসার ঘোর কাটবে। একটু হেসে আলোকে কাছে ডাকব। আলো এসে আমার পাশে বসবে। একবুক আশা জন্ম নেবে আলোর বুকে। হয়তো আমার একটু ছোঁয়া পেতে মন চাইবে তার। আমি চুপটি করে বসে থাকব। নিজ থেকে আলো আমার দিকে হাত বাড়বে। আমি তখন উঠে দাঁড়াব। বলব, তুমি শুধু সুন্দরী নও আলো। তোমাকে ঘিরে এই পৃথিবীর সবকিছুই সুন্দর।

এসব ভেবে আলোকে ফোন করে মুরাদ। রিং হয় কিন্তু রিসিভ করছে না। মুরাদ ভাবে, বেচারি বোধ হয় তার খদ্দেরের সঙ্গে মেতে আছে। What a strange life. The body comes to the pull of the body. Money comes. The human race needs money so much.

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ছলনাময়ীর সঙ্গে কথা হলো না। সবাই উদ্যান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাই আর মুরাদও উঠে বসে। এবার পেট বাবাজি সজাগ হয়ে গেছে। খিদে বেড়ে গেল। শরীরে শক্তি নেই। মাথাটা খানিকটা ঘুরছে। মোবাইল ফোন বেজে উঠল।

মুরাদ বলে, হ্যালো ছলনাময়ী!

ওপাশ থেকে আলো বলে, কী, আমি ছলনাময়ী!

‘এক ঘণ্টা ধরে তোমাকে ফোন করছি, তুমি রিসিভ করছ না।’

‘মিথ্যা বলবে না, তুমি শুধু দুটি কল করেছ।’

‘ওই হলো, আমি তো এক ঘণ্টা ধরে তোমার ফোনের অপেক্ষায় আছি। এদিকে আমার পেটে আগুন জ্বলছে।’

‘আগুন চলছে মানে কি? তুমি কি এখনো খাওনি।’

‘না।’

‘কী আশ্চর্য! তোমাকে না টাকা দিলাম, খাওয়ার জন্য।’

‘এই শহরে টাকা দিয়ে সব হয় না। আমি হাঁসের তরকারি দিয়ে গরম ভাত খাব। কোনো হোটেলে হাঁসের মাংস পেলাম না, তাই খাওয়াও হলো না।’

‘এই পাগল, তুমি না বলেছিলে, বিরিয়ানি খাবে?’

‘আমি ফোন রাখছি, কথা বলার শক্তি পাচ্ছি না। আমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মেইন গেটের সামনে আছি।’

বলে ফোনটা রেখে দিল মুরাদ।

মুরাদ গেটের সামনে আসতে দেখে একটা রূপবতী মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি মুরাদের কাছে এসে বলে,

‘কিছু মনে করবেন না। আপনার নাম কী?’

মুরাদ বলে, ‘তোমাকে কি ছলনাময়ী পাঠিয়েছে?’

মেয়েটি ভুরু কুঁচকে বলে, ‘আপনি কি বলছেন, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’

‘না বোঝার কিছু নেই। তোমাকে আলো নামের ছলনাময়ী পাঠিয়েছে কী?’

‘আপনি তাহলে চাঁদ। চলুন আমার সঙ্গে।’

‘আপনি কি ডায়না?’

মেয়েটি অবাক হয়ে বলে, ‘আপনি জানালেন কী করে?’

‘অনুমান করে।’

ডায়না বলে, ‘অনুমান করে অনেক কিছু বলা যায়। সেটা বুঝতাম। কারও নাম বলা যায়, এটা তো জানতাম না!’

মুরাদ চুপ করে আছে। কিছু বলছে না। ডায়না মুরাদকে রিকশা করে নিয়ে তার বাসাতে যায়।

ডায়নার বাসাতে মুরাদ বসে আছে। মুরাদের সামনে গরম ভাত ও হাঁসের মাংসের তরকারি। সারা দিনের উপোষ মুরাদ তার পছন্দের তরকারি দিয়ে মজা করে খেয়ে নিল। এবার মুরাদের মনে হচ্ছে একটা পান খেলে ভালো লাগবে। সুগন্ধি জর্দা দিয়ে পান খেলে শরীরে আলাদা একটা ভাব চলে আসে। ডায়নাকে কী বলবে, ‘যে পান আছে কি না? না থাক এমনিতে মেয়েটি আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছে।’

ডায়না বলে, ‘মুরাদ সাহেব, আমি আপনার কথা আলোর কাছে অনেক শুনেছি।’

মুরাদ দেখে ডায়না চোখে কাজল পড়েছে, ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে খোলা চুলে মুরাদের পাশে এসে বসে। মেয়েটাকে একটু অন্য রকম লাগছে। মেয়েটি তো এমনিতে রূপবতী। তার ওপরে সেজেগুঁজে এসেছে। মুরাদ জানতে চায়,

‘এই বাসাতে আর কে কে থাকে।’

ডায়না একটু হেসে বলে, ‘আমি আর আমার বান্ধবী আলো। আরেকটা কাজের মেয়ে আছে। সে সারা দিন থাকে বাসাতে। এবং কাজটাজ শেষ করে সন্ধ্যার আগেই চলে যায়। তবে আজ রাত আপনি আর আমি থাকব।’

এই কথা শুনে মুরাদ একটুও বিচলিত হলো না। অতি সহজ ভঙ্গিতে মুরাদ বলে, ‘ও আচ্ছা। আপনার বান্ধবী কোথায়?’

‘আলো তিন দিনের জন্য একটা বিশেষ কাজে চট্টগ্রাম গেছে। আপনাকে সেবা করার দায়িত্বটা আমাকে দিয়ে গেছে।’

তিন দিনের জন্য নতুন কোনো ক্লানের সঙ্গে আছে আলো। সেটা মুরাদ জানে। শরীর দিয়ে ব্যবসা। Runs in all countries of the world.

It is also going on in Bangladesh.

রাত বাজে ১০টা। ডায়না মুরাদের সামনে বসে হাতের চুড়ি নাড়াচাড়া করছে। মুরাদ বলে, ‘তোমাদের ক্ষমতা বেশি। তোমরা সবই পারো। ক্ষুধার্ত মানুষকে পথ থেকে তোলে এনে তার মুখে অন্নও দিতে পারো। আবার তার ওপর অতিরিক্ত অধিকারও ফলাতে পারো। এটার নাম জীবন নয়।’

মুরাদের কথা শুনে ডায়না কিছু ভাবেনি, বরং তার বুকের ওপর থেকে শাড়িটা সরালো। Just for attraction.

এবার মুরাদ ডায়নার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল। ডায়না বুকের কাপড়টা ঠিক করে, হাতজোড় করে বলে,

Please don't mind. I just matched the word Alo.

মুরাদ বলে, ‘কী বুঝলেন?’

‘You are not like other men.’

মুরাদের চোখের দিকে ডায়না অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই চোখে প্রেম নেই এটা মানতে পারছে না। মুরাদের চোখে প্রেমের সাগর দেখতে পাচ্ছে ডায়না। সেই সাগরে সাঁতার কাটার ইচ্ছে করছে। কিন্তু সব ইচ্ছে পূরণ হয় না। আর তাই মুরাদকে চলে যেতে বলে। মুরাদ দুই কদম এগিয়ে বলে,
‘ভুল করবেন না। আপনি ও ছলনাময়ী, আপনারা হলেন মহান। তাই সবার তরে প্রেম বিলান। সেই প্রেম কখনো একজনের জন্য হয় না। আপনার মতো একজন রূপবতী মেয়েকে জীবনের সঙ্গে জড়ানো, বলতে পারেন আমার নিজেরও সেই ভাগ্য নেই।’

ডায়না মুরাদের কথা শুনে বিস্মিত। ভেতরের কথাটাও লোকটা বলে ফেলে। মুরাদের হাতটা একটু ধরতে চায় ডায়না। মুরাদ সেই সুযোগ না দিয়ে বেড়িয়ে আসে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রাতের রাস্তাটা অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। মুরাদ হাঁটছে আর ভাবছে, ডায়না নিশ্চয়ই আমার কথা ভাবছে। হয়তো জানালা দিয়ে আকাশের তারার দেখছে। আবেগে চোখ দিয়ে দুফোঁটা অশ্রুও ঝরাচ্ছে। এরই মধ্যে আলোর ফোন আসবে। ডায়না একটু দেরি করে ফোন রিসিভ করবে। বলবে তোকে লোকটা ছলনাময়ী বলে ডাকে। আলো বলবে, ও এমনি। এবং ফোন ধরে রেখেই নৈঃশব্দ্যে কিছুটা সময় অতিবাহিত করবে।

লেখক: গল্পকার। [email protected]


আরও পড়ুন: ছলনাময়ী