কোভিডের কারণে পাওয়া ছুটি ১০ বছরেও পাইনি

করোনাভাইরাসে পাল্টে গেছে জীবনের বাস্তবতা। আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। করোনায় জীবন নিয়ে লিখছেন অনেকেই। এই চিকিৎসকও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর সিরিজ লিখছেন। আজ পড়ুন ১৮তম পর্ব।

গত রাতে ঘুম হয়নি আবারও। তবে এটা আমার দোষে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ক্যাফেইনের সাইড ইফেক্ট বাড়ছে মনে হয়। মানে চা খেয়েছিলাম। আবার এন্টিহিস্টামিনের প্রভাবে সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারছি না। মেয়ে দেখে আজ অনেকটা ভালো। নাশতা করে নিয়েছে।

মেয়ের বাবা গত রাতে আরলি ঘুমাতে গিয়েছে। এটা একটা ট্রেন্ড মনে হচ্ছে কোভিডের, স্পেশালি আমাদের ক্ষেত্রে। দ্বিতীয় সপ্তাহে আমাদের সিম্পটম খারাপ হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম আজ কেমন ফিল করছে, আমি কাশির শব্দেই উঠেছি। বলে ভালো, তবে চেহারা দেখে মনে হলো না। বলে ও–ও নাশতা করে নিয়েছে। জানি ওর রুচি কমে গেছে, ও এখনো জানে না!

সে যা–ই হোক। সকালে ঠান্ডার/ কাশির ওষুধ খেয়েছে। মেয়েও তার ওষুধ খেয়েছে। চা দরকার আমার, আমি ঘুম তাড়াতে পারছি না। কিছুক্ষণ পর ছেলে এসে তার মতো নাশতা-দুধ, সিরিয়াল খেয়ে গেল। ভালো যে আমি এখন অনেকটাই সুস্থ। নয়তো অসুস্থ লোকজনের জন্য কিছুই করতে পারতাম না।

চা–টা খেতে খেতেই দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেল, ভাবলাম লাঞ্চটা দিয়ে দিই। চিকেন কাবাব করেছিলাম, তাই দিয়ে সবার খাবার হয়ে যাবে, স্যান্ডউইচ বানালে, সুপ করব কি না ভাবছি। মেয়ের বাবা ঘরে দেখি জ্যাকেট পরে ঘুরছে, চিলস হচ্ছে তার, বিরক্ত হয়ে বাইরে গরমে হাঁটতে যাবে ভাবছে। আমি জানি আরও অসুস্থ হবে, কিন্তু যদি ভালো ফিল করে হাঁটাহাঁটি করে আসুক বলে, স্যান্ডউইচ খেয়ে যেতে বললাম! মেক্সিকান স্টাইস স্যান্ডউইচ উইথ ইন্ডিয়ান টুইস্ট! খেয়েদেয়ে সবাই যে যার মতো ব্যস্ত হলেন। আমার কর্মস্থলে জানিয়ে দিলাম এ মাস আর কাজে ফিরব না। ইশ, এটা যদি কোভিড টাইম না হতো, এমন ছুটি আমার গত ১০ বছরে আসেনি। আমি বিশ্বভ্রমণে বেরোতাম! আবার কত কাজ জমা হয়ে আছে। একসময় পেইন্ট করতাম, সুতার কাজ করতাম। মাঝে মনে হলো গয়না বানাব, সেলাই করব! পেইন্টিংটা ঠিকমতো। শিখতে ইচ্ছা, ওদিকে বাগান পড়ে আছে, কতগুলো গাছ লাগানোর অপেক্ষায়! সেগুলো মরে গেলে মন খারাপ হবে। আবার নিজে মরে গেলেও কত কিছু অধরা থেকে যাবে! না করা থেকে যাবে! ছেলেমেয়ের কী হবে!

ছেলেমেয়ের কী হবে—ভাবতেই মনে হলো এখানে মানুষ কত সহজে স্টেপ ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন। তাদের মায়ের বা বাবার মতোই বড় করে। হ্যাঁ, এরা হয়তো তাদের নিজেদের সন্তান নয়, তবে বেশির ভাগই তাদের প্রতি দয়াশীল। আবার সৎছেলেমেয়েও জেনেশুনেই সৎবাবা–মাকে ভালোবাসে, অ্যাটলিস্ট মনে ক্ষোভ রাখে না, তাদের অসম্মান করে না। ব্যতিক্রম যে নেই, তা বলব না। তবে সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থা এমন যে যদি কেউ এসব সৎছেলেমেয়েকে কষ্ট দেয়, থাকার, খাবারের বা অন্য কিছু—চাইল্ড প্রটেকটিভ সার্ভিস তাদের এসব মা–বাবার কাছ থেকে নিয়ে নেয়—ফস্টার ফ্যামিলি খুঁজে দেয়, যারা এদের দায়িত্ব নিতে আগ্রহী। তারা যে ভীষণ ভালো থাকে তা হয়তো নয়, তবে অত্যাচার থেকে অনেকেই বেঁচে যায়।

এদের পড়াশোনা হয়, আর চাইল্ড প্রটেকটিভ সার্ভিস এদের খোঁজখবর রাখতেই থাকে বড় না হওয়া পর্যন্ত!

আমাদের ধর্মে বলে এতিমের সম্পদ, হক নষ্ট কোরো না।

অথচ আমরা তাদের হক প্রতিনিয়ত মেরে যাই। দ্বিতীয় বিয়ে আমার ধর্ম না করে না। অলমোস্ট প্রতি মা–বাবা–ই তাঁদের স্বামী বা স্ত্রী মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন অথবা ধরি জাস্ট বিবাহবিচ্ছেদের পরও বিয়ে করেন। তবে সমাজব্যবস্থা এমন যে মা তাঁর সন্তানকে বেশির ভাগ সময়ই দ্বিতীয় স্বামীর সংসারে নিতে পারেন না। বয়স ১৮ হলেও দেশের অবকাঠামোয় তাঁরা কাজ পান না। আবার বাবার দ্বিতীয় বউ তাঁর সৎসন্তানদের ভীষণভাবে থাকা, খাওয়া, শারীরিক, মানসিকভাবে নির্যাতন করেন। মায়ের বিয়ে হলে, সৎবাবা দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নয়, বেশির ভাগ মা–ও কাজ করেন না। তাঁরা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে স্বামীর ওপর নির্ভরশীল। তাঁদের এতিম ছেলেমেয়ে তার মায়ের/ভাইয়ের বা হয়তো চাচাদের সংসারে ভীষণ অবহেলায় বড় হয়!

এমন কি হওয়ার কথা? যাঁকে বিধবা বা ডিভোর্সি, বাচ্চা আছে জেনেই বিয়ে করছেন, তাঁর বাচ্চাটাকে মেনে নিতে এত অনীহা কেন? একটা এতিম বাচ্চাকে পালনে এত অনীহা এ সমাজে, তাদের প্রতি এত অবজ্ঞা কেন আমাদের?

লেখক
লেখক

অর্থনৈতিক কারণ যে মূল কারণ, তা তো জানি। ছেলে বা মেয়ে সম্পদে ভাগ বসাবে! কিন্তু সেটা তো তার জন্ম অধিকার! অনেক মা–বাবাকেই দেখি এসব ছেলেমেয়ে নিজেদের জীবনে সুখের অন্তরায় মনে করেন, পথের কাঁটা ভেবে তাদের খুন করতেও দ্বিধা করেন না। অথচ তাকে সেফ রাখা বাবা–মা হিসেবে আপনার দায়িত্ব, আমানত।

সৎবাবা–মাকেও বলি, সে আপনার রক্ত নয়, তবে আপনার পার্টনারের রক্ত বলেও তো তাকে দুমুঠো ভাত দেওয়া উচিত! অ্যাটলিস্ট ভাবুন অপরিচিত কারও প্রতি দয়া করছেন। তাদের প্রতি নির্দয় না হয়ে একটু ভালো হয়ে, ভবিষ্যৎ তো গড়ে দিতে পারেন! সম্পত্তির ভাগ নাহয় না–ই দিলেন বড় হলে, সে নিজের জন্যই রেখে দিন, বুড়ো বয়সে কাজে লাগবে। তবে আপনি যেটা করতে পারেন, তার থাকা–খাওয়া এবং পড়াশোনার ব্যবস্থা করে তাকে অ্যাটলিস্ট নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। আপনার মানবিকতায় এরাও মানবিক ব্যবহার শেখে, আপনার বয়সকালে আপনার হাতটা ধরেও রাখতে পারে। জাস্ট মানবিক হোন, নির্মমতা পরিহার করুন।

হ্যাঁ, আমাদের ধর্ম অ্যাডাপশন সাপোর্ট করে না। তবে মানবিকতা সাপোর্ট করে। এসব বাচ্চার হয়তো আপনার সম্পদে ধর্মীয় হক নাই, তবে আপনি চাইলে, আপনি এদের ভালোবেসে, আপনার সামর্থ্য থাকলে, আপনার সম্পদ হেবা করে দিয়ে যেতে পারেন, এটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যপার। কিন্তু ন্যূনতম যে কাজটি আপনি করতে পারেন তা হলো, এদের ক্ষুধায় খাবার দিতে পারেন, মাথার ওপরের ছাদটা হতে পারেন।

ভাইবোনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখা অবশ্যই দরকার। তারা আপনার দুঃসময়ে আপনার পরিবার বা সন্তানের দেখাশোনা করবে না, তাদের হক মেরে নিজেদের আখের গোছানোর চেষ্টা করবে...সেটা আপনি ভালো জানেন। তাই ভাইবোনদের নিজেদেরটা নিজেদের করার তাগিদ দিন, যেন আপনার অর্জনে তাদের কুদৃষ্টি না পড়ে।

যদি সংসার না টেকে, অন্য কারও প্রতি আসক্তি আসে বা পরিবারের মৃত্যুতে একা হয়ে যান, বাচ্চার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে নেবেন। নতুন সম্পর্ক বা বিয়ে করতে কোনো বাধা নেই, তবে এসব সন্তানের কথাটা মাথায় রাখবেন। নিজে যদি কাজ করতে না পারেন, যাকে বিয়ে করবেন, তার সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা পরিষ্কার করে নেবেন! বাবা–মায়ের সম্পর্ক বা বাবা–মায়ের সঙ্গে তাদের সন্তানের সম্পর্ক ভেঙে একটি টক্সিক সম্পর্কে জড়িয়ে সবাই সারা জীবন সাফার করার দরকার নেই। তবে সবাই পরিষ্কার মন নিয়ে এগোলে প্রতিটি সম্পর্কই দৃঢ় হতে পারে। সম্পর্কে নিরাপত্তা একটা বড় ব্যাপার। নিজেদের সন্তানদের এবং নিজেদের স্ট্যাবল সম্পর্কে রাখুন। জীবন কঠিন, তবে আমরাই তাকে নাটকীয় কঠিন করে তুলি। আমাদের নাটুকেপনা কমিয়ে একটু বাস্তববাদী হওয়ার সময় এসেছে, পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। একটি সন্তানকে নিজের বাবা–মা, আত্মীয়স্বজন এবং সৎবাবা–মা আত্মীয়স্বজনের নিপীড়ন থেকে চলুন সবাই রক্ষা করি। চলবে...

আরও পড়ুন: