৯০ বছর বয়সের যুবক হ্যারীর গল্প

কারাতে প্রশিক্ষণে হ্যারি। ছবি: সংগৃহীত
কারাতে প্রশিক্ষণে হ্যারি। ছবি: সংগৃহীত

দুই বাচ্চাকে কারাতে প্রশিক্ষণকেন্দ্রের দোজোতে (প্রশিক্ষণ ঘরে) দিয়ে দোজোর বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। সঙ্গে আছে আমার বউ আর মেয়ের বান্ধবীর বাবা–মা। সবাই একসঙ্গে সময় পার করার নিমিত্তে বিভিন্ন ধরনের গল্পে মশগুল। এখনকার প্রেক্ষাপটে করোনা ইস্যু আলোচনার অন্যতম বিষয়। কারাতে ক্লাবগুলোও সরকারের স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ মেনে চলছে, যেমন: সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাত স্যানিটাইজ করা, ট্রেনিংয়ের সময়ে শারীরিক কন্ট্যাক্ট এড়িয়ে যাওয়া ইত্যাদি।

আমরা চারজন বাইরে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে গল্পের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহনে ব্যস্ত। এ অবস্থায় দেখি এক বয়স্ক ভদ্রলোক কারাতের পোশাক পরে কালো ব্যাগ হাতে দোজোর দরজা দিয়ে বের হয়ে এলেন। ভদ্রলোক দেখতে বয়স্ক হলেও শরীরের পেটানো ভাব আর ঘাড় ও শারীরিক নড়াচড়া দেখে শরীরে বয়সের ছাপটা অনেক কম। তাঁর শারীরিক ফিটনেসের সঙ্গে ব্ল্যাক বেল্টটাকে যোগ করে মনে মনে তাঁর বয়স ৭০–এর আশপাশে হবে বলে ধরে নিলাম।

ভদ্রলোক এসে সবাইকে হাই বলে হাসতে হাসতে বলা শুরু করল, তোমরা বাইরে কেন? সবাই ভেতরে এসে তোমাদের বাচ্চাদের সঙ্গে যোগ দাও? সেই সঙ্গে কারাতের উপকারিতা সমন্ধেও বলতে থাকলেন, কারাতে শরীরকে খুব ফিট রাখে; নিজের মাথায় আঙুল দেখিয়ে বলল, মন খুব শক্তিশালী থাকে; সঙ্গে কয়েকটা ছোট ছোট পাঞ্চ আর কিক করে সেগুলো প্রমাণ দেওয়ারও চেষ্টা করল। ভদ্রলোক দেখি আবার খুব হাসিখুশিও। সামনের দাঁতগুলো দেখা যায়। মাথায় এখনো অনেক চুল আছে! তাকে দেখে অবশ্য নিজের মাথার কথা মনে পড়ে অনেক আফসোস হলো!

যাহোক, এই পর্যন্ত সবকিছু ভালোই লাগছিল। কিন্তু হঠাৎ দেখি ভদ্রলোক সামাজিক দূরত্বের কোনো তোয়াক্কা না করে আমার বউয়ের কানের কাছে মাথা নিয়ে গেলেন। ভাবলাম, কী আশ্চর্য! বুড়া আমার বউয়ের কাছে কেন গেলেন? কানের কাছে কেন মুখ নিয়ে গেলেন? আবার সবার সামনে! মনে মনে বলতে থাকলাম, এই বুড়া বয়সেও ব্যাটার শয়তানি যায়নি, সাহস কত! নিজের ভেতরে জ্বলন সহ্য করা ছাড়া কিছু বলতেও পারি না। বুড়া যে আবার ব্ল্যাকবেল্ট হোল্ডার!

তবে মনে মনে ভাবলাম, আমার বউয়ের মন জয় করা এত সহজ না! গত দেড় যুগেও আমি এখনো পুরোপুরি সফল হয়নি! আর তুমি বুড়া এই বয়সে! এসব ভেবে মনকে সান্ত্বনা দিলাম। ফিসফিস করে বউয়ের কানে কী যেন বলে ভদ্রলোক সবাইকে বাই বলে চলে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে বউকে জিজ্ঞেস করলাম, কী বললেন? উত্তরে জানলাম, ভদ্রলোক বলেছেন তাঁর বয়স ৯০ বছর! শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম! যারপরনাই আশ্চর্যান্বিত! পাশের ভাবি কাছে থাকার কারণে তিনি ভদ্রলোকের কথা শুনতে পেয়েছিলেন। ভাবি সমর্থন করে বললেন, তিনি ৯০ বছর বয়সের! নিজের কান–চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! এই বয়সের মানুষ হয়তো এখনো কিছুসংখ্যক আছেন, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ায়, কিন্তু তাই বলে এখনো কারাতে প্র্যাকটিস করা! হাত–পা ছুড়ে পাঞ্চ করা, কিক করা! এত হাসি-খুশি থাকা! এই বয়সে তো শরীর–মন সব শুকিয়ে খিটখিটে হয়ে যাওয়ার কথা!

এগুলো দেখেশুনে নিজের ভেতরে তার সমন্ধে জানার একটা আগ্রহ তৈরি হলো। মনে মনে ঠিক করলাম, ভদ্রলোকের সঙ্গে একদিন একটু কথা বলতে হবে। তাঁর জীবনপ্রণালি সমন্ধে জানতে হবে।

পরের সপ্তাহে কারাতেতে গিয়ে তাঁকে দেখতে পেলাম না। ভদ্রলোক হয়তো কোনো কারণে আসতে পারেননি। আবার পরের সপ্তাহে তিনি থাকলেও তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলো না ট্রেনিং শুরু হয়ে যাওয়ার কারণে। আমিও ছাড়ার পাত্র নই! চেষ্টা চালাতেই থাকব!

এবার পরের সপ্তাহে গিয়ে দেখি ভদ্রলোক দোজোতে আছেন আর ট্রেনিং শুরু হওয়ার আগে নিজে নিজে স্ট্রেচিং করছেন। ভাবলাম, এবার হয়তো একটু সুযোগ পাওয়া যাবে। কিন্তু দোজোতে ঢুকে সেনসের (কারাতে শিক্ষক) কাছে বাচ্চাদের উপস্থিতি মার্ক করার জন্য লাইন ধরতে হলো। মনে হলো, এবারও হয়তো কথা বলা হবে না! হঠাৎ লক্ষ করলাম ভদ্রলোক স্ট্রেচিং করতে করতে লাইনের কাছে আমার কাছাকাছি চলে এসেছেন। তাঁর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তাঁর দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি দিয়ে বললাম, আই অ্যাম বিং ইনসপায়ার্ড বাই ইউ! তিনি বলেন, হোয়াট আর ইউ টকিং অ্যাবাউট? আমি বললাম, আই টেল ইউ ইন আ সেকেন্ড।

বাচ্চাদের উপস্থিতি মার্ক করা শেষ হলে তড়িত দোজোর মধ্যখানে স্ট্রেচিং করতে থাকা ভদ্রলোকের কাছে চলে গেলাম। হাই, হাউ আর ইউ বলে তাঁকে মনে করিয়ে দিলাম যে আপনি অন্যদিন আমাদের কারাতে শেখার জন্য অনুপ্রাণিত করছিলেন। কারাতের উপকারিতা বলছিলেন। তিনি মনে করতে পারলেন কি না বুঝলাম না। সময় যেহেতু কম, আমি তাঁকে অন্য কোনো প্রসঙ্গে যাওয়ার আগেই প্রশ্ন করে ফেললাম।
আপনি কত বছর থেকে কারাতে শিখেছেন?

তিনি উত্তর দিলেন, যখন ৬২ বছর বয়সের ছিলেন, তখন থেকে। মানে হিসাবে তিনি প্রায় ২৮ বছর ধরে কারাতে শিখছেন।

ভদ্রলোক বলতে থাকলেন, আমি শুরু করেছিলাম আমার গ্র্যান্ড চিলড্রেনদের (নাতি-নাতনিদের) সঙ্গে। সেই থেকে আমি কারাতে উপভোগ করি।
আপনি ব্ল্যাক বেল্টের কোনো ধাপে আছেন, মানে কত ড্যান আপনি? (প্রসঙ্গত, ব্ল্যাক বেল্টের ১০টি ধাপ আছে। এর প্রতিটিকেই এক–একটি ড্যান বলে)
তিনি বলেন, চতুর্থ ড্যান।
আপনি কীভাবে নিজেকে এত ফিট রেখেছন?

তিনি বলেন, তোমাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে। নতুনভাবে সাজাতে হবে। তিনি বলতে থাকেন, আমি কারাতে শুরু করার পর থেকে নিজের জীবনযাত্রার পরিবর্তন করি। আমার খাওয়াদাওয়া পাল্টে ফেলি। আমি কোনো রেড মিট (গরু, ভেড়ার মাংস) খাই না। আ্যালকোহল পান করি না। ধূমপান করি না। খাবারে একটু মুরগির মাংস আর কিছুটা ভেজিটেবল খাই। লাইট অ্যান্ড ইজি খাবার খাই!

তিনি বলতে থাকেন, আমার বউ মারা গেছে অনেক দিন হলো। সন্তানেরা সবাই নিজেদের জীবনে ব্যস্ত। সবাই ভালো আছে। আমার একটা ডগ আছে। সেটাকে নিয়ে থাকি। তাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে হাঁটতে বের হই। কারাতে ট্রেনিং করি। সন্ধ্যায় নিজের ডিনারের ব্যবস্থা করি।
ভদ্রলোকের কথায়–চেহারায় একাকিত্বের বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। হাসিখুশিভাবে কথা বলে গেলেন।
সঙ্গে তিনি বলেন, আমার খারাপ মাইগ্রেন ছিল। এখনো আছে। তবে কারাতে আর উপযুক্ত খাবারের মাধ্যমে অনেক নিয়ন্ত্রিত।
আপনি সপ্তাহে কয়দিন ট্রেনিং করেন?
চার দিন।
হাফ না ফুল ট্রেনিং? (হাফ ট্রেনিং ৪৫ মিনিট আর ফুল ট্রেনিং ৯০ মিনিট)
ফুল ট্রেনিং করি।
আপনি শেখান না?
হ্যাঁ। সপ্তাহে এক দিন শেখাই অন্য দোজোতে।

তিনি আমাকে বলেন, তুমি কারাতে শেখা শুরু করো। অনেকে অনেক কথা বলতে পারে কিন্তু তোমার কাজ তোমাকে করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমি যখন শেখা শুরু করলাম, তখন কেউ কেউ আমাকে এই বয়সে শেখা নিয়ে একটু একটু কথা বলত। কিন্তু আমি পাত্তা দিইনি। তোমার কাজ তোমাকে করে যেতে হবে।

বললাম, আমি কারাতে শিখতাম, তবে একটু ভিন্ন স্টাইলের। আমি ব্রাউন বেল্ট (কিউ-২) লেভেল পর্যন্ত গেছিলাম। আর দুইটা পরীক্ষা দিলেই ব্ল্যাক বেল্ট পেতাম। হোবার্ট থেকে ক্যানবেরাতে আসার পরে আর কন্টিনিউ করা হয়নি। এখন বাচ্চারা শিখলেই আমি খুশি।

তিনি আমাকে অনুপ্রেরণা দেন, যেহেতু তোমার ট্রেনিং আছে, তুমি শেখা শুরু করলে তাড়াতাড়ি শিখে যাবে। তাড়াতাড়ি ওপরের লেভেলে চলে যাবে।

এবার তিনি আমাকে তাঁর কারাতে জামার একটা হাত ওপরে উঠিয়ে হাসতে হাসতে কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত আঁকা ট্যাটু দেখালেন। তিনি যেন দেখাতে আর বোঝাতে চাইলেন যে তিনি এখনো একজন যুবক। ভেতরে তাঁর চিরসবুজ টগবগে যৌবন। এবার মুহূর্তেই তিনি তাঁর মুখ আমার কানের কাছে নিয়ে এসে উৎফুল্লতার সঙ্গে তাঁর বয়সের কথা বললেন। আমি মনে মনে বলি যে আপনার বয়স তো আমি আগে থেকেই জানি। আর সে জন্যই তো কথা বলা আর একটা ছোটখাটো ইন্টারভিউ নেওয়ার মাধ্যমে কিছু জানা আর শেখা।

লক্ষ করলাম, বয়সের কথা বলে তিনি খুব আনন্দ অনুভব করছেন। এ বয়সেও যে তিনি একজন হাসিখুশি, সুস্থ-সবল ফিট মানুষ, এটা তিনি শেয়ার করতে চাচ্ছেন, শেয়ার করে আনন্দ পাচ্ছেন। এটা যে তাঁর একটা বড় অর্জন, তিনি তা খুব ভালোভাবে বোঝেন। আর নিঃসন্দেহে তাঁর এই অর্জনের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করার মতো মানুষ হয়তো পাওয়া যাবে না!

কথোপকথনের এই পর্যায়ে পেছন থেকে আওয়াজ ভেসে এল, লাইন আপ! মানে আজকের কারাতের সেনসেই ট্রেনিং শুরু করার জন্য সবাইকে লাইনে দাঁড়াতে বললেন।
অনেক প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও মনের লাগাম টেনে নিয়ে ৯০ বছর বয়সের যুবকের সঙ্গে কথা শেষ করতে হলো।

শেষ করার আগে আমার নাম বলে তাঁকে তার নাম জিজ্ঞেস করি। বললেন, হ্যারি। নামেও দেখি একজন তাগড়া যুবকের উপস্থিতি! মানে ব্রিটিশ যুবরাজ হ্যারির কথা মনে হলো। হ্যারিকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, আমার সঙ্গে কথা বলে অনেক ভালো লাগল। আবার দেখা হবে বলে তাড়াতাড়ি প্রস্থান করে দূর থেকে বাচ্চাদের সঙ্গে যুবকের কারাতে ট্রেনিং দেখতে থাকলাম।