আফ্রিকায় এসে ইংরেজি শেখা

গাঁওগ্রাম থেকে উঠে এসেছি। দালালের খপ্পরে পড়ে দেড় মাস বনে–জঙ্গলে থেকে ১১ বছর আগে কেপটাউনে আসি। বাংলা পড়তে বা লিখতে টিকতে পারি না। ইংরেজি তো দূরের কথা। বাংলা উচ্চারণ শুদ্ধ করে পারি না। তাই গ্রাম্য বা আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগ করি।

আসতে পথে কত লোকের বিদেশি ভাষা বুঝতে না পেরে, কাপড় ভর্তি ব্যাগটা পানিতে ফেলে দিয়েছি। অথচ বিদেশি লোকটি আমাকে ইংরেজিতে বলেছিল, Your bag is torn, আমি ইংরেজি বুঝতে না পেরে, বিপদ হতে পারে ভেবে পানিতে ফেলে দিলাম।

অন্য আরেকটি জায়গায় যা ঘটেছিল, ভুলিনি। আমাকে ইংরেজিতে বলল যে, police coming, go to that mosque and hide। আমি দৌড়ে পুলিশের ভ্যানে উঠতে গেছি। দুজন কালো মানুষ আমাকে চ্যাংদোলা করে জঙ্গলে নিয়ে বিপদমুক্ত করল।

যা–ই হোক, খরগোশ যেমন লুকিয়ে লুকিয়ে এক ইক্ষু–বাগান থেকে আরেক ইক্ষু–বাগানে যায়। ঠিক তেমনি বাগানে লুকিয়ে লুকিয়ে এক শহর থেকে আরেক শহর হয়ে কেপটাউনে পৌঁছালাম। তত দিনে দেড় মাসের অপেক্ষা শেষ হয়।

এসে দেখি, দক্ষিণ আফ্রিকায় ইংরেজির বিকল্প নেই। এখানে বিনোদ স্যার নেই যে তাঁর কাছ থেকে ইংরেজি শিখব। মধ্যপ্রাচ্যে বা অন্য দিকে হিন্দির প্রচলন থাকলেও এ দেশে সেটা নেই।

সুতরাং, ইংরেজিতে মন দিতে হবে। চাকরি শুরু হলো। প্রথম দিন। একটা কাজে ব্যস্ত। এক কাস্টমার আমাকে বলছে, Are you done? কিছুই তো বুঝলাম না। বাংলা-ইংরেজি না জানলে কী হবে, গালি তো জানি। তাই R U Done বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি বলে দিলাম, এই ‘হালার পুত হালা স্টুপিড’। আমার ইংরেজি বলা শুরু হয়ে গেল।

আসলে স্কুলের বারান্দায়ই তো যাইনি কোনো দিন। মনে আছে একবার গেছিলাম, তাও রাতে। স্কুলে যাত্রা এসেছিল, ‘বাবা তারক নাথ’–এর যাত্রা অভিনয় দেখতে। ঝাপুরঝুপুর কয়েকটি ড্যান্স দেখে প্যান্ডেল থেকে চলে আসি। তারপর স্কুলের ডাব চুরি করে খেতে গিয়ে দফাদারের তাড়া খেয়ে প্যান্ট ছিঁড়ে গেল। ছিঁড়ে যাওয়া প্যান্ট দেখে মা–বাবার যৌথ হামলার কারণে নির্ধারিত সময়ে বাড়ির খাবার খাওয়া সম্ভব হয়নি।

দক্ষিণ আফ্রিকায় চাকরি করছি আর ইংরেজি শেখার জন্য মনোযোগ দিচ্ছি। বোঝার চেষ্টা করছি। দেশে শুনিনি, তবে এখানে এসে প্রথম শুনি How are u? কিচ্ছু বুঝিনি, তবে উত্তর দিয়েছি thank you। তখন সহকর্মীরা হেসে গদগদ।

এ রকমও বলেছি যে tomorrow ছুটি today? ইংরেজি বাংলা মিক্স। কোনটি tomorrow আর কোনটি today, এটা চিন্তা করে পেতাম না। শেষে দুটোই বলতে হতো। আর yesterday নিয়ে তো ভাবতেই পারতাম না। মনে মনে ভাবতাম সেটা কোন দিন। একদিন একজনের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, yesterday মানে কী বার, সোমবার না মঙ্গলবার?

Small one আর big one। এসব ঠিক করতে গিয়ে ভাত খাওয়ার সময় কতবার যে জিবে কামড় খেয়েছি, ঠিক নেই। ছোট মালের দাম যেমন বেশি বলেছি, ঠিক তেমনি বড় মালের দাম কম বলেছি। তা নিয়ে কাউন্টারে কাস্টমারের সঙ্গে কত ঝগড়া হয়েছে।

আমার সঙ্গে চাকরি করত জামান। সে স্কুল–কলেজ পড়া শিক্ষিত। কিন্তু আমাদের দেশে যে ইংরেজি চর্চা হয়, তাতে এ দেশে এসেই ইংরেজিতে কথা বলা সব শিক্ষিত মানুষের দ্বারা হয় না। ধীরে ধীরে শিখতে হয়। তা এই জামান বাংলা ইংরেজি সব পড়তে পারে। কিন্তু বলতে পারে না। ধীরে ধীরে ইংরেজিতে কেউ কিছু বললে তা সম্পূর্ণ না বুঝলেও আংশিক বুঝতে পারে।

জামান বুঝতে পারলেও কথা বলতে পারে না ইংরেজিতে। তবে ইংরেজি সব শব্দের বাংলা মানে জানে, আবার বাংলা শব্দের ইংরেজিও জানে। সমস্যা হচ্ছে সাজিয়ে বলতে পারে না। শিখতেও ভীষণ দেরি হচ্ছে। এর কারণ ‘লজ্জা’। জামান যখন ইংরেজি বলতে যাচ্ছে, সে তখন নিজেই বুঝতে পারছে যে, যা বলতে চাচ্ছি তা ভুল হচ্ছে। এই বুঝতে পারার কারণে ইংরেজি না বলে থেমে যাচ্ছে। ইশারা–ইঙ্গিতে বাক্য সম্পন্ন করার চেষ্টা করে। সংকোচ বা লজ্জার কারণে আজও ভালো ইংরেজি শিখতে পারেনি জামান।

কিন্তু, জামানের সহকর্মী মিঠুন A+ পাওয়া এসএসসি পাস। বেশ চটপটে, কথা বেশি বলে, লজ্জা–শরম কিছুটা কম। A+ পাওয়া ছাত্র হলেও প্রথম যখন সাউথ আফ্রিকা আসে, তখন সে Him মানে কি জানে না। ইংরেজিতে Water বানান জানে না।

কাজের ক্ষেত্রে এসে ভুল হচ্ছে ইংরেজি, এ চিন্তা তার নেই। মুখে যা আসে তা–ই বলে। ইংরেজি জান্তারা হাসাহাসি করলেও কিচ্ছু আসে যায় না মিঠুনের। এভাবে বলতে বলতে সে এখন অনর্গল সঠিকভাবে ইংরেজি বলতে পারে।

নাদিম নামের ছেলেটি লেখাপড়ায় মূর্খ। কিন্তু এখন যেভাবে ইংরেজিতে কথা বলে, তাতে বোঝার উপায় নেই সে লেখাপড়া জানে না। অথচ সে এখনো A B C D লিখতে পারে না, নিজের নামটা সই করতে পারে না। লজ্জাবতীর মতো গুছিয়ে না থেকে তার মুখটি শিমুল ফুলের মতো ফুটেছিল। শত শত পাখি যেমন ফুল থেকে রস সংগ্রহ করে, ঠিক তেমনি নাদিমের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে অনেকেই মধু সংগ্রহ করে গেছে এবং এখনো অনেকেই মধু সংগ্রহ করছে।

জামানের মতে, বিশ্বে কোটি কোটি বাংলাদেশি ভাই কঠোর পরিশ্রম করেন। সেখান থেকে দেশ বিশাল একটা অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করে। দেশের মানুষ দেশের সম্পদ। এদের নিজ প্রয়োজনে বিশ্বের যেকোনো দেশে যাওয়া লাগতে পারে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজির প্রতি একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া ভালো। আর যদি সম্ভব হয়, তবে ইংরেজিতে কথা বলার জন্য শ্রেণি অনুযায়ী একটা class বা Subject থাকা উচিত।