আমার বন্ধু রুমেল

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

কিছু কিছু মানুষ অকারণেই আমাকে প্রশ্রয় দেয়। এর ফলে যেটা হয়, আমি তাদের পেয়ে বসি। যেমন বন্ধু রুমেল।

তৃতীয় সেমিস্টারে অ্যাকাউন্টিং ২০২ কোর্স নিতে হলো। এমনিতে আমি অ্যাকাউন্টিংয়ে মহা দুর্বল, তার ওপর ফ্যাকাল্টি পেলাম চূড়ান্ত রসকষহীন। মোটিভেশন শূন্য পর্যায়ে। রুমেল অ্যাকাউন্টিং ভালো বোঝে। আমাকে মাঝেমধ্যেই বোঝানোর চেষ্টা করে, চাঙা রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু ওর সব পরিশ্রম ব্যর্থ করে দিয়ে ফাইনালে আমি ডাব্বা মারার মতো পরীক্ষা দিলাম। বের হয়ে প্রথমে ওকেই উল্টো চোটপাট নিলাম, ‘কী সাজেশন দিলি তুই? কিছুই তো আসেনি পরীক্ষায়!’ ও শুধু বলল, ‘আচ্ছা হয়েছে তো, পরীক্ষা শেষ, আর ভাবিস না এখন।’

একসঙ্গে বাসে উঠলাম বনানী থেকে। আমি নামব প্রেসক্লাব, রুমেল যাবে মতিঝিল, সেখান থেকে ওয়ারী। বাসে সিট পাওয়া মহা কঠিন কাজ। মহাখালী এসে ভাগ্য প্রসন্ন হলো। দুজনে দুটি সিট পেয়ে বসে পড়লাম। কিন্তু এই সুখ রুমেলের বেশিক্ষণ ভালো লাগল না। যাত্রী উঠে বাস ততক্ষণে আবার বোঝাই; তখন ওর চোখে পড়ল আমাদের সিটের পাশে দুই নারী দাঁড়িয়ে আছেন। সে একটুও ভ্রুক্ষেপ না করে সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। বলল, ‘আপা বসেন।’ এক আপা বসলে আরেক আপাকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি বসে থাকি কেমনে? মনে মনে ওর মুণ্ডুপাত করতে করতে আমিও সাধের সিট ছাড়লাম।

বাস ফার্মগেট পৌঁছালে ট্রাফিক সার্জেন্ট বাস আটকে দিল। বাস আর যাবে না। কাগজপত্রে নাকি সমস্যা। আমি চোখ গরম করে রুমেলের দিকে তাকালাম। যেন সে-ই দায়ী। রুমেলের মুখে হাসি লেগেই আছে। আরেক বাসে উঠলাম। শাহবাগ মোড়ে পৌঁছাতেই আবার উত্তেজনা। বাসের ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। তাড়াতাড়ি আবার নামলাম বাস থেকে। গজগজ করতে করতে রুমেলকে বললাম, ‘তুই একটা কুফা। তোর সঙ্গে আর কোনো দিন বাসে উঠব না।’ আমার কপট রাগ সে পাত্তা দিল না। বলল, ‘আচ্ছা আর বাসে উঠতে হবে না। চল পার্কের মধ্য দিয়ে হাঁটি।’

আমার বাসা ওই এলাকায় হলেও রমনা পার্কে সেভাবে কখনো যাওয়া হয়নি। সেদিন রমনা নতুন করে চিনলাম। এত প্রাচীন একটা পার্ক এত সুন্দর! বিশাল বিশাল বৃক্ষ একটা আলাদা প্রভাব ফেলে মানুষের ওপর। মন খুব দ্রুত শান্ত করে ফেলতে পারে। হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম তীব্র মিষ্টি গন্ধে। আমার কোনো ধারণা নেই কোত্থেকে আসছে। রুমেল বলল, ‘এটা হলো কাঁঠালিচাঁপা ফুলের গন্ধ।’ আমি অবশ্যই ওর কথা বিশ্বাস করলাম না। এই ব্যাটা আবার বৃক্ষ-বিশেষজ্ঞ হলো কবে? তবে খেয়াল করে দেখলাম, গন্ধটা আসলেই কেমন যেন পাকা কাঁঠালের মতো! আমি যে অলস, সেই থেকে এই অবধি ওই গাছ আমার কাছে কাঁঠালিচাঁপাই হয়ে আছে।

তবে রুমেল প্রথম আমাদের বন্ধুমহলে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল চা খেতে গিয়ে। ২০০৬ সালের কথা। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সেমিস্টার। ক্লাস শেষ করে কয়েক নতুন বন্ধু মিলে চা খেতে গেছি। সবার নামও তখন জানি না। চা খাওয়া শুরু হলে একজন দেখি কলা কিনল আর বিস্কুট। তারপর নির্বিকারভাবে কলা ছিলে চায়ে ডুবিয়ে খাওয়া শুরু করল। কাণ্ড দেখে আমরা হেসে কুল পাই না। আমাদের হাসিতে সে–ও যোগ দিল, কিন্তু থামল না। হাসতে হাসতে বলল, ‘বিস্কুট চায়ে ডোবালে টুপ করে পড়ে যায়। কলায় সেই সমস্যা নাই। তোরাও খেয়ে দেখ না, কেমন লাগে?’ বুঝলাম এই পাগলের সঙ্গে জমবে ভালো। পাগলের নাম ‘রুবেল’।

এরপর দীর্ঘদিন পর্যন্ত ওকে রুবেল বলেই ডেকেছি। কেউ ওকে ডাকত ভালো নাম সালাউদ্দিন বলে, কেউ রোমেল বলে। সে কোনো দিন ভুল ধরিয়ে দেয়নি। রাগও করেনি। ভুলভাল নামে ডাকলে যে কারও রাগ হওয়ার কথা, কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, এ ব্যাপারে তার মাথাব্যথা কম। তার মাথাব্যথা বেশি কীভাবে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিত-অপরিচিত যে কাউকে স্বাচ্ছন্দ্যে রাখা যায়, সেটা নিয়ে।

রতনে রতন চেনে। খুব দ্রুতই আবিষ্কার করলাম আমরা দুজনেই ভয়াবহ মাঝারি মানের ছাত্র। কখনো ‘এ’ পাই না, বেশির ভাগ কোর্স ‘বি’ আর মাঝেমধ্যে ‘সি’। তবে আমার ভালো লাগে মার্কেটিং-ম্যানেজমেন্ট, রুমেলের ফেবারিট ফাইন্যান্স-অ্যাকাউন্টিং। আমরা মাঝারি ধরনের পড়াশোনা করি, প্রচুর চা খাই এবং অনেক অনেক গল্প-উপন্যাস পড়ি। আর সুখের দুঃখের কথা তো আছেই। বোঝাপড়ার বিষয়টি আমাদের মধ্যে যাদের এই মাত্রায় ছিল, তারা প্রায়ই দেখা যেত বিভিন্ন কোর্সে একই গ্রুপ করতাম। লাভের মধ্যে, গ্রুপওয়ার্ক করতে গেলে রুমেলের চেয়ে নিবেদিতপ্রাণ গ্রুপমেট পাওয়া মুশকিল। প্রেজেন্টেশন ইত্যাদি নিয়ে তার কিছুটা ভীতি আছে, কিন্তু সেটা সে পুষিয়ে দেয় অন্য সব কাজ নিজে টেনে নিয়ে।

বন্ধুদের কার কখন মন বিষণ্ন, সেটা ধরে ফেলতেও তার জুড়ি নেই। ওর কণ্ঠস্বরে যে খানিকটা কর্কশতা আছে, তা সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে যায় আন্তরিক সুর এবং দরাজ হাসিতে। সব সময়। এই আন্তরিকতা, সততা আর নিবেদন বৃথা যায়নি। আন্ডারগ্র্যাড শেষ হওয়ার পরপর সে চাকরি শুরু করল পোলার আইসক্রিমের ফাইন্যান্স টিমে। এই কাজের প্রতি তার নিষ্ঠা অপরিসীম। এরই মধ্যে ঘনঘটা করে বিয়ে করে ফেলল। গত পাঁচ বছরে যতবার জিজ্ঞেস করেছি, কেমন আছিস, তার মুখে ‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো’ ছাড়া কোনো কথা শুনিনি। তবে রুমেলকে নিয়ে সমস্যা হলো সে সব সময়ই এমন একজন মানুষ যে কোনো কিছু নিয়ে অভিযোগ করে না।

কানাডা আসার আগে দিয়ে ঘটা করে সব বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করছিলাম। আবার কত দিন বিরতি দিয়ে দেখা হয় কে জানে। সেই সূত্রে গত বছর রোজার সময় রুমেলের সঙ্গে দেখা হলো। সে যথারীতি পোলার আইসক্রিমের একটা বড় প্যাকেট নিয়ে হাজির (‘ক্ষীর’ ফ্লেভারের যে আইসক্রিম খেয়ে আমার মা পোলার-ভক্ত হয়ে যান)। বিদায় জানানোর সময় আমাকে আরেকবার মনে করিয়ে দিল—‘তুই অবশ্যই আবার ব্যাংকে গিয়ে ঢুকবি না। তোকে ব্যাংকের চাকরিতে মানায় না। তোর দরকার ক্রিয়েটিভ কিছু করা।’ রুমেলের মুখে এই কথা শুনতে আমার খুব ভালো লাগে, সম্ভবত ‘ক্রিয়েটিভিটি’র কোনো নমুনা আমার মধ্যে আর কেউ দেখেনি বলে! আমি বললাম, ঠিক আছে দেখা যাবে। তুই ব্যাটা স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখ। যে নাদুসনুদুস হয়েছিস! ও বলল, ‘দাঁড়া আবার মোটরসাইকেল ছেড়ে সাইকেল চালানো শুরু করব শিগগিরই।’

আমি টরন্টো আসার পরপর একদিন রুমেলকে মেসেঞ্জারে টোকা দিলাম—‘কী খবর?’ সে তার পুত্রের ভিডিও পাঠিয়ে বলল, ‘এই হলো খবর।’ তার পিচ্চি কন্যাকে আগেই দেখেছি, পুত্রও এখন দাঁড়িয়ে খেলা শুরু করেছে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। এত দ্রুত সময় যাচ্ছে! রুমেল হাসল, ‘হুঁ, সময় খুব দ্রুতই কাটছে। আর শোন, তোকে মিস করছি, দোস্ত।’ সঙ্গে সঙ্গে সুযোগ পেয়ে আমি একটা চোটপাট নিলাম, ‘খুব করছিস। তুই কথা বলবি না। তোর জন্য আমাদের সিলেট ট্রিপটা হলো না।’

রুমেল হাসল। কথাটা আসলে ডাঁহা মিথ্যা। সে-ও জানে। গত তিন-চার বছরে যতবার আমাদের দেখা হয়েছে ততবার আলাপ করেছি বন্ধুদের নিয়ে কয়েক দিনের একটা ঝটিকা সফর দেওয়া খুব জরুরি। যে হারে সবার শিকড় এবং ডালপালা গজাচ্ছে! কোথায় যাব সব ঠিকঠাক—হবিগঞ্জের রেমা কালিঙ্গা ফরেস্ট রিজার্ভ। শুধু সবার একসঙ্গে ব্যাটে বলে হচ্ছে না। একেকজন একেক সময় ব্যস্ত। কী মুশকিল। রুমেল বলল, ‘ঠিক আছে তুই এবার দেশে এলে অবশ্যই হবে। খুব ভালো সময় কাটবে দেখিস।’

সময় আসলেই দ্রুত গেল। কোনোরকম প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়ে গত মে মাসের মাঝামাঝি খবর পেলাম রুমেল অনেক অসুস্থ। কোভিড–১৯ পজিটিভ। সঙ্গে সঙ্গে ওর ফোনে রিং দিলে এক আত্মীয় ফোন ধরলেন। জানালেন অবস্থা সংকটাপন্ন। অসম্ভব চেষ্টা-তদবিরের পর রুমেলকে ঢাকা হাসপাতালে আইসিইউতে ভর্তি করা গেছে। আগের রাতে অবস্থা আরও খারাপ ছিল, সেদিন সকালে কিছুটা ভালো। কিন্তু না, কথা বলার মতো শক্তি তখনো নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপু, এখন কী করা যায় বলুন তো, এ মুহূর্তে কী লাগবে?’ উনি বললেন, ‘না ভাইয়া, কোনো ধরনের সাপোর্ট দরকার নেই, শুধু যেন অনেক অনেক দোয়া করা হয়। আর সবকিছুই করা হয়েছে।’

কথাগুলো শুনছিলাম কিন্তু মানতে পারছিলাম না। রুমেলের সঙ্গে কেন এমন হবে? মনে মনে কথা বললাম অনেক ওর সঙ্গে। কথা মানে—ও সুস্থ হয়ে ওঠার পর ওকে কী রকম কড়া ঝাড়ি দেব আমাদের এ রকম দুশ্চিন্তায় ফেলার জন্য সেটা। ও আমার বই ধার নিয়ে ফেরত না দেওয়ার জন্য কী রকম কপট খোঁটা খাবে সেটাও ঠিক করে ফেললাম। যদিও ঘটনা আসলে উল্টো। ওর বই একটা ধার নিয়ে আমি এখনো ফেরত দিইনি—‘কাইট রানার’। রাতটা কাটল উৎকণ্ঠায়। পরের দিনটাও। এই ধরনের উৎকণ্ঠার সঙ্গে আমার বিশেষ পরিচয় নেই।

রুমেলের সঙ্গে একমুহূর্তের জন্যও যে মিশেছে, আমি নিশ্চিত সে–ও রুমেলের জন্য প্রার্থনা করেছে। তবে বিধাতার ভাবনা কে কবে বুঝতে পেরেছে। পরদিন সকালে ফেসবুকে ঢুকতেই জানলাম রুমেল আর নেই। মনটা একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল।

এভাবে কারও চলে যেতে হয়? অথচ খবরের কাগজে শিরোনাম অন্য দিনের মতোই—‘২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত ১৬১৭, মৃত্যু ১৬’। অনুভূতিহীন ছোট্ট একলাইন লেখা। করোনার বাস্তবতায় এই শিরোনামগুলোতে নিজের অজান্তেই খুব অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। এই দিন শিরোনামটা খুব অন্য রকম শূন্যতা তৈরি করল।

বারবার রুমেলের পিচ্চি দুটোর কথা মনে হচ্ছিল। ওরা নিশ্চয়ই বোঝেওনি ওদের মা কেন কাঁদছে, চারপাশে সবাই কেন কাঁদছে। অবশ্যই বোঝেনি অবিশ্বাস্য অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে ওদের জগৎটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। জানি এটা কোনো সান্ত্বনা হবে না, তবে ওরা যখন বড় হবে, অবশ্যই জানবে পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত হৃদয়বান মানুষদের একজন ছিল তাদের বাবা। আর আমাদের সেই বন্ধুদল হয়তো কোনো একদিন রেমা কালিঙ্গা যাব, না থেকেও রুমেল থাকবে আমাদের মনজুড়ে। ভালো থাকিস রুমেল।

* লেখক: কানাডাপ্রবাসী ব্যাংকার