করোনার ফিলিংসগুলো গুছিয়ে বলা যায় না

>করোনাভাইরাসে পাল্টে গেছে জীবনের বাস্তবতা। আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। করোনায় জীবন নিয়ে লিখছেন অনেকেই। এই চিকিৎসক ও তাঁর পরিবার করোনায় আক্রান্ত। সে কথাই তিনি লিখছেন। আজ পড়ুন ২০তম পর্ব।

আজ ইচ্ছা করেই দেরি করে উঠব ভাবছি। আসলে অ্যান্টিহিস্টামিন আমাকে খুব জ্বালায়। ইদানীং মনে হচ্ছে সূর্যের আলোতেও আমার অ্যালার্জি! ঘুমের মধ্যেই শুনি, কেউ একজন ঘরে এসেছে, বলছে, ‘আমার ভালো লাগছে না! I am not feeling so good!’ আমি এরই ভয়ে ছিলাম।

গতকালও হাঁটতে গিয়েছে। আর করোনা এমন যে ঠিক গুছিয়ে বলা যায় না ফিলিংসগুলো। এখনই একটু যদি ভালো লাগে, তারপরই পাঁচ মিনিটেই ভীষণ গা গুলানো খারাপ লাগে। বেচারার এই ঝামেলায় পড়ার জন্য দোষ আমার। আমি তো বিছানা ছেড়েই উঠতে পারিনি। ও এর মধ্যেও কাজ করার চেষ্টা করছে, ঘরের কাজে হেল্প করার চেষ্টা করছে, স্টিল খাবার টেক আউট করে দিচ্ছে! আমি জানি না কীভাবে করছে! সকালবেলা ঠিকই তাকে উঠতে হচ্ছে কাজের জন্য, হাজারো মিটিংয়ে কীভাবে কনসেনট্রেট করছে, আল্লাহ মালুম! ও ভিটামিন আর ঠান্ডার ওষুধ ছাড়া আর কিছু খাচ্ছে না। গতকালও বলেছি, ওষুধ খেতে, রাজি হয়নি।

মায়ের বাসা থেকে ফোন, খাবার করে দেবে কি না। খাবার খুব বড় সমস্যা আমার বাসায়। কেউ এক বেলার বেশি দেশি খাবার খেতে রাজি নয়। বাইরের খাবার এক বেলা পছন্দ, তিন বেলা হলে আরও ভালো। আর সবার খাবারের রুচি কমে গেছে, সঙ্গে ঈদের জন্য এত খাবার এসেছে, মায়ের বাসা, বান্ধবীর বাসা থেকে, আমার খাবারগুলো নষ্ট হতে দেখে মন খারাপ হচ্ছে। আমিও এখন মাঝেমধ্যে দেশি স্টাইল বিদেশি খাবার করে দিচ্ছি, মানে পারলে করে দিচ্ছি। মাকে না করে দিলাম খাবার পাঠাতে।

নিচে নামতে নামতে লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে—টুকটাক এটা–সেটা সঙ্গে ফ্রিজের খাবার বের করে দিতেই, সবাই খাবার খেয়ে নিয়ে যে যার গন্তব্যে চলে গেল।

আমি আবার ওনাকে মনে করিয়ে দিলাম, নতুন ওষুধ নেওয়ার জন্য। জিজ্ঞেস করে সাইড ইফেক্ট? ঘরের মানুষের সঙ্গে মেডিসিন নিয়ে কথা বলার মতো ধৈর্য আমার নেই, স্ক্রিপ্ট তার হাতে দিয়ে প্রথম তিন সপ্তাহে আমি একা বাইরে গেলাম। কী যে ভালো লাগছিল! খুব স্বাধীন স্বাধীন লাগছিল, তবে ১০-১৫ মিনিটেই বুঝতে পারলাম টায়ার্ড হয়ে গেছি। মাস্ক পরে হাঁটছি। হাঁটতে ভালো লাগছে, তবে টায়ার্ড করে দিচ্ছে।

এর মধ্যেই মেয়ে মেসেজ দিয়েছে, তার বাইরের খাবার চাই। আর কারও কোনো চাহিদা নেই। ওষুধ সে এখনো পিক করেনি। বাসায় ফিরতে ফিরতে আমরা লেট, ডিনার করতেই, দেখি সবাই আবার হাওয়া। ও, ঘুমাতে গেছে। ছেলে এর মধ্যে এসে জানতে চাচ্ছে বন্ধুর সঙ্গে বাস্কেটবল খেলতে যেতে পারবে কি না। নরমালি আমি রাজি হই, তবে যেহেতু আমার বাসায় এখনো করোনা চলছে, না করলাম বুঝিয়ে বলে। ও জানে করোনার ইম্প্যাক্ট, বিনা বাক্য ব্যয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। ওর বাবার করোনা হওয়ার পর থেকে বাবা–ছেলের রাতের মুভি দেখা বন্ধ! আমার পাশে বসে ঘণ্টাখানেক সময় কাটানো বন্ধ। আমাদের প্রতিদিনের ব্যাডমিন্টন খেলা বন্ধ! মনে হচ্ছে আমাদের করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বান্দা ছেলেটা! আমরা শারীরিক কষ্ট পাচ্ছি, কিন্তু ওর ক্ষতি সামাজিক, ইমোশনাল, পারিবারিক! বিড়াল ছাড়া কারও সঙ্গে সময় কাটানোর পারমিশন নেই ওর!

মেয়ে এখন অনেক সুস্থ, ফ্যাকাশে ভাবটা কেটে গেছে। শারীরিক উপসর্গের কমপ্লেন কমেছে, অরুচিও কমেছে অনেকটা। আমার নিজের কাশি আছে এখনো। তবে এনার্জি অনেকটা ফিরেছে। আগামীকাল আমরা আবার টেস্ট করাতে যাব। ক্রসিং ফিঙ্গার! নেগেটিভ রেজাল্ট চাই!

মনে পড়ে গেল, হাজার বছর আগে (ভাববাচ্য), ব্লাড টেস্ট করতে দিয়েছিলাম। টেস্টের রেজাল্ট জানাতে ফোন দিয়ে বলেছিল, সবকিছুর পজিটিভ রেজাল্ট, সব নরমাল। যেটা জানতে চাইছিলাম মেইনলি, সেটাই জিজ্ঞেস করতে ভুলে, ফোন রেখে দিয়েছিলাম! ফোন রাখার পর মনে হতেই আবার ফোন দিলাম, এবার জানতে চাইলাম, কাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট! বলে পজিটিভ—আমি যদিও শুনতে রেডি ছিলাম না! তবে সে পজিটিভ রেজাল্টে ভীষণ মিশ্র ইমোশন ছিল—সেটা ছিল, আমার প্রথম পজিটিভ প্রেগন্যান্সি টেস্ট রেজাল্ট! তবে এবার করোনা রেজাল্ট নেগেটিভ চাই! আর পজিটিভ রেজাল্ট চাই না।

লেখক
লেখক

কত দিন মনে হচ্ছে স্বস্তির শ্বাস নিই না। ভয়ে কারও সঙ্গে মিশি না। সবাইকে দূরে দূরে রাখতে হচ্ছে, সবার কাছ থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে। তবে সিডিসি (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল) বলছে, রিপিট টেস্ট করার দরকার নেই। যদি সিম্পটম চলে যায় দু–এক সপ্তাহের মধ্যে (১০ দিনের মধ্যে, স্পেশালি জ্বর) আর টেস্ট করার দরকার নেই। তবে অনেক প্রতিষ্ঠানই তাদের এমপ্লয়ি কাজে ফেরার আগে, নেগেটিভ রেজাল্ট দেখতে চায়। আমার কাজে ফিরতে আমার নেগেটিভ রেজাল্টের বাধ্যবাধকতা নেই। তবে আমি চাই বাসার সবাই নেগেটিভ হোক, নেগেটিভ হলে আমি সাহস করতে পারব মা–বাবাকে দেখতে যেতে, বন্ধু এবং পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে দ্বিধা থাকবে না (যদিও আমি গ্যাদারিং অ্যাভয়েড করি) এবং কনফিডেন্টলি রোগী হ্যান্ডেল করতে পারব, এটা জেনে যে আমি নেগেটিভ। আর টেস্ট করালে পরপর দুই দিন একটানা নেগেটিভ হতে হবে। আমি আপাতত একটি নেগেটিভ রেজাল্ট পেলেই খুশি।

যেহেতু কোভিড নতুন রোগ, আমরা সকাল–বিকেল নতুন নতুন তথ্য পাচ্ছি। নতুন করে ভাবছি, নতুন স্ট্র্যাটেজিতে সবকিছু হ্যান্ডেল করছি! মাস্ক এখানে কম্পোলসারি নয়, গভর্নমেন্ট ম্যান্ডাটরি করেনি। তবে সব প্রতিষ্ঠানের এমপ্লয়ি মাস্ক পরছে এবং যেকোনো দোকানে বা প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে হলে মাস্ক পরেই ঢুকতে হচ্ছে! কারণ, ব্যক্তিমালিকানায় চালানো প্রতিষ্ঠান তাদের নিয়মমতো চলছে—আমেরিকান স্বাধীনতার এই দিকগুলো আমায় মুগ্ধ করে।

এর মধ্যে দুনিয়ায় আরও অনেক চেঞ্জ এসেছে গত ২৪ ঘণ্টায়! লেবাননে পোর্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণে দুই শতাধিক মারা গেছেন, আহত তিন হাজার। রক্তাক্ত মানুষের আহাজারি আর ব্লাস্টের ছবি মন থেকে মুছতে পারছি না। খবরে দেখলাম, বাংলাদেশি লোকজনও হতাহত হয়েছে! সারা বিশ্বে যেন ভালো খবর নেই। আমাদের এখানে গত কয়েক দিন বজ্রসহ বৃষ্টি (ঘূর্ণিঝড়ের কারণে যা নিউইয়র্কে বেশ ক্ষতি করেছে)! যেন ওপরওয়ালা প্রতি মুহূর্তে আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। লেবাননে এত হাজারো পরিবারের ওপর যে দুর্যোগ চোখের পলকে হয়ে গেল, অকল্পনীয়! মরে গিয়ে কিছু মানুষ আসলে বেঁচে গেল। আর যাঁরা ইনজুরিতে আছেন, সঙ্গে মৃত ব্যক্তিদের পরিবার—তারা সাফার করবে লংটার্ম, জীবনভর! আল্লাহ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন। চলবে...