ভিনদেশি নদীসঙ্গ

টাওয়ার ব্রিজ, লন্ডন। ছবি: লেখক
টাওয়ার ব্রিজ, লন্ডন। ছবি: লেখক

অনেক দিনের ইচ্ছা নদীর গল্প লিখব। আমার জীবনের নদীগুলোর গল্প। নির্লজ্জের মতো নদীসঙ্গের কথা জানিয়ে দেব সবাইকে। অবাধ সন্তরণ অথবা আলতো স্পর্শে শিহরিত হওয়া প্রতিটা গল্প। গোদারা ঘাটে পারাপার, টাইটাই ভেসেথাকা বারকি নৌকার রোমাঞ্চ, গয়না নাওয়ে ভাটিবিলাস অথবা দ্রুতযান ট্রলারের গল্প।

সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার তেরো শ নদী হয়তো নেই। হয়তো অযত্ন–অবজ্ঞার অভিমানে মরে গেছে অনেক নদী। তবু মনের নদীটা বেঁচে আছে আলবৎ। বেঁচে আছে দেওরভাগা, কুড়া, কুশিয়ারা, সুরমা, মনু, খোয়াই, ধলাই, শীতলক্ষ্যা, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, রূপসা, তুরাগ অথবা খাসীখালি, সদাখাল বা কলস নদ–নদীর গল্প। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমার অনাবাসী জীবনের সঙ্গী আরও গোটা সাতেক ব্রিটিশ নদী। লন্ডনের নদী টেমস, চেমস্ফোর্ডের নদী চেলমার, ক্যামব্রিজের নদী কেম, শেকসপিয়ারের বাড়ির পাশের নদী এভন, শেফিল্ডের নদী ডন, গ্লাসগোর নদী ক্লাইড এবং এডিনবরার নদী লেইথ।

আজ বলব ব্রিটিশ নদীর গল্প, যে নদীগুলো আমাকে নিঃশর্ত সঙ্গ দিয়েছিল আমার নিঃসঙ্গ অনাবাসী দিনগুলোয়।

অনাবাসী হয়েছি এক যুগ। ২৪ বছরের টগবগে আমি একবুক রুপালি নদীর ঢেউ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম পশ্চিমে। ২০০৬ সালের এক শরতের বিকেল, ২০ সেপ্টেম্বর। সেদিনের বিকেলের সোনারোদ মাড়িয়ে সব ভালোবাসার বন্ধনকে দলিয়ে নিঃসঙ্গ গাংচিলের মতো বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সস্তা কেবিনে উঠে পড়লাম। পকেটে বাবার দেওয়া ৫০ পাউন্ডের দশটি নোট, জীবনবোধ এবং একগাদা আত্মবিশ্বাস আর বুকপকেটে মায়ের ভালোবাসা। বুকের মধ্যে বইছিল তুমুল ঝড় আর মনের মধ্যে অঞ্জন দত্তের গান,

প্যানারোমিক ভিউ টাওয়ার ব্রিজ, লন্ডন মেয়রের অফিস, উঁচু ভবন দ্য শার্ড। ছবি: সংগৃহীত
প্যানারোমিক ভিউ টাওয়ার ব্রিজ, লন্ডন মেয়রের অফিস, উঁচু ভবন দ্য শার্ড। ছবি: সংগৃহীত

একটু ভালো করে বাঁচব বলে
আর একটু বেশি রোজগার
ছাড়লাম ঘর আমি ছাড়লাম ভালোবাসা
আমার নীলচে পাহাড়...

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। আমার বিমান ততক্ষণে পশ্চিম আকাশে ডানা মেলল। পেছনে পড়ে রইল উদীচী সিলেটের নাটকের মহড়া, এমসি কলেজের আড্ডা, পাঞ্জেরি প্রীতিরাজ রেস্টুরেন্টের তর্কময় সন্ধ্যা, দ্যাওরভাগা নদী আর প্রগতির মিছিলের স্লোগান। সলিল চৌধুরীর গণসংগীতের মতো অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা আর জীবনের প্রথম খেচর হওয়ার তীব্র উত্তেজনায় যতটা রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম, ফেলে আসা স্বজন, বন্ধুবান্ধবী আর প্রেমিকাদের কথা ভেবে জগজিৎ সিংয়ের গজলের মতো ঠিক ততটাই আর্দ্র হচ্ছিল মন খারাপের মেঘ। বিমান দ্রুতবেগে এগিয়ে যাচ্ছে। গন্তব্য ইউরোপের অত্যাধুনিক শহর লন্ডন।

সিলেটের মানুষ আমি। পাহাড়ের গান মনে বাজলেও, বুকজুড়ে ছিল তেরো শ নদীর স্রোতও। সব থেকে বেশি কান্না পাচ্ছিল আমার মায়ের মতো আপন দেওরভাগা নদীর জন্য। যে নদীর বুকে অবাধ সন্তরণে কেটেছে বর্ষণমুখর শৈশব, আর বালুময় বুকে আঁকিবুঁকি খেলার উত্তরীয় হাওয়ার স্কুলপালানো দিনগুলো।

বিমানের কেবিনে নানা হাস্যকর ঘটনা আর দুবাইয়ে দুই ঘণ্টা ট্রানজিটের পরে লন্ডন এসে পৌঁছালাম স্থানীয় সময় রাত ১০টায়। বিমানের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি সারি সারি আলোর বহর। এ যেন আলোর মিছিলে ক্লান্তিহীন দীপাবলি চলছে বিলেতের উঠোনে। যে শহরের সঙ্গে হয়েছে বাকি জীবনের সখ্য। পরভূমিকে আপন করে নেওয়া এই ব্রিটেনেও প্রচুর নদীর ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি নদীমাতৃক বাংলাদেশের ক্ষুদ্র আমি। চাকচিক্যময় নদী টেমস আমাকে সুরমার দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে পরম মমতায়। একাকিত্বের দিনগুলোতে বুকে টেনে নিয়েছে মায়ের মতো করে। সেই সঙ্গে চেমসফোর্ডের রিভার চেলমার, ক্যামব্রিজের রিভার ক্যাম, শেফিল্ডের নদী ডন, শেকসপিয়ারের নদী এভন আর গ্লাসগো শহরের বুক চিরে কুলকুল করে বয়ে যাওয়া নদী ক্লাইড ও আশ্রয় দিয়েছে অকপটে। এ এক ভিন্ন ভালোবাসা, ভিন্ন কাছে টানার উপাখ্যান।

ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজ থেকে তোলা লন্ডন আই। ছবি: লেখক
ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজ থেকে তোলা লন্ডন আই। ছবি: লেখক

লন্ডন শহরের বুক চিরে এঁকেবেঁকে বিশালকার অজগর সাপের মতো বয়ে গেছে নদী টেমস। যে টেমস আমার লন্ডনজীবনের শুরুর একাকী মন খারাপের দিনগুলোর সাক্ষী। ঘোরলাগা এক বিকেলে টেমসের সঙ্গে পরিচয় হলো বড্ড অকস্মাৎ। নতুন শহরে নতুন আমি আস্তানা গেড়েছি লন্ডনের শ্যাডোয়েল বলে একটা জায়গায়। দিন তিনেক বাদে সন্ধ্যায় হাঁটতে হাঁটতে হটাৎ দেখি একঝাঁক গাংচিল ওড়াউড়ি করছে। নাবিক ভাস্কোদাগামার মতো আমিও ভেবে নিলাম কাছে পিঠে কোথাও জলাশয় আছে। ব্যস, তেরো শ নদীর স্রোত তখন আলতো করে জেগে উঠল বুকে। তারপর মিনিট দশেক হাঁটার পরেই দেখি তুলকালাম কাণ্ড। বিশাল এক টাওয়ার জাঁকিয়ে বসে আছে নদীর ওর। জলের বুকে দীপাবলির আলোকসজ্জার মতো লাল–নীল হাজারো বাতির ছায়া। এমন রাজকীয় জৌলুশ, এমন উচ্চতা, নির্মাণশৈলী আর আভিজাত্য আমার মতো ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণের দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম।

সারা জীবন যা ফিল্মে আর ক্যালেন্ডারে দেখেছি, লন্ডনের সেই বিখ্যাত টাওয়ার ব্রিজ। ৩৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ, প্রায় ১৮ মিটার প্রশস্ত এবং ২০ মিটার গভীর টেমস নদীর বুকে বিশালকার বপু নিয়ে বসে আছে টাওয়ার ব্রিজ। ঠিক যেন মহাভারতের হস্তিনাপুরে ময়দানবের তৈরি আলোর বহর ঠিকরে পড়া পাণ্ডবদের রাজবাড়ী। ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়ার আমলে বাসকিউল এবং সাসপেনশন অর্থাৎ ঝুলন্ত আবার জাহাজ চলাচলের জন্য মাঝখানের পাটাতন সরানো যায় এমন প্রযুক্তি দিয়ে টাওয়ার ব্রিজের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৮৮৬ সালে এবং মানুষের চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় ১৮৯৪ সালে। ব্রিজের পাটাতন লেভেল থেকে প্রায় চারতলার সমান উঁচু দুটো টাওয়ারে রয়েছে প্রদর্শনী হল এবং ভিক্টরিয়ান ইঞ্জিন রুম। যেহেতু ব্রিজটি টাওয়ার অব লন্ডনের ঠিক পাশেই, তাই ব্রিজটির নাম দেওয়া হলো টাওয়ার ব্রিজ। ভাবতে পারেন, এক শ বছরের পুরোনো ব্রিজে আজও ঠিক মাঝখানের পাটাতন খুলে যায় উঁচু নৌযান চলাচলের জন্য। এখন মনে প্রশ্ন আসতে পারে, টাওয়ার অব লন্ডন কী? টাওয়ার অব লন্ডন হলো এক বিশাল প্রাচীনতম দুর্গ। যে দুর্গ মহাযোদ্ধা উইলিয়াম ১০৭০ সালে নির্মাণ করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, লন্ডনের আশপাশের সব দুর্গের সঙ্গে সমন্বয় রাখা। এক হাজার বছর পরেও বিশালকায় এই টাওয়ারের নির্মাণশৈলী এবং প্রযুক্তি আজও এক মহাবিস্ময়। ভাবলে অবাক হতে হয় শুধু টেমস নদীর বুকে ফুট ব্রিজ, ট্রেন ব্রিজ এবং গাড়ি চলাচলের সব মিলিয়ে রয়েছে ২০০টি ব্রিজ, ২৭টি টানেল, ৬টি ফেরি আর একটি ক্যাবল কার ক্রসিং। সেদিনের সেই চোখধাঁধানো আলো–আঁধারিতে টেমস নদী আমাকে তাঁর বুকে টেনে নিয়েছিল। এরপর এ সিমেন্টের শহরের অগুনতি মন খারাপের বিকেল কাটিয়েছি এমব্যাঙ্কমেন্টের পায়ে হাঁটা ব্রিজে, কখনো গ্লোব থিয়েটারের পাশে শেকসপিয়ারের লন্ডন ব্রিজে, কখনো সেইন্ট পল্সের ফুটওভার ব্রিজে, সাদার্ক ব্রিজে অথবা গণতন্ত্রের সূতিকাগার ব্রিটিশ পার্লামেন্টের পাশের ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজে। পরে আমার নদীসঙ্গের সঙ্গী হয়েছেন অনেকেই। এর মধ্যে ফটোগ্রাফার বন্ধু পীযুষ কুরী, রুবেল, ভানু, রনি এবং বিপ্লব রায়ের নাম না বললেই নয়।

গোধূলির আলোয় রাঙা টেমস নদীর ছবিটি টাওয়ার ব্রিজ থেকে তোলা। ছবি: লেখক
গোধূলির আলোয় রাঙা টেমস নদীর ছবিটি টাওয়ার ব্রিজ থেকে তোলা। ছবি: লেখক

ব্রিটিশ সামারের দিনগুলোতে লন্ডন আইয়ের ঠিক উল্টো পাশে বিখ্যাত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অফিসের সামনের ঘাটের সিঁড়িতে বসে থেমসের জলে আলোর ছায়া দেখতে দেখতে মন চলে যেত ভরবর্ষায় লোভা ছড়ার ঠিক কাছে মামাবাড়ির পাশ ঘেঁষে যাওয়া সুরমা নদীর উত্তাল ঢেউ গোনা গোধূলিবেলায়। শৈশবে এবড়োখেবড়ো রাস্তায় সারা দিনের জার্নি শেষে বাস থামত নদীর এপারে। বিশালকায় কয়েকটি হিজলগাছের নিচে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে চায়ের দোকান। সামনে পাতা লম্বা বেঞ্চিতে বাসের হেলপারদের গা এলিয়ে ক্লান্তিবিলাস। কানাইঘাট, এটাই শেষ স্টপেজ। সামনে থইথই করা নতুন জলে স্রোতস্বিনী সুরমা। নতুন টিনের চৌচালা চালে সূর্যের আলোয় ঝিকিমিকি করে ওঠা ছোট ঢেউগুলো। চোখ ধরে রাখা কঠিন। সঙ্গে মনও, কারণ নদী পেরোলেই মামাবাড়ি।

গ্রীষ্মের রঙে রঙিন ক্যামব্রিজের কেম নদী। ছবি: লেখক
গ্রীষ্মের রঙে রঙিন ক্যামব্রিজের কেম নদী। ছবি: লেখক

রিভার কেম
ব্রিটিশ মুলুকে এরপরেই যে নদী আমার স্নেহের তৃষ্ণা মিটিয়েছে, তার নাম রিভার কেম। ব্রিটিশ হিস্ট্রিতে সব থেকে পুরোনো শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম পূর্ব ইংল্যান্ডের শহর ক্যামব্রিজ। নামেই যার পরিচয়। ১২০০ সালের শুরুতে রয়েল চার্টার কিং হেনরি-থ্রি ক্যামব্রিজ শহরে স্থাপন করেন দ্বিতীয় ইংলিশ স্পিকিং ইউনিভার্সিটি। বর্তমানে যা ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি নামে জগদ্বিখ্যাত।

বিশ্ববিখ্যাত ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির কিংস কলেজের সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া ছিপছিপে, শান্ত আর উচ্ছ্বসিত নদী কেম। বছর পাঁচেক ধরে কর্মসূত্রে যদিও ইদানীং প্রায়ই আমাকে ক্যামব্রিজ শহরে যেতে হয় কিন্তু এ শহর আর নদীর সঙ্গে সখ্য আরও অনেক পুরোনো। ব্রিটেনের অনাবাসী জীবনের শুরুতে আমার এক বন্ধুপ্রতিম অগ্রজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালুমিনাই তখন পিএইচডি করছিলেন ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে। সেই নিঃসঙ্গ সময়ে প্রায় প্রতিটা সপ্তাহান্তে লন্ডনের কিংসক্রস স্টেশন থেকে দ্রুততম ট্রেনে এক ঘণ্টা জার্নি শেষে প্রায় ১০২ কিলোমিটার দূরবর্তী শহর ক্যামব্রিজে চলে যেতাম একমুঠো আনন্দের জন্য। সারা দিন কেম নদীতে নৌকা চালানো, ইমানুয়েল কলেজ, কিংস কলেজ, ডারউইন কলেজ, প্রেমব্রোক কলেজ, পিটার হাউজ কলেজসহ ইউনিভার্সিটির ৩১টি কলেজের আনাচকানাচে ঘোরাঘুরি শেষে সন্ধ্যায় ডারউইন কলেজের সরাইখানায় পাব কুইজে খুঁজে বেড়াতাম চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের পূর্বপুরুষদের করোটি। সেই থেকে শুরু। আজও কাজের ব্যস্ততা আর ক্লান্তিকে নিমেষেই ভুলিয়ে দিতে টনিকের মতো কাজ করে নর্থ সিতে মিশে যাওয়া ৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই তন্বী শ্যামাঙ্গী নদী। বিস্তীর্ণ দুপাড়জুড়ে প্রাচীন ভবনের প্রতিটি খোঁপে রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, জ্ঞান আর সংস্কৃতির ছোঁয়া। প্রতিটা স্থাপনায় যেন স্পর্শ রয়ে গেছে মাইকেল ফিশার, স্যার আইজ্যাক নিউটন, চার্লস ডারউইন থেকে সদ্যগত পদার্থবিজ্ঞানের বরপুত্র স্টিফেন হকিংসের মতো মহামনীষীদের। সেই সঙ্গে আছে দেশভাগের সময় সীমানা নির্ধারণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ফিলিপ রেডক্লিফের নামও। নর্থ সি থেকে মাত্র ৬৪ কিলোমিটার দূরের ক্যামব্রিজ শহরের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা থেকে জানা যায়, কেম নদীর জন্যই নাকি প্রাচীন এংলো স্যাক্সন, রোমান এবং ভাইকিংসদের কাছে ক্যামব্রিজ শহর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ ইংল্যান্ড আক্রমণ এবং শাসনের সময়ে নর্থ সি থেকে কেম নদী দিয়ে তারা সহজেই পণ্য আদান–প্রদান করতে পারত। আঠারো শতাব্দী পর্যন্ত যখন ব্রিটেনে রেলওয়ে চালু হয়নি, তখন ক্যামব্রিজ থেকে লন্ডনের সব ব্যবসায়িক যোগাযোগের জন্য কেম নদী ছিল একমাত্র পন্থা। কেম নদীতে প্রতিবছর নৌকাবাইচ হয়, সেই সঙ্গে রয়েছে ভাড়া নৌকায় নৌবিহারের সুযোগ। মাঝেমধ্যে শুক্রবারের কর্মব্যস্ত দিন শেষে কিংস কলেজের ঠিক সামনে কেম নদীর জলে পা ভিজিয়ে আস্বাদ করি খরস্রোতা কুশিয়ারা নদীর নৌকাবাইচের মন্দিরার তাল।

চেলমার নদী
নদীর নাম চেলমার। নাম শুনে কেন জানি মনে পড়ে সেই বিখ্যাত ভাওয়াইয়া গানের লাইন ‘হাঁকাও গাড়ি তুমি চিলমারীর বন্দরে...’। ইস্ট এংলিয়ার ছোট শহর চেমসফোর্ড। যে শহরে জন্মেছিলেন বেতার আবিষ্কারক বিজ্ঞানী মার্কনি। এই শহরে এক বন্ধুপ্রতিম অনুজ বাস করত বহু বছর আগে। সেই সুবাদে চেমসফোর্ড শহরে গেলেও ছোট চিকচিকে নদী চেলমারের দর্শন হয়নি তখন। পরবর্তী সময়ে বছর পাঁচেক আগে পিএইচডিতে ভর্তির ভাইভা শেষ করে প্রফেসরের রুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি কুলকুল করে ফল্গুধারার মতো বয়ে চলেছে একটি জলধারা। ধুম করেই মনে পড়ে গেল আমার শৈশবের নদী দ্যাওরভাগার গল্প। ছোট একটা নদী মায়ের মতো পরম মমতায় শৈশব কৈশোরের সঙ্গী হয়েছিল অজান্তে। ভরাবর্ষায় দ্যাওরভাগা নদীর স্রোতে গা এলিয়ে অবাদ সন্তরণে এপার ওপার করতাম নির্ভাবনায় আর শীতকালে পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি, দুই ধার উঁচু তা ঢালু তার পাড়ি...মাত্র ৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ছোট একটি নদী চেলমার অথচ কত পরম মমতায় যত্নআত্তি করে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে ক্ষুদ্রকায় এই নদীকে। অথচ যথোপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ আর আমাদের ক্রমাগত হটকারী কার্যকলাপে প্রতিবছর তিলে তিলে মারা যাচ্ছে আমাদের দেশের ছোট শাখা নদীগুলো। বছর বিশেক আগেও যে দ্যাওরভাগায় গোলা নামত পাহাড়ি ঢলে, সেই নদী আজ চর পড়ে অশীতিপর বৃদ্ধের মতো মৃত্যুর দিন গুনছে। হ্যাঁ, সেদিনের ইন্টারভিউতে সফল হয়েছিলাম। এরপর থেকে রিভার সাইডের লর্ড অ্যাশক্রফট ভবনের তৃতীয় তলার একটি ল্যাবের বাসিন্দা হই আমি। যে ল্যাবের জানালা দিয়ে তাকালেই দেখা যায় ওপারে ঘন জঙ্গল আর নিচে ঢোঁড়া সাপের মতো হলুদ কালো ডোরাকাটা শরীর নিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া নদী চেলমার।

রোমান বাথ শহরের বুক চেরা এভন। ছবি: সংগৃহীত
রোমান বাথ শহরের বুক চেরা এভন। ছবি: সংগৃহীত

এভন নদী
নদীর নাম এভন। ব্রিটেনের শিল্পসাহিত্যের বিকাশে এই নদীর অবদান অনস্বীকার্য। এভনের মিষ্টি জল হাওয়া ব্রিটেনের রাজাদের রাজা হিসেবে খ্যাত জগদ্বিখ্যাত সাহিত্যিক এবং প্লেরাইট উইলিয়াম শেকসপিয়ার থেকে শুরু করে জ্যানেট অস্টিনসহ বহু কবি–সাহিত্যিককে প্রেরণা জুগিয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।

ইংলিশ ভাষার উৎপত্তি হয়েছিল ক্যালটিক ভাষা থেকে। সেই ক্যালটিক ভাষায় এভন অর্থ নদী। পশ্চিম ইংল্যান্ডের বুক চিরে এক শ চুয়ান্ন কিলোমিটার লম্বা নদী এভন ছুঁয়ে গেছে বহু শহর। এর মধ্যে অন্যতম হলো শেকসপিয়ারের শহর স্টার্টফোর্ড আপ অন এভন, ওয়ারউইক এবং রোমান সিটি বাথ। আমার এভন দর্শন হয়েছিল রোমান শহর বাথে। চারপাশের রোমান আমলের প্রাগৈতিহাসিক স্থাপনা আর মাঝখানে বয়ে গেছে নদী এভন। রোমানদের বাথ শহরে আস্তানা গাড়ার অন্যতম প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল নদী এভন। এভন নদীর সঙ্গে আমার সখ্যতা হয়েছিল খুব কম সময়েই। ধুম করে এই নদী আমাকে নিয়ে গিয়েছিল দেড় হাজার বছর আগের রোমান সভ্যতায়। আমাকে দিয়েছিল শেকসপিয়ারের ট্র্যাডেজির শিহরণ। এভাবেই হুটহাট সখ্য হয়েছিল শান্ত নদী শীতলক্ষ্যার সঙ্গে। বছর ১৫ আগে ঢাকা–সিলেট রুটে কাঁচপুরে পোশাকশ্রমিকদের আন্দোলনের সময়ে ট্রলারে করে পাড়ি দিয়েছিলাম শীতলক্ষ্যার অগাধ জল। অতিসামান্য সঙ্গ আজও যেন গেঁথে আছে মনে।

গ্লাসগোর শান্ত নদী ক্লাইড। ছবি: লেখক
গ্লাসগোর শান্ত নদী ক্লাইড। ছবি: লেখক

ক্লাইড নদী
সবশেষে যে নদীর গল্প বলব তাঁর নাম শান্ত নদী ক্লাইড। স্কটল্যান্ডের রাজধানী গ্লাসগোর বুক চিরে বয়ে গেছে গ্রেট ব্রিটেনের অষ্টম বৃহৎ নদী ক্লাইড। বছর তিনেক আগে এক সপ্তাহ চষে বেরিয়েছিলাম গোটা স্কটল্যান্ড। গ্লাসগো থেকে এডিনবরা, লক লোমন্ড থেকে লকনেস, গ্লেনকো থেকে ইনভারনেস। স্কটিশ পাই, পাহাড়ি সুমিষ্ট জলের স্বাদ, প্রাচীন স্থাপত্যের বাহার আর ব্যাকপাইপের সুরের মূর্ছনায় স্কটল্যান্ড যাত্রা ছিল মোহনীয়। যে গল্প করব অন্য কোনো দিন অন্য কোনোখানে। আমাদের লজ থেকে হেঁটে হেঁটেই গিয়েছিলাম ক্লাইড নদীর পাড়ে। শুভ্র শান্ত অমরাবতীর পরিবেশ চারপাশে। নেই শব্দদূষণ বা বায়ুদূষণের মতো আত্মঘাতী দূষণগুলো। প্রকৃতিকন্যা স্কটল্যান্ডের ক্লাইডি নদী নিয়ে হয়তো টেমস নদীর মতো কাব্য হয়নি, হয়নি কবিতা। তবু গ্লাসগো শহরের বুক চেরা ক্লাইডি নদীর মধ্যে আছে এক অদ্ভুত মাদকতা। আছে এক উচ্চমার্গীয় শিল্পসত্তা। টেমসের মতো দুই কূলজুড়ে নেই জাগতিক ব্যস্ততা। নেই নানা ধরনের চিত্তাকর্ষক মনুষ্য সৃষ্ট চাকচিক্যের বাহার।

সুগভীর ব্যাপ্তি নিয়ে দুইপারে বিবিসি স্কটল্যান্ড, গ্লাসগো বিজ্ঞান কেন্দ্র, ক্লাইডি অডিটরিয়ামকে ধারণ করে সৌম্য শান্ত কাক চক্ষু নিয়ে বয়ে চলেছে অনন্তের পানে। এমন ইন্দ্রপুরীর সৌন্দর্যের সামনে গিয়ে কথা বলতে হয় না। চুপ করে আস্বাদন করে নিতে হয় তার ওপার রূপ মাধুর্য। আমরাও কোনো কথা বলতে পারিনি। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেই যাচ্ছিলাম ক্রমাগত আর মনে পড়ছিল সিলেটের জৈন্তাপুরের পাহাড়ি নদী সারির কথা। সেখানে স্বচ্ছজলে গভীরের পাথরটাও দেখা যায় অবলীলায়। সেই সঙ্গে রয়েছে একই ধরনের নৈঃশব্দ্যের কাব্যিক পঙক্তিমালা।

অনাবাসী জীবনে হয়তো অনেক বেশি সামাজিক নিরাপত্তা আছে, আছে পেশাগত জীবনের সিঁড়ি ভেঙে বিলাসী জীবনের হাতছানি। কিন্তু নেই অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটা শেষে উঠোনজুড়ে ম ম করা নতুন ধানের ঘ্রাণ। এখানে হাজারো ফুলের চোখধাঁধানো সমাহার তবু কোথাও যেন নাগেশ্বর বা কাঁঠাল চাঁপাফুলের মনমাতাল ঘ্রাণের জন্য হাহাকার রয়ে যায় নিজের অজান্তে। তবু কোথাও যেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতার লাইনগুলো বুকের গহনে বাজে।

‘কত দেশে দেখিয়াছি, কত নদ দলে
কিন্তু স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে’।

*লেখক: পিএইচডি গবেষক এবং প্রভাষক, অ্যাংলিয়া রাসকিন ইউনির্ভাসিটি, কেমব্রিজ