একজন অধ্যাপক ও একজন শফিক

‘সবাই ভালো থাকবেন।’ এক মজলিশি বৈঠক থেকে বিদায় নেওয়ার আগে বললেন এক ভদ্রলোক।
‘ভুল দোয়া করবেন না।’ গুরুগম্ভীর গলায় বললেন, আরেক ভদ্রলোক।
‘কেন? ভুল কী বললাম প্রফেসর সাহেব।’
‘ভুলই তো বলেছেন। আপনি তো জানেন না এখানে কোনো চোর-ডাকাত কিংবা সন্ত্রাসী আছে কি না । এরা ভালো থাকলে তো সবাই বিপদে থাকবে।’
‘তাহলে কী বলতে হবে?’
‘বলেন “সবাইকে ভালো রাখবেন”।’
দুজনের এই কথোপকথনের সময় আমার পাশে বসা একজন ফিসফিস করে বললেন, ‘এই ঘাউরা প্রফেসরকে কে ডাকছে? আজকে সবাইরে বিরক্ত কইরা ছাড়বে।’
তাঁর কথা শুনে আমি চমৎকৃত হই। তাঁকে নিচু স্বরে জিজ্ঞেশ করি, ‘উনি কে?’
‘আরে ভাই, ওনাকে চেনেন না। বিরাট বিদ্বান ব্যক্তি। কলেজের প্রফেসর। এখন রিটায়ার্ড। জ্ঞান থাকলে কী হইব, ঘাউরা। কেউ সহজে ওনার ধারে কাছে ঘেঁষে না।’ ভদ্রলোক নিচু গলায় উত্তর দেন।
আমি নিজে বে-গুণ বলেই কিনা, গুণবান ও জ্ঞানীদের সান্নিধ্য আমার খুব ভালো লাগে। তাই সুযোগ খুঁজতে থাকি কীভাবে এই প্রফেসরের সঙ্গে কথা বলা যায়। সুযোগ পেয়েও যাই। তাঁর কাছে গিয়ে বলি, ‘স্যার, আপনার কথা শুনেছি। আমার নাম মোস্তাফিজ।’ এভাবে নিজের পরিচয় দিই।
‘কী করো?’
‘জীবনধারণের জন্য সফটওয়্যার তৈরি করি স্যার।’
‘ও, তোমার জীবন তাহলে তরল কিংবা বায়বীয় পদার্থ, যাকে ধারণ করতে হয়। আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে মন ধারণের জন্য কী করো?’
তাঁর কথা শুনে আমি আরও মুগ্ধ হই। ‘অবসর সময়ে গল্পের বই পড়ি।’ উত্তর দিই।
‘কার বই পড়?’
রবীন্দ্রনাথ, তারাশংকর, বিভূতি, শীর্ষেন্দু, সুনীল, সমরেশ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক—এ রকম বেশ কয়েকটা নাম বললাম। স্যারের ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসি দেখতে পেলাম।
‘হুমায়ূন আহমেদ পড় না? সহজ ভাষায় চমৎকার সাহিত্যের জনক তো হুমায়ূন।’
আমি ভীষণ লজ্জা পাই। ‘জি স্যার পড়ি, অনেকই পড়ি।’ স্যারের সঙ্গে আমার আলাপ জমে যায়। একথা-সেকথার পর বাঙালির অবধারিত প্রিয় বিষয় রাজনীতি চলে আসে।
‘আমাদের দেশটার মানুষগুলো এত পরিশ্রমী, ভালো। নেতারা একটু ভালো হলেই আমরা কোথায় চলে যেতাম।’ আমি বলি।
‘একেবারে ফালতু কথা।’
তাঁর কথা শুনে আমি হকচকিয়ে যাই। বলি ‘মানে কী স্যার?’
‘শোনো, চল্লিশজন চোরের নেতা একটা চোরই হবে। ভালো মানুষ হবে না। দেশের মানুষ ভালো হলে নেতাও ভালো হতো।’
‘এইটা কী বললেন স্যার। দেশের অধিকাংশ লোক গরিব, কৃষিকাজ করে। তারা কেমনে চোর হয়।’ আমি তর্কের সুরে বলি।
‘শোনো, আমার কথা কারোরই ভালো লাগে না। তবুও বলি। দেশে দুই ধরনের মানুষ আছে। একদল “পাই তাই খাই” আর একদল হলো “পাই না তাই খাই না”। এই যেমন তুমি বেসরকারি চাকরি করো, তাই তুমি দ্বিতীয় দলে পড়ো।’
‘আপনার কথা মানতে পারলাম না।’ আমি বলি।
‘তুমি পোলাপান মানুষ। জীবনের কিছুই দেখো নাই। শোনো, আমারই দুই প্রফেসর কলিগ এক ঘুষখোর পুলিশ অফিসারের মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেওয়ার জন্য ঠেলাঠেলি, মারামারি করে শেষ পর্যন্ত থানায় মামলা পর্যন্ত করেছে। চারদিকে তাকাইয়া দেখো অসৎ লোকেরাই সমাজে সবচেয়ে সন্মানিত।’
আমার ভালো লাগে না এসব যুক্তি। আবার পাল্টা যুক্তি দিতেও ইচ্ছা করে না। এরপর কখনোই আর এই অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা হয় নাই। কিন্তু তবুও তাঁর কথাগুলো ভুলতে পারি নাই।
গত ডিসেম্বরে দেশে গিয়েছিলাম। দেশে তখন লাগাতার হরতাল, অবরোধ চলছে। আমার হাতে অফুরন্ত সময়। মোবাইলের ফ্ল্যাক্সি লোড করার জন্য একটা দোকানে যাই। দোকানির হাতে গল্পের বই। আড়চোখে চেয়ে দেখি রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ। সেটা দেখে ঈষৎ আগ্রহী হলাম। তাকে একটা চা দিতে বলি। আমি একাই গ্রাহক। টুকটাক গল্পের মধ্যে দোকানি নিজের কথা বলেন। নাম শফিক। বছর দুয়েক আগে তাঁর বাবা মারা গেছেন। এরপর সংসারের চাপ এসে পড়ে তাঁর ওপর। গ্রামের জমি বিক্রি করে দুই লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে এক সরকারি অফিসে পিওনের চাকরি নেন। বেতনের চাইতে উপরি বেশি ছিল। কিন্তু এই চাকরি তাঁর ভালো লাগে নাই। তাই চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর কথা শুনে আমি আশ্চর্য হই।
‘এ রকম ভালো ও নিশ্চিত আয় ছেড়ে এ রকম ব্যবসা করতে আপনার ভালো লাগে।’
‘সবাই এটাই জিগায় বড় ভাই। আসলেই আমার ভালো লাগে। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করে না।’
‘সবাই একটা সরকারি চাকরির জন্য পাগল। আর আপনি কি না সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে এরকম একটা ব্যবসা করছেন। বিশ্বাস না করারই কথা।’
‘ভাই শোনেন, ওই চাকরিতে কোনো শান্তি নাই। সব সময় মন ছোট হইয়া থাকে।’
‘কী বলেন, সবাই তো তাই করতাছে।’
‘বড় ভাই, আমার দোকানে আমার কলিগরা প্রায়ই আসে। সবাই এই রকম একটা কিছু করতে চায়। সাহস পায় না। আপনি জানেন না ১০০-২০০ টাকা মানুষের কাছে হাত পেতে নিতে কারোরই ভালো লাগে না। বিশ্বাস করেন ভাই, পরিবেশ পাইলে এ দেশের অধিকাংশ মানুষ সৎ জীবনযাপন করত।
তাঁর কথা শুনে খুব, খুউব ভালো লাগে। শফিকের কথা ঠিক নাকি সেই অধ্যাপকের কথা ঠিক—জানতে ইচ্ছা করে। ভোরের আগের আকাশ নিকষ কালো হয়, বর্তমান অবস্থাও কি তাই? জানি না, জানা যায় না। তবে শেষ পর্যন্ত আমি-আমরা মানুষের ওপরই বিশ্বাস রাখি, রাখতে হয়, রাখতে ভালো লাগে।

মোস্তাফিজুর রহমান
ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া