গর্বে বুক ভরে যায়

অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের একাংশের দলগত ছবি
অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের একাংশের দলগত ছবি

জার্মানির জর্জ আগুস্ত বিশ্ববিদ্যালয় গটিঙ্গেনে সব মিলিয়ে মাত্র ৩০ জনের মতো বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর পদচারণ। গটিঙ্গেন পরিচ্ছন্ন ছবির মতো ছোট্ট একটি শহর। একে বিজ্ঞানের শহরও বলা হয়৷ শহরটি মূলত জর্জ আগুস্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে গড়ে উঠেছে। এটি জার্মানির অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৪৫ জন নোবেল বিজয়ীর গৌরবে গৌরবান্বিত এই বিশ্ববিদ্যালয়।
গত ১৪ ডিসেম্বর ফয়ার ইন্টারন্যাশনাল, গটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয় ও এখানে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের যৌথ উদ্যোগে পালন করা হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও ৪৩তম মহান বিজয় দিবস। ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক কেন্দ্র খালি না থাকায় ১৪ ডিসেম্বর বেছে নেওয়া হয়।
পুর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বিকেল সাড়ে তিনটায় শহীদ বুদ্ধিজীবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অকুতোভয় শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিযুদ্ধে সব শহীদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর সমবেত কণ্ঠে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় মূলপর্ব৷ এ সময় সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন।
মিলন আর মাধুরী পালের চমৎকার বাঙালিয়ানা সাজ ও প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় বিজয়ের উৎসব হয়ে উঠেছিল মুখর। ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউটের বাংলাদেশি সিনিয়র সায়েন্টিস্ট কামাল চৌধুরী প্রধান অতিথির বক্তৃতায় সংক্ষেপে আমন্ত্রিত অতিথিদের উদ্দেশে বিজয় দিবসের সারমর্ম বুঝিয়ে বলেন।
অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল আমন্ত্রিত অতিথিদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও বর্তমান বাংলাদেশ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা। এ জন্য মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে তথ্য সংবলিত দুটি প্রেজেন্টেশনের ব্যবস্থা রাখা হয়। প্রথম অংশে মাযহারুল ইসলাম মামুন ১৯৪৭-এর দেশ ভাগ থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা, সত্তরের নির্বাচন, স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা, ১৯৭১ সালের গণহত্যা, পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার বাঙালির বিজয়গাথার ইতিহাস বর্ণনা করেন। দ্বিতীয় অংশে স্বাধীনতা–পরবর্তী অপরাজেয় বাঙালির দেশ গঠনের সম্মিলিত সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, নারীর ক্ষমতায়ন, বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনযাপন, সংস্কৃতি, উৎসব, শিক্ষা, খাদ্য, ক্রিকেটের বিজয়গাথা, শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশি অকুতোভয় সেনাদের ভূমিকা, নোবেল বিজয়, বিগত বছরের প্রাপ্তি এবং স্বাধীনতার মাত্র ৪০ বছরে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে জেগে ওঠা জাতির সচিত্র প্রতিবেদন পেশ করেন গটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষার্থী সোহাগ মিয়া। এ ছাড়াও অনুষ্ঠানের পুরো অংশে আমন্ত্রিত অতিথিদের বাংলাদেশ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের চমৎকার জবাব দিয়ে বাংলাদেশ ভ্রমণে আগ্রহী করে তোলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সাইফুর রহমান, তহিদুল ইসলাম, তাইবুর রহমান, রুখসানা আমিন রুনা, শ্যামল কর্মকার প্রমুখ।
শিক্ষার্থী শাফীর ভরাট কণ্ঠে ‘আমি বাংলায় গান গাই’ কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে বাংলার বৈচিত্র্য রূপের বর্ণনা উঠে আসে। আফরোজা ভাবির বাদ্যযন্ত্র ছাড়া খালি গলার গান আর সুকন্যার গাওয়া ‘যাও পাখি বল তারে’, তানিমের ‘ওরে নীল দরিয়া’ বিদেশি অতিথিদের মুগ্ধ করে।
বিদেশি শিক্ষার্থীদের প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল বাংলা গানের সঙ্গে মন্দিরা সেন আর শঙ্করীর মনোমুগ্ধকর শৈল্পিক নৃত্য। এ যেন গটিঙ্গেনে রমনা বটমূল আর ডিসি হিলের প্রতিচ্ছবি। দর্শকের আসনে বসা নেপালি ছাত্রী আনু সিং বলেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের খুব কাছের একটি দেশ, অথচ এদের সংস্কৃতি এত উন্নত আগে বোঝার সুযোগ হয়নি।’ ‘কারার ঐ লৌহ কবাট’ গানের সঙ্গে জার্মান শিশু নয়নের নাচ আর বাংলাদেশি সারার ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী’ অনুষ্ঠানের বৈচিত্র্য এনে দেয়।
জর্জ আগুস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কো–অর্ডিনেটর সিমোনি প্রিফার তাঁর পরিবার নিয়ে এসেছিলেন বিজয়ের উৎসব উপভোগ করতে। তিনি বলেন, ‘আমি সব সময়ই চাই আমার সন্তানরা পৃথিবীর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির সঙ্গে বেড়ে উঠুক। আমার পরিবার নিয়ে আসা সফল হয়েছে কারণ তোমাদের এই আয়োজন ছিল তথ্যে ভরপুর আর উন্মুক্ত।’ জার্মান প্রকৌশলী ব্র্যান্ড কনিরিম বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বলেন, ‘ইন্টারনেট সার্চ করে বাংলাদেশ সম্পর্কে সহজে তথ্য পাওয়া কঠিন৷ সেগুলো তোমরা সহজেই আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছ।’
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পক্ষে শ্যামল কর্মকার সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে প্রথম পর্ব সমাপ্ত করেন ও বাংলাদেশি খাবারের স্বাদ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানান।
বাংলাদেশি খাবার স্বাদেগুণে অনন্য করে তোলার গুরুদায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে প্রদীপ সরকার, নার্গিস সুলতানা, তুলিকা সরকার ও আফরোজা সুলতানা সুবাহ। তাঁরা কয়েক দিনের পরিশ্রমে তৈরি করা বাহারি রকমের বাঙলি খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন। খিচুড়ি, সবজি, আলু ভর্তা, মাংস, পায়েস, গাজরের হালুয়া, আপেলের চাটনি—কী ছিল না সেখানে? বিদেশি শিক্ষার্থীদের অনেকেই জীবনের প্রথমবার বাংলাদেশি খাবারের স্বাদ নিয়েছেন এই অনুষ্ঠানে এসে। ব্রাজিলের জুলিয়ানা, ঘানার অ্যাডাম, উত্তর কোরিয়ার জিয়াং চ্যাং, ফিলিপাইনের আন্না মারথা—এঁদের সবার একই মন্তব্য, বাংলাদেশি ফুড ইজ গুড। পুরো অনুষ্ঠানের ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে গিয়ে নিপুণ ফটোগ্রাফারের পরিচয় দেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদমান সাকিব।
অবশেষে প্রাণের বিজয় উৎসবের সমাপ্তি। মনে বাংলাদেশ জয়ের তৃপ্তি নিয়ে ডরমেটরিতে ফিরি সবাই। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার কয়েক দিন পরও যখন বিদেশি বন্ধুদের মুখে বাংলাদেশ শব্দ শুনি, গর্বে বুক ভরে যায়। চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ে। মনের অজান্তেই বলে উঠি, ‘আমার প্রাণের বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি । আর তোমারই হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি।’
সোহাগ মিয়া
জর্জ আগুস্ত বিশ্ববিদ্যালয় গটিঙ্গেন, জার্মানি