অতি বড়লোক আমি!

সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে লেখিকা
সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে লেখিকা

জি, আমি অনেক বড়লোক৷ কী জানি নাম লোকটার, মুসা বিন শমসের, তাঁর চাইতেও। আমার স্বামী খুব অবাক হয়ে ভ্রু জোড়া কিঞ্চিত কাছাকাছি করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আমি একই কথা দ্বিতীয়বার বললাম এবং নিজেই আবার জিজ্ঞাসা করলাম; কেন জানো? উওরটাও যথারীতি আমিই দিলাম৷ বললাম, আমার কাছে অনেক দামি একটা সম্পদ আছে। জানো কী সম্পদ?
আমার সামনের তিনি খানিকটা অবাক আর খানিকটা বিরক্ত হয়ে জানতে চাইল কী? তার দৃষ্টি তখন টিভির মনিটরে আটকানো৷ না হলে দেখতে পেত উত্তর দেয়ার সময় আমার চোখটা কেমন চকচক করে উঠেছিল৷ তারপর কেন জানি স্বাভাবিকের চেয়ে একটু জোরেই বললাম, ‘আমার বন্ধুরা৷’
সামনের জন হয়তো তার নামটা আশা করছিল৷ আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে মৃদু হেসে বলল, ও, তাই!
আমি খুব জোর দিয়ে বললাম, হু।
তারপর আমি আমার ঝুলির ‘বন্ধু পার্টটা’ তার সামনে খুললাম। খুলে আমিই থ! কী বিশাল গল্পের প্রাচুর্য৷ কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব৷ রাগ, অভিমান, ভালোবাসা, কী নেই সেখানে। জ্ঞান অর্জন যতটা না বেশি ক্লাস রুমে হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হয়েছে বন্ধুদের রুমে। স্যার-ম্যাডামদের কিছু কিছু কথা এনটেনায় বাড়ি দিলেও বেশির ভাগই এনটেনার ওপর দিয়ে যেত৷ ভাগ্যিস বন্ধুদের ক্লাসটা ছিল।

সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে লেখিকা
সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে লেখিকা

পরীক্ষার আগের দিন সবচেয়ে বড় ভিখারি মনে হয় আমিই ছিলাম৷ কিন্তু বন্ধুরা আমার থালা সব সময় ভরিয়ে দিত। জীবনে কবে নোট করছিলাম মনে নেই৷ বন্ধুর নোটের ওপর চেপে পরীক্ষা নামক পুলসিরাত পাড়ি দিয়েছি। উফ! প্রতিটি অ্যাসাইনমেন্টের ডেডলাইন ছিল কেয়ামতের আগের দিনের মতো৷ ওই দিনগুলোতেও বন্ধুরা আমার হাত ছাড়ে​নি। বন্ধুদের বদৌলতে সার্বজনীন শিক্ষাই (কপি পেস্ট আর কি) শিক্ষিত হয়ে কেয়ামতের আগের দিনটা খুব দৌড়ের ওপর দিয়া যেত। একবার তো এমনি কপি পেস্ট করেছিলাম যে, নিজের বাপ-মায়ের দেয়া নামের জায়গায় ওই বন্ধুর নামটাই বসিয়ে দিয়েছিলাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি আমার স্বামী এটিএন নিউজ দেখা বাদ দিয়ে আমার গল্প শুনছে। আমাকে তখন নেশায় পেয়ে গেছে, গল্পের নেশা।
আনন্দ কীভাবে করতে হয় তা-ও শিখেছি আমার বন্ধুদের কাছ থেকে...কত স্মৃতি! আমার মোবাইলের ইনবক্সটা সব সময় ভালোবাসার মানুষটার চেয়ে ভালোবাসার বন্ধুদের বার্তায় পরিপূর্ণ থাকত। আমার বন্ধু প্যাকেজে সবই আছে; মা, ম্যাডাম, উরাধুরা সন্ন্যাসী, মডেল, রোল মডেল...সবকিছু৷ মিলায়া ফুল প্যাকেজটা আমছালা। এক-আধবার মনোমালিন্য হলে ভাবছি, ওর সঙ্গে আর কখনোই কথা বলব না৷ কিন্তু

সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে লেখিকা
সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে লেখিকা

আফসোস ও তো বন্ধু, আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটা অংশ৷ যে অংশ ছাড়া জীবিত থাকাই কঠিন৷ আর তাই মনোমালিন্যের সঙ্গেই কম্প্রমাইজ করলাম৷ বাবা, তুমি দূরে থাকো, বন্ধুরাই কাছে থাক।
গল্পের একপর্যায়ে আমি চুপ৷ সামনের জন খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, কী হলো? আমি খুব খুশি হয়ে বললাম, ইস! আমি এত বড়লোক কেন? ততক্ষণে আমার স্মৃতির ঝুলিতে বন্যা, না না, সুনামি চলছে৷ এক একটা স্মৃতি পাড়ে আছড়ে পড়তে না পড়তেই, অন্য আরেকটা চলে আসছে। এত স্মৃতি যে আক্ষরিক রূপ দিয়ে এই চারকোনা বক্সে ভরা রীতিমতো অসম্ভব।
এই পৃথিবীতে কিছু লোক হয়তো আমাকে ভালোবাসে৷ কিন্তু আমার জন্য কাঁদতে পারবে কয়জন। আমার বন্ধুরা পারে৷ শেষবার যখন কাঁদল, আমিও কাঁদলাম৷ কিন্তু ভেতরটা অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে গেল৷ আমি অনেক বড়লোক, কেননা কেউ তো আছে যে তার মহামূল্যবান চোখের পানি আমার নামে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। মাঝেমধ্যে যখন লাইফে লোডশেডিং ছিল, এই বন্ধুরাই তখন চার্জার লাইট হয়ে আমাকে ঠিক পথে নিয়ে এসেছে। আমার জীবনের রাস্তার ভালো-মন্দ সব সময়গুলোতেই ছায়া সঙ্গীর মতো বন্ধুরা জানান দিয়েছে ‘আমি আছি তো!’

এই বিশাল দেশটার সুবিশাল মানচিত্রে কত পরিচিতের আনাগোনা৷ কিন্তু বন্ধু নামের সেই মহামূল্যবান সম্পদের বড্ড অভাব এখানে৷
মিনিট পাঁচেক পর, আমার স্বামী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, কারণ স্মৃতির ঝুলি রেখে সুনামি তখন আমার চোখের ট্যাংকে সওয়ার হয়েছে৷ এই পানি দুঃখের নয়, সুখের...অতি সুখের।

(উড সাইড, নিউইয়র্ক)