বাসভূমির এক যুগ পূর্তি

ক্যামেরা হাতে আকিদুল ইসলাম
ক্যামেরা হাতে আকিদুল ইসলাম

অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে সংস্কৃতির আদান প্রদানের জন্য দীর্ঘদিন থেকে কাজ করছেন সিডনিপ্রবাসী আকিদুল ইসলাম। আশির দশকে যে কজন মূলধারার ছড়াকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সৃজন কুসুম ফুটিয়েছেন, আকিদুল ইসলাম তাদের অন্যতম। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশের প্রথম বিনোদন পাক্ষিক তারকা কাগজের সম্পাদনা পরিষদে যোগ দেওয়ার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। সাহিত্যিক, সাংবাদিক, নাট্যকার ও পরিচালক আকিদুল ইসলাম বেশ কয়েক বছর থাইল্যান্ডে অবস্থানের পর ১৯৯৫ সালে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে।
প্রবাসে নানারকম প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতার মাঝে বাংলা সংস্কৃতি ও সাহিত্য চর্চা এবং এর প্রসার ও প্রয়োগ দেশের তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন ও কষ্টকর। তারপরও অনেকে চেষ্টা করে যান। প্রবাসের মূলধারায় বেড়ে ওঠা প্রজন্মের জন্য বাংলা সংস্কৃতিচর্চার এক অনন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন তিনি। মূলত বিদেশের মাটিতে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে বাংলা সংস্কৃতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে বাসভূমির যাত্রা। বাসভূমির ১২ বছর পূর্তির ঘটনাকে প্রবাসে বাংলা সংস্কৃতি লালনের ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক ঘটনা বলে অভিহিত করেন বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেকেই। এ উপলক্ষে আগামী ৭ জুন বর্ণাঢ্য ও জাঁকজমকপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এক যুগ পূর্তি উদ্‌যাপন করতে যাচ্ছে বাসভূমি। সিডনির হার্সভিল এন্টারটেইনমেন্ট সেন্টারে সন্ধ্যা ৬টায় যুগপূর্তি উৎসবের শুভ সূচনা হবে। স্থানীয় শিল্পীদের নৃত্য ও সংগীত পরিবেশনার পর বাসভূমি নির্মিত টেলিফিল্ম সিডনি টু মুরাদনগরের প্রিমিয়ার শো হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন বাংলাদেশের স্যাটেলাইট টেলিভিশন আরটিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আশিক রহমান।

বাংলাদেশের মূলধারার শিল্পীদের সঙ্গে আকিদুল ইসলাম
বাংলাদেশের মূলধারার শিল্পীদের সঙ্গে আকিদুল ইসলাম


দীর্ঘকাল পরিসরে বাসভূমির অর্জনের পাখায় অনেক সোনালি পালক যুক্ত হয়েছে। বাসভূমি মূলত একটি অনলাইন পত্রিকা হলেও দেশীয় সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করেও প্রশংসিত হয়েছে। কয়েক বছর আগে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশি মেধাবী ছাত্র তানভীর ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হলে কমিউনিটির কয়েকজন সংগঠককে নিয়ে বাসভূমির নেতৃত্বে গঠিত হয় একটি সাহায্য তহবিল। বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রবীণ নেতা গামা আবদুল কাদির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন ও সদস্যসচিব ছিলেন খালেদা কায়সার। কমিটির অন্যান্য সদস্য ছিলেন কায়সার আহাদ, মিজানুর রহমান মামুন, এ কে এম শামসুজ্জামান, মো. বেলায়েত হোসেন, জিয়াউল হাসান ও আকিদুল ইসলাম। মাত্র কয়েক সপ্তাহে বাসভূমির অভাবনীয় আহবানে সাড়া পড়ে যায় কমিউনিটির মাঝে। তখন বাসভূমি ১৬ হাজার এক শ ৬৯ ডলার পাঁচ সেন্ট সংগ্রহ করে ওই ছাত্রটির পাশে দাঁড়িয়েছিল। দেশের অসহায় মুক্তিযোদ্ধা মজিদ মিয়া অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে না পারার সংবাদ দৈনিক আমাদের সময়ে ছাপা হলে বাসভূমির উদ্যোগে ৫০ হাজার টাকা আমাদের সময়ের সম্পাদকের মাধ্যমে মজিদ মিয়ার কাছে পৌঁছানো হয়। মুক্তিযুদ্ধে নিহত পাঁচ সন্তানের জননী নিত্য রানি ভিক্ষা করার সংবাদ দেশের একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে বাসভূমি একটি সাহায্য তহবিল গঠন করে। কায়সার আহমেদ, পি এস চুন্নু ও আকিদুল ইসলামের উদ্যোগে নিত্য রানিকে দেওয়া হয় ৩০ হাজার টাকা।
অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক নির্মাণ প্রতিষ্ঠান বাসভূমির বর্তমানে কর্ণধার আকিদুল ইসলাম। বাসভূমির ব্যানারে ইতিপূর্বে নির্মিত হয়েছে খণ্ড নাটক, টেলিফিল্ম, ধারাবাহিক নাটক ও ট্রাভেল শোসহ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান। এখন নির্মিত হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি আর দর্শনীয় জায়গাগুলোর বর্ণনাসহ প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবন আলেখ্য ও বঙ্গোপসাগরের তীর থেকে উঠে এসে কীভাবে এই প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে বসতি স্থাপন করা যায় তার অনুসন্ধানী, ঐতিহাসিক তথ্য ও উপাত্ত নিয়ে ১০১ পর্বের ট্রাভেল ডকুমেন্ট। এর রচয়িতা ও পরিচালক আকিদুল ইসলাম নিজেই। বাসভূমির ব্যানারে নির্মিত এই ভ্রমণ চিত্রটি ৫০০ পর্বের হবে বলে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে।

আকিদুল ইসলাম এই লেখিকাকে বলেন, নামকরণ ট্রাভেল ডকুমেন্ট হলেও এটি মূলত একটি ইতিহাসের আলোকিত অনুষঙ্গ। এই ধারাবাহিক ভ্রমণ চিত্রের উপস্থাপনায় রয়েছেন শামান্তা ইসলাম ও রূপন্তি। সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন প্রভাত হাসান ও রাকেশ মণ্ডল। তাদের সঙ্গে থাকছেন একঝাঁক মেধাবী তরুণ তরুণী।

বাসভূমির এক যুগ পূর্তির পোস্টার
বাসভূমির এক যুগ পূর্তির পোস্টার

আন্তর্জাতিক ভাবে বাংলা চলচ্চিত্রকে ছড়িয়ে দিতে প্রযোজনা সংস্থা বাসভূমি নির্মাণ করতে যাচ্ছে পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্র। আকিদুল ইসলাম আশা ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশের বাইরে অস্ট্রেলিয়া হবে বাংলা চলচ্চিত্রের দ্বিতীয় বাজার। আগামী জানুয়ারিতে চলচ্চিত্রটির শুটিং শুরু হবে। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে চিত্রায়ণ হবে সিনেমাটির। বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় তারকাদের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এতে অভিনয় করবেন। চলচ্চিত্রটির সম্ভাব্য নাম দরজা খোলো প্রিয়ন্তি। বাসভূমির যুগপূর্তি উৎসবে দরজা খোলো প্রিয়ন্তির শুভ মহরত অনুষ্ঠিত হবে।
তিনি জানান, প্রতিবেশী দেশ ভারতে তাদের চলচ্চিত্র একটি রপ্তানিমুখী শিল্প। এ শিল্পের মাধ্যমে ভারত প্রতিবছর রেকর্ড পরিমাপ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। সেটি আমাদের চলচ্চিত্র থেকেও সম্ভব। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের তরুণ ও মেধাবী পরিচালকরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন বাংলা চলচ্চিত্রকে স্বর্ণযুগে ফিরিয়ে নেওয়ার। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, মেধাবী তরুণ নির্মাতাদের এফডিসি থেকে দূরে রাখা কিংবা অবমূল্যায়ন করা, পরিবারতন্ত্রের ভেতর দিয়ে বাংলা সিনেমার ভূত-ভবিষ্যৎ নির্ণয় ও অযৌক্তিক সেন্সর প্রথার মধ্য দিয়ে আমাদের জৌলুসপূর্ণ সিনেমা শিল্পকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েও গত দুই-তিন বছর বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য উল্লেখযোগ্য বছর ছিল। কয়েক দশকের সংকটকালেও আমরা পেয়েছি বিচিত্র বিষয়ের অনন্য সব চলচ্চিত্র। নির্মিত হয়েছে মনপুরার মতো অত্যন্ত জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। সুভা, আয়না, ঘানি, মাটির ময়না, রানওয়ে, খেলাঘর, আমার বন্ধু রাশেদ, শঙ্খনাদ, ডুব সাঁতার, নিরন্তর, হাজার বছর ধরে, চন্দ্রগ্রহণ কিংবা আহা অথবা গেরিলার মতো ভালো চলচ্চিত্র। একমাত্র সুস্থধারার চলচ্চিত্রই হচ্ছে সেই মাধ্যম। চলচ্চিত্র এমন একটি মাধ্যম, যা দিয়ে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।
শুধুমাত্র অবকাঠামোর অভাবে দর্শকদের আমরা বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত করতে পারছি না। বর্তমানে পৃথিবী হয়ে গেছে একটা গ্লোবাল ভিলেজ। সারা বিশ্বে স্থায়ী-অস্থায়ী অভিবাসী হিসেবে এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি বসবাস করছে। সেদিক থেকে প্রবাসে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য দর্শকেরা তৈরি হয়েই আছেন। কারণ চলচ্চিত্র এখনো বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। নির্বাক থেকে সবাক-সব সময়ই চলচ্চিত্র একটা সময়কে ধারণ করে, সে সময়ের মানুষের নানান অনুভূতির কথা বলে।