মার্কিন মুল্লুকে বাংলাদেশি-আমেরিকান গাড়ি প্রকৌশলী

ক্যাডিলাক গাড়ির পাশে বাংলাদেশি একজন প্রকৌশলী
ক্যাডিলাক গাড়ির পাশে বাংলাদেশি একজন প্রকৌশলী

সাত সমুদ্র আর কয়েক হাজার মাইল দূরের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলা ভাষাভাষীদের আগমন নিয়ে তথ্য ঘেঁটে জানা যায়, প্রথম ইমিগ্রান্ট হিসেবে মার্কিন মুলুকে বাঙালির আগমন ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে। চা চাষের ক্রীতদাস হিসেবে। সেই ক্রীতদাসদের আনা হয়েছিল আসাম ও চট্টগ্রাম থেকে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। আরেকটি সূত্রে বলা হয় প্রথম বাঙালি আসে ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলে পড়াশোনা করতে। শুরুর দিকে আসা বাঙালিরা উচ্চশিক্ষিত। বাংলাদেশিদের পদযাত্রা শত বছরের হলেও এখন পর্যন্ত মার্কিন মুল্লুকে বাংলাদেশিদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। উইকিপিডিয়ার হিসাবমতে মাত্র পাঁচ লাখ। সংখ্যার হিসাবে অনেক না হলেও এই দেশে বাংলাদেশিদের অনেকেই আলাদাভাবে চিনেন বিভিন্ন মৌলিক কারণে। বিশ্বখ্যাত স্থপতি বাংলার গর্ব ফজলুর রহমান খানের কীর্তি কথা এবং তার নকশায় বানানো শিকাগোর গগনচুম্বী ভবন সিয়ারস টাওয়ার (বর্তমানে উইলস টাওয়ার) আমেরিকার তথা সারা বিশ্বের মাঝে এক উল্লেখযোগ্য স্থাপনা। এই দেশে ট্যাক্সি চালকদের সততার উদাহরণ অনেকবার বিশ্ব মিডিয়াতে আলোড়ন তুলেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমনি ভাবে হয়তো বা কেউ কখনো শোনেননি কিংবা শোনার পটভূমি তৈরি হয়নি বাংলাদেশি গাড়ি প্রকৌশলীদের কীর্তিগাথা বা কাব্যকথা।
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যকে বলা হয় গাড়ির রাজধানী। মিশিগান অঙ্গরাজ্যের বৃহৎ শহর ডেট্রয়েটের চারপাশে বিশ্বের প্রায় সকল বড়বড় বহুজাতিক গাড়ি কারিগরদের প্রকৌশল কেন্দ্র। এখানে রয়েছে জেনারেল মটরস, ফোর্ড মোটর, ফিয়াট মোটর ও ক্রাইসলার গাড়ি কোম্পানিগুলোর সদর দপ্তর। রয়েছে টয়োটা ও নিশানের মতো জাপানি, কোরিয়ান হুন্দাই ও কিয়া কোম্পানিগুলোর প্রকৌশল শাখা। আনন্দের সঙ্গে বলতেই হয় প্রতিটি কোম্পানিতেই কর্মরত আছেন বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা। গর্বের বিষয় এই যে, উত্তর আমেরিকায় প্রস্তুত করা প্রতিটি গাড়িতেই রয়েছে বাংলাদেশি কারিগরি হাতের ছাপ।

ক্যাডিলাক গাড়ির পাশে বাংলাদেশি একজন প্রকৌশলী
ক্যাডিলাক গাড়ির পাশে বাংলাদেশি একজন প্রকৌশলী


গাড়ি আর গাড়ির কারিগর নিয়ে যেহেতু কথা বলছি, তাই গাড়ির কারুকাজে ভরা দুটো সিনেমার নাম উল্লেখ না করে থাকতে পারছি না। ট্রান্সফরমার ছবিতে বাম্বল বির হঠাৎ করে নতুন মডেলের ক্যামেরোতে রূপান্তরিত হওয়া সিনেমাপাগল দর্শকদের কাছে অতি পরিচিত একটা দৃশ্য। আরেকটা সিনেমা হলো দ্য ম্যাট্রিক্স রি লোডেড। এই ছবিতে বৃহৎ আকারের গাড়ি ক্যাডিলাক এসক্যালেডের খোলা ছাদ থেকে গুলি বিনিময়ের দলগুলোও সিনেমাপাগল দর্শকদের সহজে ভোলার কথা নয়। ক্যামেরো আর ক্যাডিলাক এসক্যালেড কেবল মার্কিন মুল্লুকেই নয়, সারা বিশ্বে গাড়ির গুণগত মানের বিচারে খুবই জনপ্রিয়। ক্যামেরো আর ক্যাডিলাক এসক্যালেড গাড়ির চেসিস (বাহ্যিক কাঠামো) আর সাসপেন্সনের লিড প্রকৌশলী ছিলেন আমাদের বাংলাদেশি প্রকৌশলী ফেরদৌস গাজি।
এ ক্ষেত্রে কিছু নাম না বললেই নয়। খাজা রহমান হাইব্রিড গাড়ির দুনিয়ায় এক উল্লেখযোগ্য নাম। ডজনের বেশি পেটেন্টের মালিক তিনি। কাজ করছেন জেনারেল মটরসে। নতুন শতাব্দীর প্রযুক্তি এই হাইব্রিড গাড়িতে আরও কাজ করছেন মোহাম্মাদ শহিদুল খান রুবেল।
ফেসবুকের এক স্ট্যাটাসে জেনারেল মোটর কোম্পানির বিদ্যুৎ চালিত গাড়ি ভল্টের নির্মাণ ভিডিও শেয়ার করে জাফরী আল-ক্বাদরী লিখেছেন, আমার ভল্ট, উনি ওই গাড়ির ইনভার্টার সিস্টেমের লিড প্রকৌশলী, শুধু তাই নয় উনিও পেটেন্টের মালিক। আরেক স্ট্যাটাসে ফোর্ডের প্রকৌশলী রাহাত খান লিখেছেন, বলেন তো, এই গাড়ির শিফটার তৈরিতে কার কারিগরি? নিচে নতুন সুপার কার ফোর্ড জিটির ছবি। এ যেন এক বড় গর্বের সংবাদ।

প্রকৌশলী সকার দলের সদস্যরা
প্রকৌশলী সকার দলের সদস্যরা

ক্রাইসলার জিপ কোম্পানিতেও রয়েছে বাংলাদেশি ম্যানেজার ও উল্লেখ করার মতো কিছু প্রকৌশলী। টয়োটা ও নিশান মটরসে সম্প্রতি পরিচিত হলাম। যাদের নাম এক এক করে বলতে থাকলে সামনে আসতে থাকবে অসংখ্য গাড়ির নাম আর তার সঙ্গে জড়িত থাকা অসংখ্য বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের নাম। যারা নামের পেছনে না ছুটে নিরলস কাজ করে চলেছেন চুপিসারে।
গাড়ি নিয়ে গবেষণা, নকশা, উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক নির্মাণের প্রতিটি ধাপেই আজ বাংলা হাতের কারিগরি। অতি অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের প্রকৌশলীরা নিজ নিজ শাখার হয়েছেন লিড প্রকৌশলী, ম্যানেজার বা প্রধান প্রকৌশলী। গাড়ির ইঞ্জিন, ফুয়েল সিস্টেম, ব্রেক সিস্টেম, থার্মাল সিস্টেম, গ্লাস, আয়না, বাহ্যিক বডি, ইনটেরিওর সিস্টেম, সিট সিস্টেম, সেফটি সিস্টেম, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং—সব জায়গাতেই আমাদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
গাড়ি নির্মাণ কোম্পানি ছাড়াও গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরি বা সরবরাহের কোম্পানিগুলোতেও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রকৌশলীদের উপস্থিতিও উল্লেখ করার মতো। নির্দিষ্ট করে কোনো কোম্পানি বা ব্রান্ডের নাম তাই বললাম না। কারণ তাতে পুরো পাতা ফুরিয়ে যাবে।
শুধু প্রকৌশলীরা নন, গাড়ির যন্ত্রাংশ ও গাড়ি নির্মাণ শ্রমিকেদের একটি অংশও বাংলাদেশি। তাদের উপস্থিতি ও সাফল্য অনস্বীকার্য। তাদের সন্তানরা আজ ডাক্তার ও প্রকৌশলী। আবার অনেক অগ্রজ শুরুতে গাড়ি কোম্পানিতে কাজ করলেও নিজেই গড়ে তুলেছেন নিজের ফার্ম।
কর্মক্ষেত্রে গাড়ি প্রকৌশলীদের হাজারো ব্যস্ততা থাকলেও বাংলাদেশি আড্ডায় কিন্তু সবার সরব উপস্থিতি। আমাদের প্রকৌশলীদের রয়েছে ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন ও টেবিল টেনিস দল। আর এসব দলে খেলার প্রধান শর্ত—বাংলায় কথা বলা। আর খেলা মানেই মাঠে পুরো পরিবারের উপস্থিতি। যেন পারিবারিক মিলনমেলা। বাৎসরিক বনভোজন হয় কয়েকটা। সব কিছু মিলে এ যেন বইতে পড়ে আদর্শ জনতার প্রতিদিনের কর্ম লিপি আর বাস্তবে সেটা ঠিক ঠিক ঘটে যাওয়ার মতন অপূর্ব ঘটনা। এসব পারিবারিক আয়োজনে সুযোগ হলেই হাজারো হাসি কৌতুকের মাঝে অতি প্রচলিত কৌতুক হলো—তোমাদের কোম্পানির এই গাড়িটা এতটা ভালো না ভাই—এর হর্স পাওয়ার এত কম কেন? ইত্যাদি, ইত্যাদি, রচিত হয় উৎসাহ আর উপদেশের মহা উৎসব।

প্রকৌশলী ক্রিকেট দলের সদস্যরা
প্রকৌশলী ক্রিকেট দলের সদস্যরা


কয়েকটা ভিন্ন বিষয়, যে বিষয়গুলো না বললে মার্কিন মুল্লুকে আমাদের এই সব বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রকৌশলীদের পুরো পরিচয়টা দেওয়া হবে না। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মাঝেও তারা নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছেন এই দেশের মূলধারার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। বাংলাদেশি আমেরিকান ডেমোক্রেটিক ককাস, মিশিগানে ডেমোক্রেটিক দলের একটি সহযোগী সংঘ, যার বর্তমান চেয়ারম্যান হলেন বাংলাদেশি প্রকৌশলী নাজমুল হাসান শাহিন। বিগত কয়েকটি নির্বাচনে এই বাংলাদেশি আমেরিকান ডেমোক্রেটিক ককাস সংঘের কর্মকাণ্ড ছিল চোখে পড়ার মতন। অন্যদিকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরেও একইভাবে সাংগঠনিক ভাবে পেশাগত পরিধিতে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করে রেখেছেন এই সব বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রকৌশলীরা। লালন করে চলেছেন ত্রিশ বছরে পুরোনো আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশি ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড আর্কিটেক্ট নামের সংগঠনের মিশিগান অধ্যায়কে।
(লেখকেরা গাড়ি প্রকৌশলী)