রাশিয়ার পোশাক বাজারে বাংলাদেশের সম্ভাবনা

মেলায় বাংলাদেশ স্টল
মেলায় বাংলাদেশ স্টল

২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। আর অর্থবছর শেষে প্রকৃত রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। এই রপ্তানি আয়ে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে দেশের তৈরি পোশাক শিল্প। মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাসের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, তৈরি পোশাক খাত থেকেই আয় হয় প্রায় ৮৪ শতাংশ। এর মধ্যে নিট পোশাক থেকে ১২ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন, ওভেন পোশাক থেকে ১৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ও বিশেষায়িত বা হোম টেক্সটাইল থেকে আয় আসে দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ইউরোপ। আর একক দেশ হিসেবে দেশের পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া দেশে উৎপাদিত তৈরি পোশাক মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও আরও অনেক দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে।

মেলায় বিভিন্ন দেশের স্টল
মেলায় বিভিন্ন দেশের স্টল

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সম্ভাবনাময় একটি বিশাল বাজার হতে পারে রাশিয়া। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পোশাক আমদানিকারক দেশ রাশিয়া। এখানকার পোশাক বাজারের বর্তমানে একটা বিরাট অংশ দখল করে আছে চীন। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে তুরস্ক। হাঙ্গেরিভিত্তিক ওয়াই কনসালটিং অ্যানালিস্ট নামের প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক এক জরিপে বলা হয়, রাশিয়ায় পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম যৌথভাবে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে। গত অর্থবছরে রাশিয়ায় ২৯৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমমূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশে। যার মধ্যে ১৩০ মিলিয়ন নিট পোশাক, ওভেন পোশাক ৮৫ মিলিয়ন ও ২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ছিল হোম টেক্সটাইল।
রাশিয়ায় পোশাক রপ্তানির সুযোগ আর সম্ভাবনা খুঁজতে গত কয়েক বছর ধরে মস্কোর আন্তর্জাতিক বস্ত্র ও পোশাক শিল্প মেলায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করছে বাংলাদেশ। সদ্য শেষ হওয়া ৪৫তম ফেডারেল ট্রেড ফেয়ার ফর অ্যাপারেলস অ্যান্ড টেক্সটাইল ‘টেক্সটাইলজিপ্রোম’ শীর্ষক মেলায় এবার বাংলাদেশের পাঁচটি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পৃষ্ঠপোষকতায় মেলায় বাংলাদেশ যোগ দেয়।
২২ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মস্কোর ভেদেনখার তিনটি প্যাভিলিয়ন জুড়ে এ পোশাক শিল্প মেলার আয়োজন করে রাশিয়ার টেক্সটিলএক্সপো নামের একটি কোম্পানি। এ বছর বিশ্বের ২৯টি দেশের ছোট-বড় প্রায় দুই হাজার পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেয়।

মেলায় বাংলাদেশ কর্নারের উদ্বোধন করছেন রাষ্ট্রদূত সাইফুল হক
মেলায় বাংলাদেশ কর্নারের উদ্বোধন করছেন রাষ্ট্রদূত সাইফুল হক

বাংলাদেশর স্টলগুলোর অবস্থান ছিল ৭৫ নম্বর প্যাভিলিয়নে। রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সাইফুল হক ফিতা কেটে মেলায় বাংলাদেশ কর্নারের উদ্বোধন করেন। এ সময় কমার্শিয়াল কাউন্সিলর আশফাকুল ইসলাম, প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে এয়ার কমোডর সাইফ সিদ্দিকী, কাউন্সিলর ও দূতালয় প্রধান আন্দ্রিয় দ্রংসহ মেলায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশি প্রতিনিধি দলের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধন শেষে রাষ্ট্রদূত মেলায় আগত বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের প্রতিটি স্টল ঘুরে দেখেন ও তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
এ সময় রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও নিট পোশাকের সঙ্গে রুশরা বেশ ভালো করেই পরিচিত। বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের গুণগত মান ও কম দামের সুযোগ থাকায় রাশিয়ার বাজারে সহজেই শক্ত অবস্থান নেওয়া সম্ভব। এ খাতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানের চেষ্টা চলছে। দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বেগবান করতে রাশিয়া-বাংলাদেশ উভয়ই বদ্ধপরিকর বলে তিনি জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার পোশাক শিল্পের এই খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ব্যাপারে রপ্তানিকারকদের সব ধরনের সহায়তা দিতে বাংলাদেশ দূতাবাস তৈরি রয়েছে। মস্কোতে বাংলাদেশের একক পোশাক মেলা আয়োজনের জন্য সফররত ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দলকে আহ্বান জানান রাষ্ট্রদূত।
রুশ আমদানিকারকদের বাংলাদেশি মানসম্পন্ন তৈরি পোশাক আমদানি করার জন্য মেলায় আহ্বান জানানো হয়। মেলায় অংশ নেওয়া প্যাসিফিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাসানুজ্জামান টিটো জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের গুণগতমান, প্রতিযোগিতামূলক দাম ও দ্রুত সরবরাহের নিশ্চয়তা সম্পর্কে এখানকার আমদানিকারকদের কাছে তুলে ধরা হয়। অতি শিগগিরই রাশিয়ার পোশাক বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের আধিপত্য বিস্তার করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
রাশিয়ার ব্যাংকিং জটিলতা ও রপ্তানিতে অতিরিক্ত শুল্কের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক সরাসরি রাশিয়ার বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইউরোপের কোনো দেশ হয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রাশিয়াতে ঢুকতে হয়। পণ্য পরিবহন খরচ তাই বেড়ে যাওয়ায় স্বভাবতই অনেকটা চড়া দামেই ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ খ্যাত পোশাক কিনতে হচ্ছে রুশদের। এই প্রসঙ্গে ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় দূতাবাসের কমার্শিয়াল উইং-এর উদ্যোগে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে দূতাবাসের কর্মকর্তারা ও বাংলাদেশ থেকে আগত পোশাক ব্যবসায়ীরা অংশগ্রহণ করেন।
এ সময় কমার্শিয়াল কাউন্সিলর আশফাকুল ইসলাম বলেন, ইউরোপিয়ান অর্থনৈতিক কমিশনের দেশগুলোর মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল থাকায় তারাই কিছুটা রাশিয়া থেকে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। এ ছাড়া বাকি সব দেশকেই রাশিয়ায় পণ্য রপ্তানিতে নির্ধারিত শুল্ক দিতে হয়। রাশিয়ায় বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বিকাশ না হওয়ার প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে উঠতে ইউরোশিয়া অর্থনৈতিক ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশ যোগ দিতে পারে বলে তিনি মনে করছেন। তিনি আরও বলেন, রাশিয়ায় তৈরি পোশাকের বাজার ধরতে এবং সেই সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণে অনেক দিন ধরে ফাইলে আটকে থাকা ‘যৌথ কমিশন’ গঠনের চুক্তির দ্রুত স্বাক্ষর হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের ঢাকায় অথবা মস্কোতে বিজনেস টু বিজনেস (বিটুবি) পদ্ধতিতে বৈঠক আয়োজনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন কমার্শিয়াল কাউন্সিলর।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালে রাশিয়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্যপদ লাভ করায় বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের বাড়তি কিছু সুবিধা আদায়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সাম্প্রতিককালে ইউক্রেন ইস্যুর কারণে দেশটিতে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে অনেক ইউরোপিয়ান ব্র্যান্ড রাশিয়া থেকে চলে গেছে। তাই এখন এশিয়ামুখী হচ্ছে রাশিয়ার আমদানিকারকেরা। তা ছাড়া সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত পাঁচটি দেশ নিয়ে ইইউর আদলে গড়া ইউরোশিয়া অর্থনৈতিক ইউনিয়নের কার্যক্রম চলতি বছর থেকে চালু হওয়ায় বিশাল এক বাজার সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে রাশিয়াসহ ইউরোশিয়া জোটভুক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির দারুণ এক সুযোগ সৃষ্ট হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।