সচেতনতা ও আইনের শাসন

ব্রিসবেন শহর
ব্রিসবেন শহর

প্রথম ব্রিসবেন এসেই যে বাসাটায় উঠেছিলাম সেটা একটা কাঠের ডুপ্লেক্স বাসা। এখানে প্রায় সব বাসাগুলো ডুপ্লেক্স আর কাঠ দিয়ে নির্মিত। আমি যে বাসাটায় উঠেছিলাম সেই বাসাটার মালিক ছিলেন মার্গারেট নামের এক বৃদ্ধা নারী। এখানের রীতি অনুসারে তাকে আমরা মার্গারেট নামেই ডাকতাম। নাম ধরে ডাকলেই তারা স্বস্তিবোধ করেন!
ব্রিসবেনে পৌঁছার আগেই মার্গারেটের সঙ্গে আমার চিঠি চালাচালি হয়। তাই এসেই সরাসরি একটা গোছানো রুমে উঠে পড়ি। মার্গারেটের সাদা রঙের বাসাটা বেশ পুরোনো, শুনেছি এক শ বছরের মতো হবে। প্রথম দর্শনে বাসাটা দেখে একটু অবাকই হই। ভয়ও কি করেছিল? যত দুর মনে পড়ে, একটু একটু করেছিল, তবে অবাক হয়েছিলাম খুব বেশি।
অস্ট্রেলিয়ায় আমার প্রথম রাতটা কাটাবার পর খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার। এমন সময় খেয়াল করলাম, আমার রুমের দরজায় কোনো লক নেই। ছোট্ট একটা ছিটকিনি মতো আছে, কিন্তু কোনো তালা লাগিয়ে বন্ধ করার ব্যবস্থা নেই। তাই বিষয়টা নিয়ে বিপদেই পড়ে গেলাম। কেননা বাংলাদেশ থেকে আমি তিনটা বড় বড় সুটকেস ভরে সুই-সুতা থেকে শুরু করে যা যা দরকার কিনে নিয়ে এসেছি! ভাবছি, এ ভাবেই কী রেখে যাব? চোরের তো গোছানোও লাগবে না, সবকিছুই গোছানো আছে, জাস্ট নিয়ে যেতে হবে। এ অবস্থায় কী করব বুঝতে পারছিলাম না।
মার্গারেটের এই বাসায় অভিক নামের এক বাংলাদেশি থাকেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়েন। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বিষয়টা আমি অভিকের সঙ্গে শেয়ার করলাম।

অভিককে জিজ্ঞাসা করলাম, কি করা যায়।
শুনে নির্লিপ্ত ভাবে বললেন, এভাবেই রেখে দিন, চাইলে দরজাটা খুলেও রাখতে পারেন, কেউ কিচ্ছু নেবে না।
এই বলে তিনি বাসার সদর দরজাটাও খুলে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা দিলেন।
আমি কী করা উচিত না বুঝেই অনেকটা মোহাচ্ছন্ন ভঙ্গিতে সবকিছু ও ভাবে রেখে তার সঙ্গে চলে গেলাম। কিন্তু মনটা খচখচ করছিল, ল্যাপটপটা রেখে এসেছি, রেখে এসেছি আমার গবেষণা সংক্রান্ত হার্ডডিস্কগুলো। ভাবছিলাম, আমার তো সবই ওগুলোতে! অস্বস্তি নিয়ে তাই সময়টা কাটতে থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিন ছিল ব্যস্ততাময়। বেশ কিছু অফিশিয়াল কাজ করতে হয়। কিন্তু এত ব্যস্ততার মাঝেও বাসার দরজা খুলে রেখে আসার বিষয়টা আমার বাংলাদেশে জীবন অভিজ্ঞতার আলোকে মস্তিষ্ক মেনে নিতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি গিয়ে দেখব সব চুরি হয়ে গেছে।
দুরুদুরু বুকে প্রথম দিনের কাজ শেষে বিকেলে ফিরে আসি। ফিরে এসে অবাক হয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ি। নাহ, সবকিছু তাদের জায়গা মতোই আছে।
সন্ধ্যার একটু আগে মার্গারেট দেখা করতে আসেন। পরিচিত হওয়ার পর তাকে জানালাম যে, গত রাতে আমার শীত লেগেছিল।
শুনে তিনি আমাকে একটা ব্লানকেট এনে দিলেন।

ব্রিসবেন শহরে উৎ​সবের দিন আতশবাজির দৃশ্য
ব্রিসবেন শহরে উৎ​সবের দিন আতশবাজির দৃশ্য

এরপর বললাম, বাসায় তো তালাচাবি নেই, আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে। কি করা যায়...। আমার কথা শুনে মার্গারেট আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তারপর তাকে বুঝিয়ে বললাম, সিকিউরিটি তো একটা বিষয়। কিন্তু তিনি বুঝলেন যে, বাংলাদেশ থেকে আসা এই নতুন ছেলেটি আস্থাহীনতায় ভুগছে, তার সিকিউরিটি দরকার।
এরপর তিনি যেটা করলেন, তাতে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম। এটা মনে রাখার মতো একটা বিষয়ও বটে। আমার কথার পর মার্গারেট কোথা থেকে যেন একটা মিনিয়েচার সাইজের তালা আনলেন আমার জন্য। খুব ছোট তালা যা সাধারণত লাগেজ বা হ্যান্ড ব্যাগের সিকিউরিটিতে ব্যবহৃত হয়। এনে আমাকে দিয়ে বললেন, এই যে তোমার সিকিউরিটি।
ছোট সময় অনেক গল্প শুনতাম, বিশেষ করে পরিবারের বড়দের কাছ থেকে। কিছু গল্প ইসলামিক বই গুলোতেও পড়েছি। গল্পগুলো অনেকটা ‘মিথ’ হিসেবেই আমাদের বলা হতো। মিথ বলছি এ জন্য যে ওগুলো আমাদের শোনানো হতো, কেননা ঘটনাগুলো আগে ঘটেছিল, এখন ঘটে না, আর এখন সম্ভবও না। এমনই একটা গল্প ছিল কোনো এক খলিফার আমলের। খলিফার রাজ্যের কোনো একটা জায়গায় খুব বেশি চুরি হতো। সেই চুরি কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছিল না। তাই বন্ধ করতে একজন শক্ত গভর্নর নিয়োগ দেন খলিফা। সেই গভর্নর এসেই একটা নতুন আইন প্রণয়ন করেন এবং রাত ১২টার পর নগরীতে বের হওয়ার ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। যে বাইরে বের হবে তার হাত কেটে দেওয়া হবে বা তাকে হত্যা করা হবে। এই আইনের জন্য প্রথম কয়েক দিন বেশ কয়েকজন মারা পড়ল। এরপর ধীরে ধীরে শহরে চুরি কমে আসল। চুরি যখন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তখনো কঠোরভাবেই আইনটা বলবৎ থাকল। এতটাই কঠিন ছিল আইনের প্রয়োগ যে, একদিন কোনো এক বৃদ্ধা তার মেয়ের অসুস্থতার কারণে বাধ্য হয়েই রাতে বাসা থেকে বের হন। কিন্তু তাকেও বের হওয়ার জন্য হত্যা করা হয়। এত কঠোরতার পরই চুরি বন্ধ হয়। আর বিষয়টা এমন পর্যায়ে দাঁড়ায় যে, এরপর থেকে নগরীর সবাই রাতে বাসার দরজা খুলে ঘুমাত, কিন্তু কিছুই চুরি হতো না।
যখন ছোট ছিলাম তখন এই গল্পগুলো শুনতাম আর আনন্দ পেতাম। অবাকও হতাম। তবে একই সঙ্গে সূক্ষ্মভাবে হয়তো একটা ধারণা আমাদের মধ্যে বদ্ধমূল হতো, হয়েছে, এত কঠিন হওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দরজা খুলে ঘুমানোর মতো পরিবেশ আমাদের আসবে না। যখন হয়েছিল তখন ছিল খলিফাদের আমল, কিছু মহামানুষ যাদের আমরা ফলো করি তারা পেরেছিল। আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় (আক্ষরিক অর্থে আমরা তা পারছিও না)।
কিন্তু এই হাজার হাজার মাইল দূরে যেখানে হয়তো কোনো খলিফা কখনো আসেননি, সেই অর্থ ধর্মের প্রভাবও নেই কিন্তু মানুষ এখানে ঠিক সেই মিথিক্যাল জীবন যাপন করে। আমরা একজন খলিফার জন্য অপেক্ষা করি, আর এরা সবাই যেন সেই খলিফার প্রতিরূপ।

দুই.

বিড়াল। প্রতীকী ছবি
বিড়াল। প্রতীকী ছবি

মার্গারেটের বাসার সামনে একটা বিড়াল থাকে। সামনে বলছি এই কারণে যে, বিড়ালটা ভুলেও কখনো বাসায় ঢোকে না। বাসার চারপাশ দিয়েই ঘুরঘুর করে। কেউ বাসায় এলে বিড়ালটি তার সঙ্গে বাইরের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে ঠিক দরজার সামনে এসে থেমে যায়। সেখানে বসে থাকে কিন্তু দরজার ভেতর দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢোকে না। প্রথমে বিড়ালটির সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো এভাবে। ও একটা Wild Cat. আমি বিশ্বাস করিনি। কেননা Wild Cat বলতে আমি যা বুঝি, বিড়ালটি মোটেও তেমনটা নয়। পরবর্তীতে আমি সবার সঙ্গে কথা বলে যেটা বুঝলাম, এটা সম্ভবত কোনো এক সময় Pet ছিল কিন্তু সে তার মনিবকে হারিয়ে Wild হয়ে গেছে। মানে এখন তার কোনো মনিব নেই। বিড়ালটা দেখতে সুন্দর হলেও লক্ষ্য করলাম কেউই এই বিড়ালটাকে পছন্দ করে না। মার্গারেট তো বারণই করে দিয়েছেন ওই বিড়ালটাকে কিচ্ছু খেতে দেওয়া যাবে না।
আমি যখনই অফিস থেকে বাসায় ফিরি বিড়ালটি আমার পায়ে-পায়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে আসে কিন্তু দরজা ক্রস করে ভেতরে ঢোকে না। আমি ঢুকে যাই কিন্তু ও দাঁড়িয়ে থাকে। এটা নিঃসন্দেহে একটা ট্রেনিংয়ের ফলাফল। কোনো এক সময়, হয়তো বা অনেক আগে তাকে তার মনিব শিখিয়েছিল, তা সে ভোলেনি! এত দিন পর সে তার মনিবকে হারিয়ে দিগ্ভ্রান্ত, খেতে পায় না (খেতে না পেয়ে একদিন নাকি মারাও যাচ্ছিল প্রায়), তারপরও সে তার শিখিয়ে দেওয়া জীবন থেকে বেরিয়ে আসছে না। কিন্তু দরজাটা পেরোলেই ডাইনিং টেবিলে খাবার থাকে সব সময়, সারাটা দিন বাসায় কেউই তাকে না, চাইলেই সে ইচ্ছামতো খেতে পারে। কিন্তু সে ভুলেও কাজটা করে না।
বাংলাদেশে থাকতে আমার আদরের পোষা বিড়ালটাকেও তো দেখেছি আমার খাবার কেড়ে খেয়ে ফেলতে আর ফেলে রাখা খাবার তো সে খেয়েছেই। কিন্তু এই বিদেশ বিভূঁয়ে এসে এমন দৃশ্য দেখে শুধুই অবাকই নয়, ভাবিতও হয়েছি। কীভাবে সম্ভব?
সময় গড়িয়ে এখন বুঝতে পারি, এর নাম ট্রেনিং ও ডিসিপ্লিন। এ রকম একটা ডিসিপ্লিনড লাইফ এদের বিশ্বের মধ্যে শুধু ধনীই নয়, সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে পরিণত করেছে। বুঝতে পারছি, সুখের জন্য শুধুই ধর্ম বা বিশ্বাস নয় দরকার সচেতনতা ও আইনের শাসন।