আরবিট্রাজ

সাউথ ক্যারোলাইনা। রাতের দৃশ্য
সাউথ ক্যারোলাইনা। রাতের দৃশ্য

একসঙ্গে বেশ কিছু টাকা পেল আবির। পরপর দুবার গুনে দেখে সে। নাহ, ঠিকই আছে। ১ হাজার ২০ ডলার। কোনো ভুল নেই। মোট ১২০ ঘণ্টা কাজের টাকা। ৫১০ নগদ আর ৫১০ চেকের মাধ্যমে। চেকের কিছু টাকা অবশ্য ট্যাক্স হিসেবে কেটেছে। প্রতি ঘণ্টা সাড়ে আট ডলার হিসেবে এই তার পারিশ্রমিক। সাধারণত প্রতি দুই সপ্তাহ পরপর সে বেতন পায়। যার অর্ধেক নগদ, অর্ধেক চেকে। তবে এবার পেল তিন সপ্তাহ পর। তার অবশ্য একটা কারণও রয়েছে।
অনির্ধারিত প্রয়োজনে বাথরুমে গিয়ে টাকাগুলো আবার গুনে দেখে সে। মনে আছে, যখন টিউশনি করত তখনো ঠিক এভাবেই বাথরুমে গিয়ে টাকা গুনত। প্রতি মাসেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটত। টাকার অঙ্কের কোনো হেরফের হয় না যদিও, তবু সে তা করত। একটা আনন্দ কাজ করত মনে। নিজেকে কেমন জানি রাজা রাজা মনে হতো। ভাবত টিউশনি থেকে বেরিয়েই এক প্যাকেট বেনসন লাইটস কিনে রিকশা নেবে। হুড খুলে পায়ের ওপর পা দিয়ে বসবে। তারপর সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলবে, চল।
কই যাইবেন মামা?

চল, তোমার যেখানে যেতে ইচ্ছে হয়।
এইডা কী কোনো কথা হইল? যাওনের একটা ঠিকানা তো লাগব।
চল আপাতত টিএসসি। তারপর দেখা যাবে।
মনে পড়ে, তখন ঢাকার রিকশাওয়ালারা তেমন একটা গাঁইগুঁই করত না। ভাড়া আগে থেকে ঠিক না করলেও খুব একটা ভ্যাজর ভ্যাজর করত না। তেমন বিরক্ত না হয়ে রিকশা চালাত। মাঝে মাঝে টুকটাক কথা হতো।
তা তোমার নাম কি?
ফরিদ।
ঢাকায় কয়দিন?
এই হইল, চাইর বচ্ছর।
বাড়ি যাও? বাড়িতে কে কে আছে?
আছে বাবা-মা। যাই মাঝে মইধ্যে। ঈদে তো যাওয়া হয়ই।
বউ বাচ্চা আছে, নাকি ফ্রি? হা-হা-হা।
আছে। বাচ্চাও আছে একটা। দুই বচ্ছরের, মাইয়া।
সেদিন বন্ধুদের উদারভাবে খাওয়ায় সে। রিকশাওয়ালাকে দুই টাকা বেশি দেয়। একটা সিগারেটও দেয় বোনাস হিসেবে। বেতন পাওয়ার দিনগুলো মনের মাঝে কেমন একটা মিহি ভালো লাগা কাজ করে। বেতন নগদ টাকা হিসেবে হাতে পেতে বেশি ভালো লাগে। অঙ্কের দিক দিয়ে তা যতই কম হোক না কেন। দেশে যখন সে চাকরি করত বেতন সরাসরি অ্যাকাউন্টে চলে যেতো। সে শুধু এক ফাঁকে হিসাবটা দেখে নিত। তাতে তেমন স্ফূর্তি থাকত না। সে বিচারে আজও তার ভালো লাগার কথা। বলতে গেলে এখানে এসে এতগুলো টাকা একসঙ্গে আগে কখনো পায়নি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, তার তেমন ভালো লাগছে না।
গত কয়েক মাস সে একজন পাকিস্তানির দোকানে কাজ করছে। লোকটির নাম রন। আসল নাম রমিজ রায়হান। এখানে রন নামে পরিচিত। ওরই মোবাইল এক্সসরিসের একটা কিওস্ক। প্রায় সারা দিন মলের মাঝখানে বসে থাকতে হয় তাকে। হঠাৎ হঠাৎ কোনো ক্রেতা আসে। দু-একটি জিনিস কেনাবেচা হয়, তারপর আবার নীরব হয়ে পড়ে চারপাশ। দেখলে মনে হবে, যেন কোনো কাজ নেই আবিরের। আসলে কিন্তু তা নয়। সে ভালোই ব্যস্ত থাকে। কিওস্কে মুঠো ফোনের সরঞ্জামাদি ছাড়াও আরও একটি বিশেষ কাজ করে ওরা। তা হলো, অনলাইনে কেনাবেচা। ই-বে ও আমাজনে বেশুমার ব্যবসা করছে তার চাকরিদাতা। বিষয়টি মজার।
খোলা বাজার থেকে পুরোনো কম্পিউটার, স্মার্ট ফোন, আইপ্যাড, ট্যাবলেট ইত্যাদি কিনে নেয় ওরা। তারপর সামান্য মেরামতের কাজ করে। এটার টেকনিক্যাল নাম রিফারবিশড। কিছু কিছু আবার একদমই রদ্দি মাল। কিন্তু সেগুলোও একেবারে ফেলনা নয়। সের দরে রন বেঁচে দেয়। তাতেও ভালো মার্কআপ থাকে। অরেঞ্জবার্গের আশপাশে বেশ কিছু কমিউনিটি কলেজ আছে। সেখানে সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন রকম ট্যাবলেট দেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য, এখানকার স্থানীয় শিক্ষার্থীরা যেন এর সুফল পায়। বাইরের বিশ্বের তথ্য প্রযুক্তির চলমান ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে যেন তাল মিলিয়ে চলতে পারে। আবির ভালো করে দেখেছে, আসলে সুফল পাচ্ছে রন। রনের চাতুর্যের একটা নমুনা মনে পড়ে আবিরের।

ক্যাপিটাল হিল, ওয়াশিংট​ন
ক্যাপিটাল হিল, ওয়াশিংট​ন

প্রত্যেকটি কমিউনিটি কলেজে সে কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করেছে। মাঝে মাঝে এটা সেটা সস্তা উপহার দেয়। হয়তো একটি মলিন মোবাইল কেস কিংবা ফ্রি জুয়েলারি ক্লিনিং। গয়না পরিষ্কারের একধরনের কেমিক্যাল আছে ওর। এখানে কিছুই মুফতে মেলে না। রন তা উশুল করে নেয় ঠিকই। ওদের মাধ্যমেই এক অভিনব অন্তর্জাল তৈরি করেছে সে। বেশির ভাগ ছাত্রগুলোই নেশা করে। কিন্তু নেশা করার টাকা পায় কোথায়? সবাই তো আর মাদকের ব্যবসা করে না। সম্প্রতি যে ট্যাবগুলো ওরা পেয়েছে তা আর ফেরত দিতে হবে না। ওটা ওদেরকেই দেওয়া হয়েছে। রন তাদের বলে, চাইলে ওরা তার কাছে বিক্রি করতে পারে। ভালো দাম দেবে সে।
আসতে থাকে নতুন নতুন ট্যাবলেট, সারফেস প্রো। প্রথমে হঠাৎ হঠাৎ, এরপর বেশুমার। কিছু কিছু তো প্যাকেটও খোলা হয়নি, এমন! নামমাত্র মূল্যে সে কিনে নিতে থাকে সেসব আধুনিক স্মার্ট ডিভাইস। ছেলেগুলো এমন হাঁদারাম, জিনিসগুলোর আসল দামই জানে না। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও এই অবস্থা! একদম বাংলাদেশের বেপথু যুব সমাজের মতোই। নগদ টাকা পেয়ে কোনো এক হাওয়ার হাতছানিতে ওরা হাপিস হয়ে যায়। আবার ফিরে আসে কিছুদিন পর। কিন্তু ওরটা তো আগেই বেঁচে দিয়েছে! এবার সঙ্গে করে নিয়ে আসে ওর বন্ধুদের। আনে আবার একজন একজন করে। রন আরও দাম কমিয়ে দেয়। কিছু পয়সা আগের জনকে দিয়ে দেয় কমিশন হিসেবে। রমরমা ব্যবসা।
আবির লক্ষ্য করেছে এই সফল বাণিজ্যের পেছনের কারণ আসলে একটাই। তা হলো, ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝের জ্ঞাত-অজ্ঞাত তথ্যের ফায়দা। এদের এক পক্ষ কিছু তথ্য জানে, অপরপক্ষ জানে না। ছেলেগুলো এই জিনিসগুলোর সঠিক দাম জানে না। আর তাই কাজে লাগাচ্ছে রন। অনেকটা আরবিট্রাজের মতোই ব্যাপারটা। হাসি পায় আবিরের।
এই ফাটকাবাজির মাঝে মুনাফা এতটাই যে দেখতে দেখতে তাদের কিওস্ক বোঝাই হয়ে যেতে থাকে বিভিন্ন দ্রব্যে। মল-ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করে রন। হয়তো কোনো একটি দোকান নেবার কথা ভাবছে সে। আবিরকে কিছু বলে না যদিও। একদিন সে তাকে বলে, এই কিওস্কের ব্যবসায় ইজ্জত কম।
কেন? ব্যবসা তো খারাপ হচ্ছে না।
আলহামদুলিল্লাহ তা ভালোই হচ্ছে। কিন্তু মলের মাঝখানে কিওস্কে বসে কারবার ভালো লাগে না। কেমন ফালতু মনে হয়।
অ্যামেরিকাতে তো আসলে আমরা টাকা উপার্জন করতেই এসেছি। তা সে যেখান থেকেই আসুক।
হুম, তা ঠিক। তবু একটা পারমানেন্ট দোকান থাকলে ভালো হয়।
এরপর রন আর কিছু বলে না। গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে যায়। নিশ্চয়ই দোকান নেবার কথাই ভাবছে। আবির বাইরের দিকে তাকায়। দেখে একটি ছেলে আসছে এদিকে। নেংচিয়ে নেংচিয়ে হাঁটছে সে। এমন না যে, পায়ে কোনো সমস্যা আছে। আসলে এই আফ্রিকান-আমেরিকান ছেলেগুলো প্যান্ট পরে বিচিত্র ভাবে। ঢলঢলে প্যান্টগুলো ওরা পরে পাছার নিচে। কিছুক্ষণ হাঁটলেই তা খসে পড়ে যেতে চায়। তখন হাত দিয়ে টেনে উঠিয়ে দেয়। তাও আবার কোমরের ওপর নয়, নিতম্বের স্ফীত অংশের ঠিক নিচ পর্যন্ত। এটাকে বলে স্যাগিং। ওদের দশা দেখে মনে হয় যেন ওদের পাছায় কিছু লেগে আছে। গ্রামের বাড়িতে খোলা মাঠে ছোট ছোট ছেলেদের বড় কাজ সারতে দেখেছে আবির। কাজ সেরে যেমন পানি খোঁজার জন্য হাঁটত ছেলেগুলো-ওরকমই যেন। আবিরের হাসি পায়। সে দেখে ছেলেটির হাতে একটি প্যাকেট। না দেখেও দূর থেকে বলে দেওয়া যায় ওটি একটি অত্যাধুনিক সারফেস প্রো।
একদিন রন তাকে বলে, আবির ভাই, আমি এইবার হজে যাব ভেবেছি।
বাহ, সে তো দারুণ কথা। তুমি ভাগ্যবান, রন।
তা ঠিক, আমি আবার আমার মাকে সঙ্গে নিয়ে যাব। তুমি একটু দোকানটা কদিন দেখে রেখ।
নিশ্চয়ই। কিন্তু তুমি কবে যাবে ও আসবে? কারণ আমাকে আবার একটু ওয়াশিংটন যেতে হবে। আমার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ। ওটা রিনিউ করাতে হবে।
পাসপোর্ট রিনিউ করতে তোমার যাওয়ার দরকার কি? পাঠিয়ে দিলেই তো হয়। দিস ইজ আমেরিকা।
মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট করতে হবে আমাকে। তাই ওখানে গিয়েই ছবি তুলতে হবে আর বায়োমেট্রিক করাতে হবে।

রন আবার ডুবে যায় গভীর ভাবনায়।
দু-তিন দিন আগে রন ফিরেছে হজ থেকে। তার মাথার চুল কদমের মতো। পাকিস্তানিরা সুদর্শন আর লম্বা হয়, আবিরের তেমনটিই ধারণা ছিল। কিন্তু রন মোটেই তেমন নয়। বেশ বেঁটে আর পৃথুল। ছোট চুলে তাকে আরও কিম্ভূত লাগে। মক্কা থেকে আসার পর থেকে সারাক্ষণ ওর ঠোঁট নড়ে। মনে মনে হয়তো কোনো দোয়া আওড়ায়। সে গুনে গুনে টাকা শোধ করে আবিরের। বলে, কারও হক সবার আগে পরিশোধ করতে হয়। আল্লাহ পাক বলেছেন...।
রমিজ রায়হান, ওরফে রন, তার বয়ান চালিয়ে যায়। যার বেশির ভাগই হলো হজের নিয়ামত, তার ওপর আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি, সন্তানদের প্রতি কঠোর ধর্ম নির্দেশ...। বলতে বলতেই দাঁড়িয়ে যায়। আবির দেখে একটি ছেলে ঘষতে ঘষতে আসছে এদিকে। রন দাঁড়িয়ে যায়, হোয়াটস আপ, মাদার...।
মাকে নিয়ে খারাপ একটা কথা অনায়াসেই বেরিয়ে পড়ে রনের মুখ থেকে। আবির দেখে সে তার হাতের তসবি পকেটে ভরে রাখে।
হজে যাওয়ার আগে রন আবিরকে একটা আইফোন দিয়ে গিয়েছিল। যোগাযোগের সুবিধার জন্য। প্রতিদিন কী কেনাবেচা হলো, দোকানের ছবি, বিলের কপি ইত্যাদি সে পাঠাত তাকে। আর অনলাইনের ব্যবসা তো সে ইন্টারনেটের মাধ্যমেই দেখে নিয়েছে। মনের অনেক অতলে আবির ভেবেছিল রন বুঝি সে ফোনটি তাকে একেবারেই দিয়েছে। আর ফেরত নেবে না। অথচ, আজ সেটি ফেরত নিয়ে নিল। আর কাজ থেকে বেরোনোর আগে কিছু কাগজপত্র স্বাক্ষর করিয়ে নিল। জটিল কোনো কাগজ নয় যদিও। আজ পর্যন্ত কাজের কন্ট্রাক্ট। পুনরায় কাজে নেওয়া থেকে দায়মুক্তি। বলল, আবির ভাই, ফিরে এসো, তারপর আমরা নতুন করে কথা বলব। তুমি কাজগুলো বিয়ন্সেকে বুঝিয়ে দাও।
বিয়ন্সে হিস্পানিক কমবয়সী একটি মেয়ে। ঠিক পুরোপুরি হিস্পানিক নয়। ওর বাবা একজন সাদা আমেরিকান, মা হিস্পানিক। আসলে ওর নামও বিয়ন্সে নয়, বিয়েট্রিস। সুবিধার জন্য ওর নামও পাল্টে দিয়েছে। বিয়ন্সে নামের বিখ্যাত উর্বশী গায়িকার আবেদন তৈরি করার জন্যই কিনা, রন তা করেছে। বেশ সুন্দরী ওর নতুন সংযোজন। মেয়েটি বেশ ভালো স্প্যানিশ বলে। এখানে অনেক স্প্যানিশ-স্পিকিং ক্রেতা আসে যারা কিনা ইংরেজি একদমই বলতে পারে না। সরু স্লিভলেসের বাইরে বিয়েট্রিসে পরিষ্কার ফরসা হাতের দিকে কালো ছেলেগুলো অপলক তাকিয়ে থাকে। কিওস্কের চারপাশে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে।
ওকে কাজ বুঝিয়ে দিতে থাকে আবির। কাজ থেকে বাদ দেবার কথা স্পষ্ট করে না বললেও আবির নিশ্চিত, আজ থেকে তার কোনো কাজ নেই। (চলবে)