আরবিট্রাজ-দুই

খবরটা শুনে ভালো লাগে আবিরের।

ওয়াশিংটনে গেলে বশিরের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। সে এখন নিউইয়র্কে। প্রতি বছরেই আসে দু-একবার। আবিরের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ করে না। সেও করে না। কেমন আড়ষ্ট বোধ করে। বশির (সবার কাছে বাসির) ব্যস্ত মানুষ। এই কবছরে অনেক এগিয়ে গেছে সে। অফিসের কাজে এখানে এলেও আবির জানে সে নিজস্ব কিছু কাজও করে। হয়তো আরেকটু গুছিয়ে চাকরিও ছেড়ে দেবে। বারিধারায় সাড়ে তিন হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট কিনেছে সে। অনেক উঁচুতে, আকাশের কাছাকাছি। ধুলো থেকে মুক্তি মিলবে, এই আশায়। শুধু চাকরির টাকায় তা করা কঠিন, আবির বোঝে।

রাতের ওয়াশিংটন
রাতের ওয়াশিংটন

বশির ঠিক এই সময়ে আসছে আবিরের জানা ছিল না। আম্মা ফোন করে জানালেন, তোর সঙ্গে কি বশিরের দেখা হবে?
জানি না তো? সে আসছে নাকি?
হ্যাঁ, বলল নভেম্বরের ২২ তারিখ সে যাবে। কদিন থাকবে ওখানে। তুইও তো ওই সময় ওদিকেই যাবি। তোদের দেখা হবে?
জানি না। কথা বলে দেখব না হয়।
দেখা হলে ওর কাছে এক ডিবে ভেজলিন পাঠাস তো। শীতে আকিকের হাত পা ফেটে একেবারে চৌচির হয়ে যায়। আমি নিশাতকে বলেছি সে কথা।
আচ্ছা দেখি।
নিশাতকে জিজ্ঞেস করাতে সে বলল, আম্মা বললেন বিদেশ থেকে আসার পর থেকে আকিকের এই সমস্যাটা দেখা দিয়েছে। দেশের কোনো ক্রিমেই কাজ হয় না। আম্মা বললেন ওর জন্য কয়েকটি ভেজলিন কিনে পাঠাতে। বশির নাকি আসছে।
আবির তাকায় নিশাতের দিকে। ওর কাজটি যে আর থাকছে না সেটি ওকে বলে না। থাক না। আগে ফিরে আসুক ওয়াশিংটন থেকে। ওর চোখে ক্লান্তি খেলা করে। প্রবাসজীবন ওদের সবাইকে ক্লান্ত করে দিয়েছে। এত যে ক্লান্তি, তবুও কেন যে আমরা এই বিভুঁইয়ে পাড়ি জমাই? কীসের আশায়, কেন? সেই সোনার হরিণের পেছন পেছন ছুটতে ছুটতে অনেক বেলা চলে যায়। কোনো এক অপরাহ্ণে মনে হয়, আসলে অঙ্কের ফলাফল অভিন্নই। সেই যে একই অঙ্ক বিভিন্ন নিয়মে করার মতোই বিষয়টি। ফলাফল কী সব সময় মেলে, কে জানে?
বশিরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সে জানায়, দেখা করার চেষ্টা করবে সে। কিন্তু কথা দিতে পারছে না। মেলা ব্যস্ততা।
তবুও নিশাত কয়েক কৌটা ভেজলিন কিনে ফেলে। যদি দেখা হয়ে যায় তবে দিয়ে দেবে সে। এমন না যে, দেশে এ জিনিস পাওয়া যায় না, নিশ্চয়ই যায়। তবু সে কথা শাশুড়িকে বলতে নিশাতের মন চায় না। শেষে না আবার কী ভেবে বসে থাকেন উনি।
আকিক গ্রিসে গিয়েছিল পড়তে। পড়াশোনা না ছাই, কিছুই করেনি। কদিন পরই হয়ে পড়ে আউট অব স্ট্যাটাস। এদিকে ইউরো-ক্রাইসিসের জন্য পুরো দেশই দেউলিয়া হওয়ার জোগাড়। প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ হয়ে পড়ে কর্মহীন। আরও কয়েকটি দেশেও এমন মুদ্রা সংকট দেখা দিলেও গ্রিসের অবস্থা সবচেয়ে বেগতিক। তরুণ সমাজ এদিক-ওদিক পালাচ্ছে। আকিকও এর মাঝে পড়ে যায়। কোনো উপায় না দেখে সে দেশে ফিরে আসে। তাও তো ফেলে যাওয়া একটা দেশ রয়েছে ওর। ফেরার সময় সঙ্গে নিয়ে আসে ডায়াবেটিস, গাউটের মতো রোগ। এখন যুক্ত হয়েছে হাত-পা ফাটার আলামত।
নিউইয়র্ক থেকে নাদের ফোন করে, আবির ভাই, তুমি নাকি এদিকে আসছ?
তুমি জানলে কি করে?

লিঙ্কন মেমোরিয়াল
লিঙ্কন মেমোরিয়াল

বশির ভাই ফোন করেছিল। সেও তো এখানে এখন। বলল আমি যেন তাকে নিয়ে ওয়াশিংটনে যাই। সে তো এখানকার সবকিছু ঠিক চেনে না। তাই আমাকে বলল। ভালোই হবে, কি বলো? অনেক দিন পর দেখা হবে।
তোমার সঙ্গে বুঝি বশিরের ভালো যোগাযোগ আছে?
আরে না। গত আট বছরে একবারও যোগাযোগ হয়নি। এবার দেশে গিয়ে আমার ফোন নম্বর দিয়ে এসেছি। ভালোই করেছিলাম। তাই তো সে ফোন করল। দেশ থেকে এসে কেউ খোঁজ করলে কী যে ভালো লাগে। বশির ভাই তো এখন বিগশট, হা-হা-হা।
রায়ের বাজার থাকার সময় নাদের ওদের এলাকার ছোট ভাই ছিল। দশ বছর আগে টুরিস্ট ভিসায় এসে আর ফেরেনি। ট্যাক্সি ড্রাইভার হয়ে গেছে। ডিভিপ্রাপ্ত একজনকে বিয়ে করে এখন সবকিছু ঠিকঠাক। মাঝে মাঝে ফোন করে ওদের খবরাখবর নেয়। বলে, টাকাপয়সা লাগলে জানিও আবির ভাই। লজ্জা করো না। প্রথম প্রথম আসলে দরকার পড়ে, আমি জানি।
সরল সহজ ছেলেটির কথা শুনে ভালো লাগে। ডিসিতে আসতে হলে বশিরের বেশ ঝক্কি পোহাতে হতো। খরচও হয়ে যেতে পারে বেশ কিছু। হয়তো সে কারণেই নাদেরের সঙ্গে বশির যোগাযোগ করেছে, আবির বোঝে।
আলো ফোটার আগেই ওরা রওনা দেয়। বাচ্চাদের না জাগিয়েই প্রায় কোলে করে গাড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। গাড়ির পেছনে বসে ওরা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ছোট্ট তটিনী আবার নাকও ডাকছে। নিশাত আর আবির পাল্টাপাল্টি গাড়ি চালিয়ে আজই পৌঁছে যাবে ডিসিতে। থ্যাংকস গিভিং বন্ধের আগেই পাসপোর্টের কাজটি করে নিতে চায়। পথে কোথাও নাইট-হল্ট করবে না। শুধু শুধু হোটেলে পয়সা দেবার কী দরকার। তার চেয়ে বরং ওখানেই দুই দিন থেকে ক্যাপিটাল হল, কিছু মিউজিয়াম দেখে আসবে। কিছু মিউজিয়ামে ঢুকতে পয়সা লাগে না, আবার কোনো কোনোটিতে লাগে। লিঙ্কন মেমোরিয়াল, স্মিত-সোনিয়ান ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামে নিশাত বাচ্চাদের নিয়ে যাবে। আবির একা যাবে ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্টে। ভাগাভাগি করেই দেখতে হচ্ছে এবার। অনেকটা রথ দেখা কলা বেচার মতোই। অন্ধকার থাকার সময় আবির চালিয়েছে দুই ঘণ্টা। নর্থ ক্যারোলাইনার পুরোটাই নিশাত চালিয়ে ভার্জিনিয়ার আগেই আবার আবিরকে স্টিয়ারিং দিয়ে দেবে। এমনই পরিকল্পনা। গাড়ি চালাতে চালাতে যেন ঘুমিয়ে না পড়ে তাই ওরা দুজন কথা বলে। সেসব গল্পে ফিরে ফিরে আসে পুরোনো কথা। ফিরে ফিরে আসে কী করে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বশির মনবৈকল্যে ডুবে গিয়েছিল। কিছুদিন পর চাকরি খুয়ে বসে। বন্ধুদের কাছে টাকাপয়সা ধার করে আর ফেরত দিত না। একে একে সব বন্ধুদের হারিয়ে বসে। কেউই ঠিক ওর ওপর ভরসা করতে পারত না। একমাত্র আবির আর নাদের ছিল ওর পাশে। মাঝে মাঝেই বশিরকে নিয়ে নিশাতের অফিসে চলে আসত আবির। নিশাত বশিরের সরাসরি বন্ধু নয়। আবিরের সুবাদেই পরিচয়। মাঝে মাঝে বিরক্ত হতো খুব। ওদের ব্যক্তিগত সময়ে বাইরের একজন থাকবে কেন? মাঝে মাঝে বলেও বসত, ওকে নিয়ে আসো কেন তুমি?
আবির হাসত, আসুক না, কী হয়? আসলে আমাদের সঙ্গে ভালো মন্দ খেল কিছু। ওর চাকরিটা আবার গেছে।
সে তুমি ওকে আলাদা নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দিলেই পার। এখানে আনার দরকার কী? কদিন পরই আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান। কত কিছু আছে কথা বলার। মাঝে উটকো কেউ থাকলে অসুবিধা হয় না বুঝি?
সে সব কথা বিয়ের পরও তো শোনা যাবে, হা-হা-হা।
তোমার মাথা, আমি কী প্রেমের কথা বলব নাকি? আমি বলব কাজের কথা, যাও ভাল্লাগে না।
সেই বশিরই এখন কেমন সফল হয়ে উঠেছে। গাড়ি চালাতে চালতে নিশাত ভাবে। আবির অবশ্য বলেছে, বশিরের কাছে ভেজলিন পাঠাতে আমার ভালো লাগছে না, নিশাত।
কেন, অসুবিধা কি? সে কি তোমার বন্ধু না?
নাহ, কোনো অসুবিধা নেই। স্রেফ মন চাইছে না।
আসলে ওর সঙ্গে দেখা করতেই তেমন ইচ্ছে করছে না আবিরের। কিন্তু নিশাত এক রকম জোর করেই দেখা করতে চাইছে। দেশ থেকে কেউ একজন এলেই কেমন যেন একটা অনুভূতি কাজ করে। আর তা যদি হয় নিকট বন্ধু, তবে তো কথাই নেই। সে ভেবেছে বশিরকে দেখে হয়তো আবিরের ভালোই লাগবে।
কথা ছিল ওরা এসে ওদের হোটেলে দেখা করবে। কিন্তু পৌঁছার আধা ঘণ্টা আগে জানাল যেন ক্যাপিটাল হলের কাছাকাছি একটা জায়গায় এসে দেখা করে তারা। এদিকে আকাশ মেঘলা হয়ে আসে। চট করে গাড়ি কোথাও ঠিক পার্কও করা মুশকিল। কোথাও থেমে যে জিপিএস রিসেট করবে সে সুযোগ পায় না সে। গাড়ি চালাতে চালাতেই আনাড়ি হাতে জিপিএসে জায়গা ঠিক করে দেয় আবির। এই সময় প্রকৃতি তাদের সঙ্গে একটা বিরূপ রসিকতা করে বসে। আর আবির ওয়াশিংটন ডিসির জায়গায় বসিয়ে দেয় সিয়াটল, ওয়াশিংটন। প্রত্যাশিত সময় দেখাচ্ছিল ৩০.১৮। আবির বুঝতে ভুল করেছিল। ওটি আসলে মিনিটের হিসাব ছিল না, ছিল ঘণ্টার।
ওরা পথ হারিয়ে ফেলে।
সেই তিরিশ মিনিট আর শেষ হয় না কিছুতেই।
বরং একের পর এক নতুন হাই রোডে মার্জ হতে থাকে ওদের গাড়ি। শীতের সন্ধ্যা চট করে নেমে আসে। নাদের ও বশির ফোন করতে থাকে একটু পরপর। আশে পাশে কোনো একজিটও নেওয়া যাচ্ছিল না। বলা যায় ওটাই তাদের পরিবারের প্রথম এত লম্বা ভ্রমণ। এর আগে দু-তিন শ মাইল চালিয়েছে। কিন্তু এত লম্বা সফর, এই প্রথম। ওরা ঘাবড়ে যায় বেশ। অনেক কষ্টে একটি একজিট নেবার পর বুঝতে পারে কোনো একটি পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আবির গাড়ি চালাচ্ছে। কোনো একটি লোকালয়ের জন্য হন্যে হয়ে সে গাড়ি চালায়। কিন্তু সে আশ্রয়ের খোঁজ মেলে না সহজে। তটিনী বাথরুমে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। অস্থিরতা ওদের সবাইকেই পেয়ে বসে। এ সময় কী করতে হয়, ঠিক জানাও নেই। নাইন ওয়ান ওয়ানে ফোন করবে? ফোন করে কী বলবে? ওরা হারিয়ে গেছে? কিন্তু কোথায় হারিয়েছে? ওরা তো ঠিকমতো জায়গার নামও জানে না। কোনো বিষয়ে পুলিশ কিংবা জরুরি ব্যবস্থায় খবর দিতে কোথায় যেন শঙ্কা কাজ করে। পুলিশ জানলে আঠারো ঘা, দেশের সে ধারণা এখনো মূলে বিদ্যমান। কী বিপদ!
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি জঙ্গল। অথচ উল্টো দিকের গাড়িগুলো আসছে হুস হুস করে। ওদের গতি কিন্তু কম নয় মোটেই। হেডলাইটের তীব্র আলো চোখে পড়লে যন্ত্রণা হয়। আবার এলিভেশনের জন্য কখনো গতি যায় হঠাৎ করে বেড়ে। ব্রেক দিয়ে থামাতেও অনেক ঝক্কি। পাগলের মতো একটা লোকালয় খুঁজতে থাকে সে। খুঁজে পায় না।

২.
আবিরকে গাড়ি পার্ক করতে দেখে বশিরের প্রথম কথা, আমেরিকায় এসে মানুষ প্রথম শেখে গাড়ি চালানো। তুই তো দেখি সেটাই শিখিসনি। চলবে কেমন করে এখানে তোর? এই সামান্য পথ আসতেই রাস্তা হারিয়ে ভূত হয়ে গেলি। বলদ আর কাকে বলে।
অন্যসময় হলে আবির হয়তো কথাটাকে নিতান্তই বন্ধুসুলভ রসিকতা হিসেবে নিত। কিন্তু আজ পারেনি। গাড়ি চালিয়ে সে প্রচণ্ড ক্লান্ত। নদী-তটিনী অস্থির হয়ে গেছে রেস্ট রুমে যাওয়ার জন্য। নিশাত ভয়ে অস্থির।
মেরিল্যান্ডের একটা রেস্টুরেন্টে ওদেরকে আসতে বলেছে। নাদেরই বলেছে এদিকে আসতে। আবিরের শেষ অবস্থান থেকে কাছাকাছিই হবে। এই রেস্টুরেন্টের খাওয়ার রেটিংও নাকি বেশ ভালো। খরচ একটু যদিও বেশি। কিন্তু নাদেরকে বশির আশ্বস্ত করেছে, ওটা কোনো ব্যাপার না।
বেশ অনেক রাত হয়ে গেছে তাই তেমন ভিড় ছিল না পার্কিং লটে। আবার এদিকটা খানিক অন্ধকারও। আবির কোনো মতে পার্ক করে গাড়িটা। পেছনের একটি চাকা সাদা দাগের ওপর উঠে যায়। সেদিকে তাকিয়ে বশির বলে, পার্কিংটাও ঠিকমতো শিখলি না। তোর এখানে চলবে কি করে?
আবির বোঝে এ আর ইয়ার দোস্তির মশকরা নয়, অন্য কিছু। কিন্তু কি সেটা? কেনই বা সেটা?
খাবার আসতে খানিক দেরি হচ্ছে। বশিরই দিয়েছে সে অর্ডার। সিচুয়ান খাবার ফরমায়েশে সে নাকি আবার নিপুণ। নিজেই বলছে সে কথা। আবির তেমন কিছু বলছে না, কিছু আগের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার ভাবনায় নিমগ্ন।
অনেকক্ষণ হন্যে হয়ে ঘোরার পর একটা স্টপ সাইন দেখে যেন আত্মায় পানি এসেছিল আবিরের। একটা ফাঁকা জায়গাও পেয়ে যায়। ওখানেই গাড়ি থামিয়ে জিপিএসটাতে আবার ঠিকানা দিতে গিয়ে নিশ্চিত হয় গন্ডগোলটা। নাদেরের সঙ্গে কথা বলে ওরা। জানায় ক্যাপিটাল হলের সামনে দেখা করাটা এখন অসম্ভব। মাঝামাঝি কোনো একটা জায়গায় দেখা করলেই ভালো হয়। শেষে মেরিল্যান্ডের এই জায়গায় দেখা করতে বলল।
খাবারের বিল যখন এল, স্বাভাবিক ভাবেই আবির সেটা আড়াল করে নেয়। এটি তার পুরোনো অভ্যাস। কখনোই অন্য কাউকে বিল দিতে দেয়নি। বিলের অঙ্কটা অবশ্য আঁতকে ওঠার মতোই। নিশাতকে আপাতত জানায় না। বিল সে আগেও কখনো বশিরকে দিতে দেয়নি। এখন তো প্রশ্নই ওঠে না। নিকট ভবিষ্যতে তার চাকরি থাকুক আর নাই থাকুক এখন তো পকেটে টাকা আছে।
তেমন বিশেষ কিছু কথা হয়নি ওদের। বশিরই বলছে। মাঝে মাঝে নাদের বলছে। আবির-নিশাত শুনেছে বশিরের কথা। আগামী বছর নিজেই একটি ফ্যাক্টরি দিচ্ছে সে। এখন যদিও একটি এক্সেসরিজ ও এমব্রয়ডারির পার্টনার শিপ আছে। তবে নিজের মূল ব্যবসার কাগজপত্রের কাজ শেষ। এবার এখানে অফিসের কাজ শেষ করে কিছু ক্রেতার সঙ্গে কথা বলেছে। ওরা তাকে আশ্বস্ত করেছে। মোট কথা প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই ছিল তার কৃতিত্ব গাথা। আবিরের বিরক্ত লাগে। মনে মনে ভাবে কখন গিয়ে হোটেলে একটু গা এলাবে।
ডিনারের পর যখন গাড়ির দিকে যাচ্ছে, আবির দেখে ওর ওভারকোটের ওপর চাঁদের বুড়ির সুতোর মতো কী যেন পড়ছে। সে বিরক্ত হয়ে হাত দিয়ে সরিয়ে দেয়। কিন্তু কত আর সরাবে। হুড়মুড় করে ক্রমাগত পড়ছে। এবারে আর মোটেই সাদা সুতোর দলা নয়। পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো। অবাক হয়ে আবির আকাশের দিকে তাকায়। বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে শ্লথ সাদা স্রোতের রেখা। খসে যাওয়া পালকের মতো হালকা, গোলাকার, ফাঁপা-নরম। নিশাত ফিসফিস করে বলে, ইটস স্নোইং। আমাদের জীবনের প্রথম তুষার দেখা।
আবির অস্ফুট গলায় বলে, কী অপূর্ব দৃশ্য।
সাউথ ক্যারোলাইনার আবহাওয়া অনেকটা বাংলাদেশের মতোই। খুব একটা তুষারপাত হয় না। আবির-নিশাতের মধ্যে বিমুগ্ধতা কাজ করে। খানিক আগের যন্ত্রণার কথা ওরা ভুলে যায়। কিন্তু সে গ্লানির কথা মনে করিয়ে দেয় বশির। এটা কোনো তুষারপাত হলো নাকি, হেহ। তুষারপাত দেখেছি স্টকহোমে। হোয়াট অ্যান এক্সপেরিয়েন্স। সেই তুলনায় এইটা তো ফালতু। আমেরিকানরা ওদের হাবিজাবি অনেক কিছু নিয়ে এত গর্ব করে। অথচ ফালতু সব জিনিস। এই নেশনটা টিকেই আছে কেবল ফাঁপা গর্বের ওপর ভর করে।
মুহূর্তে আবিরের মনে হয় ওর হোটেলে ফেরা দরকার। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। ভেজলিনের কৌটাটা ওর হাতে দিতেও লজ্জা লাগছিল। বশির বলল, কান্ট প্রমিস বাডি। দেখি জায়গা থাকলে নিয়ে যাবানে। অনেক স্যাম্পল নিতে হচ্ছে এবার।
এরই ফাঁকে নিশাত নাদেরকে একটু আড়ালে নিয়ে বলে, আমরা আসলে বড্ড তাড়াহুড়োয় ছিলাম। বশিরের জন্য কোনো কিছু কিনতে পারিনি। তুমি কি একটু কাল কোনো দোকানে গিয়ে ওর আর ওর বউয়ের জন্য কিছু একটা কিনে দেবে? আমি তোমাকে পরে চেক পাঠিয়ে দেব।
আপনি কিছু ভাববেন না ভাবি। নট এ প্রবলেম। আমার ট্যাক্সি তো রয়েছেই। আপনার আর আবির ভাইয়ের জন্য এটুকু করতে পারব না? আমার ব্যাংক সলভেন্সিটা আবির ভাই কীভাবে বের করে দিয়েছিল মনে আছে? সেটা আমি মরে গেলেও ভুলব না। প্রায়ই আমার বউকে সে কথাটা বলি।
ওসব কথা থাক, নাদের। তোমরা ভালো আছ এতেই শান্তি।
নিশাত ভুলেই গিয়েছিল যে আবির একসময় একটি লিজিং কোম্পানিতে বড় কোনো পদে কাজ করত। আট দশ বছর আগে তো সবকিছু অত ইলেকট্রনিক ছিল না ব্যাংকিং জগতে, তার কিছু বন্ধুও ছিল। ম্যানুয়েল স্টেটমেন্টটা মেনুপুলেট করে নাদেরকে সাহায্য করতে পেরেছিল আবির। ওর পুরো কাগজপত্রও আবির সাজিয়ে দিয়েছিল। সে কথা নাদের ভোলেনি। এখানে আসার পর নাদেরই একমাত্র মানুষ যে কিনা প্রায়ই ফোন করে খোঁজ খবর নেয়। প্রায়ই বলে, তোমরা এখানে চলে আস। কাজের অভাব নেই। কিন্তু আবির রাজি হয় না। ঠান্ডায় ওর বেজায় ভীতি।
হাইওয়ে তে গাড়ি চলছে। ওরা হোটেলে ফিরছে। বাইরে তুষার ঝরছে। আবির হেডলাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেটাই নিয়ম। সে আলোতে পল্কা বরফের মিছিল দেখা যায়। যেন কমলা-সোনালি রঙের প্রজাপতির ঝাঁক। কেমন আলতো করে গাড়ির সামনের কাচে এসে আছড়ে পড়ে। আবার পরক্ষণেই মিলিয়ে যায়। অভিভূত হওয়ার মতোই দৃশ্য। কিন্তু আবিরের মনে হতে থাকে, কী কুৎসিত, কী কুৎসিত।
বাচ্চারা ঘুমোচ্ছে। টেবিল ল্যাম্পের মোলায়েম আলো ওদের গালে পড়েছে। সারা দিনের উদ্বেগ চোখে পড়ে না। থ্যাংকস গিভিংয়ের এই সময়টাতে সবাই পরিবারের কাছে ফিরে যায়। হোটেলগুলো ফাঁকা থাকে। বেশ ভালো ডিল দেয় তখন। হলিডে ইনের এই কামরাটি নিশাত অনলাইনে অনেক ঘেঁটে খুঁজে বের করেছে। কিং সাইজের বিছানার ঘরটি তাই বেশ সস্তা পড়েছে। নিশাত বাচ্চাদের সঙ্গে বিছানায় শোবে আর সে নিচে। এতে কিছুটা খরচ বাঁচে। নিশাত কিছু কাপড় ইস্ত্রি করছে। সে এখনো ভাবছে কাল আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে। ওরা ঠিকই সাইট সি–ইং করতে পারবে। কিন্তু সেটা সম্ভব হবে না। আবহাওয়া চ্যানেলগুলো অনবরত বলছে আজ সারা রাত বরফ পড়বে। কাল দুপরের পর গিয়ে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে গাড়িচালকদের খুব সাবধানে চলতে বলা হয়েছে। দুর্ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে। আবির সাহস পায় না। আর তা ছাড়া অমন কনকনে শীতে বাইরে বেরোতেও মন সায় দেয় না। তার দুর্বল ফুসফুস। স্বাভাবিক নিঃশ্বাসেও ঝামেলা হয়।
বাতি নিভিয়ে বসে সে। চারপাশে একধরনের আঁধার তার হাত ধরে বসে থাকে। সে কিছুটা ভাবনায় ডুবে যায়। ভাবার জন্য বুঝি আবছায়া কোনো দারুণ প্রভাবক।
রমিজ আর বশিরের মাঝে কেমন যেন মিল খুঁজে পায় সে। দুজনই নাম বদলিয়েছে। রমিজ হয়ে গেছে রন আর বশির হয়ে গেছে বাসির। দুজনের উন্নতিও দেখার মতো। দুজনই তাদের প্রত্যেক তৃতীয় বাক্যে অপ্রাসঙ্গিক ভাবে অন্তত একবার স্ত্রীর কথা বলে। সারাক্ষণ নিজের সাফল্যের সাতকাহন। তাতে খারাপ কি? কিন্তু সব সময় উন্নতির কথা, নিজের বন্ধুর সঙ্গে? বিশেষ করে যদি দেখা যায় পাশের মানুষটি ক্রমাগত বেঁচে থাকার লড়াই করছে, শুনতে ভালো লাগে না। সে বিষয়ে কারও সঙ্গে আলোচনাও হয়তো ঠিক নয়। নিজের ক্ষুদ্রতা প্রকাশ পায়। আবির আর ভাবে না। বাইরের দিকে তাকায়। চারপাশ সাদা সাদা তুষারে ঢেকে গেছে। বরফের বুঝি একধরনের দ্যুতি রয়েছে। এত ওপর থেকেও কেমন স্পষ্ট দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে আবির বিড়বিড় করে বলে, কী কুৎসিত, কী কুৎসিত!
সে ল্যাপটপ খুলে বসে। নিশাত এর মাঝেই শুয়ে পড়েছে। গত দুদিন তেমন একটা মেইল চেক করেনি সে। জানে কোনো গুরুত্বপূর্ণ চিঠি আসবে না, আসে না আজকাল, তবুও সে এই কাজটি নিয়মিত করে। দেশে থাকতে এই অভ্যাসটি গড়ে উঠেছে তার। এখনো তা নিয়মিত করে সে। ইনবক্সে ওর চোখ এক জায়গায় স্থির হয়ে যায়। লিয়াং মেইল পাঠিয়েছে। সে মেইলটি খুলে পড়ার চেষ্টা করে।
মেইল পড়ে শেষ করে। পরপর দুবার পড়ে। মাঝের দুই দিন মেইল চেক না করার জন্য এবার আফসোস হতে থাকে তার। (চলবে, পরের কিস্তিতে সমাপ্ত)
আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন:
http://www.prothom-alo.com/durporobash/article/676891