যে গল্প কোনো দিন শেষ হয়নি

মুক্তিযোদ্ধা বাবার সঙ্গে লেখিকা
মুক্তিযোদ্ধা বাবার সঙ্গে লেখিকা

সময়টা বড় অসময়, ১৯৭১। কৃষ্ণচূড়া গড়নের এক যুবক, তার ছোট ছোট সাতটা ভাইবোন, সঙ্গে অবুঝ একটা মা। যিনি কিছুতেই তার বড় সন্তানকে যুদ্ধে যেতে দেবেন না। কিংবা একজন বুদ্ধিমান বাবার, যিনি অবুঝ মাকে সামলানোর ভার নিয়ে তার বড় সন্তানকে বলেছিলেন, তুই যা!
যাকে হেলাল হাফিজ বলেছিলেন কবিতায়—‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনি হতে হয়। যদি কেউ ভালোবেসে খুনি হতে চান। তাই হয়ে যান, উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়।’
দেশমাতাকে ভালোবেসে, পাশে থাকা অবুঝ মাটাকে, ‘ধুর পাগল, কাঁদে কেন!’ বলে কৃষ্ণচূড়া গড়নের ওই যুবক সে দিন যুদ্ধ খাতায় নাম লিখে বাড়ি ফিরেছিলেন, তিনি আমার আব্বু।
আঘাত কখনো গৌরবের হয় বিজয়ের গল্প করার প্রারম্ভিকা। অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে সাড়া দিতে প্রস্তুত হওয়া সে সকল যুবকদের খুঁজে খুঁজে জীবন প্রদীপ নেভানোই ছিল যুদ্ধ চলাকালে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল টার্গেট। আমার আব্বুও বাদ পড়ল না। বুকের এপাশ-ওপাশ ভেদ করে চলে গেল বুলেট। দুর্বিষহ সেই কৃষ্ণকায় রাত, দুর্বার সে যুবকের বুকে তবু বিশ্বাস, ভোর আসবেই।
রক্তে ভেসে যাওয়া সে রাত কতটা দীর্ঘ ছিল, কী করে বুকের মাঝে তাজা বুলেট বিদ্ধ করে চলে যাওয়ার পরেও আহ্‌ শব্দটি না করে আরেকটা ভোর এসেছিল। কীভাবে গুলিবিদ্ধ হয়েও একেবারে নিশ্চুপ থেকেছিলেন আমার আব্বু। সঙ্গে থাকা আরও নয়টা প্রাণ না হলে সেখানেই নিভে যাবে বলে। যুদ্ধদিনের গল্প শুনতে বায়না ধরা সন্তানদের আব্বু বলে যান, বুক ভেসে যায় চোখের জলে। জলে একাকার আব্বু, এই গল্প কখনোই শেষ করতে পারেন না।
তবু আমরা সন্তানেরা শুনে নিই কান পেতে। কীভাবে দীর্ঘ রাত শোণিতাক্ত বুক ক্ষণে ক্ষণে থমথমে রক্তের লাল গালিচায় রূপ নিতে থাকে একজন মুক্তিযোদ্ধার। বুঝে নিই, আর একটু সরে গিয়ে আব্বুর বুকের মাঝে তোলপাড় করে বিজয় আনার ধুক ধুক ধুক স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার আওয়াজ!
স্বাধীন দেশের প্রতিটি স্বাধীন নিশ্বাসে আমি বিস্ময়ে উৎফুল্ল হই বারংবার এই ভেবে, আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান! ভালোবাসা যেন একাত্তরের সেই কৃষ্ণচূড়া যুবক। এই দেশটাকে বুকের রক্ত ঢেলে পিতৃহীন করতে দাওনি বলে।
সবুজের বুকে রক্ত দিয়ে আগুন লাল কৃষ্ণচূড়া বৃত্ত এঁকে দিয়েছ বলেই, আজ আমরা স্বাধীন দেশের সন্তান। শ্রদ্ধা তোমায় আব্বু। ভুবন জোড়া আদর তোমায়।