আমি কীসের মধু খুঁজে বেড়াই

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। সংগৃহীত
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। সংগৃহীত

প্রায় আট বছর আগে বাংলাদেশে গিয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বেড়াতে গিয়েছিলাম। যাত্রী আমি আর আমার স্ত্রী। একটা সাদা রঙের ছোট মতো ফেরিতে করে টেকনাফ থেকে রওনা দিয়েছিলাম সকাল আটটার দিকে। ফেরির নাম জলবাহাদুর। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় ১১টা বেজে গেল। জলবাহাদুর ঘাটে ভিড়বার আগেই দেখলাম একদল মানুষ আমাদের ফেরির জন্য অপেক্ষা করছেন। ছোট দ্বীপের একপাশে এতগুলো মানুষ একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আর তাদের উল্টো দিকে সূর্য থাকায় দূর থেকে মনে হচ্ছিল দেয়ালে টাঙানো কোনো সাদাকালো ছবির ভাস্কর্য।

ফেরি ঘাটের আরও নিকটে পৌঁছালে লক্ষ্য করলাম ওই মানুষগুলোর বেশির ভাগই অল্পবয়স্ক ছেলেপুলে। তাদের মধ্যে আট-দশ বছর বয়সীদের সংখ্যাই বেশি। একই বয়সী মেয়েরাও আছে। প্রথমে ভেবেছিলাম ওরা হয়তো ফিরতি ট্রিপে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু ঘাটে নামার পর ভুল ভাঙল। ওরা আসলে ফেরির জন্যই অপেক্ষা করছে, তবে কোথাও যাওয়ার জন্য নয়। অপেক্ষার কারণ জলবাহাদুরে আসা পর্যটক যাত্রীদের বিভিন্ন রকম সেবাদান করা। বেশির ভাগ পর্যটক যাত্রী একদিনের জন্য সেন্ট মার্টিনে বেড়াতে আসেন। দ্বীপটিতে সারা দিন ঘুরেফিরে বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে আবার ফিরে যান। অনেকে অবশ্য রাত্রিযাপনও করেন।
ঘাট আর জাহাজের মধ্যে সমন্বয়কারী একটা বড় কাঠের সিঁড়ি অতি সাবধানে পার হলাম। ওপারে নামার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হলো অপেক্ষারত ছেলেমেয়েদের হইচই। নতুন দ্বীপে নতুন অভিজ্ঞতা। কেন হইচই বুঝতে চেষ্টা করার আগেই আমাদের গাইড বলল যে, ওরা এই দ্বীপের স্থানীয় জেলেদের সন্তান। দ্বীপে বেড়াতে আসা যাত্রীদের টুকটাক সেবাদান করে ওদের সামান্য কিছু আয়-রোজগার হয়। তা দিয়ে কোনো রকমে পেটে ভাতে চলে যায়। ছেলেমেয়েগুলোর বাবাদের বেশির ভাগ সময়ই সমুদ্রে কাটায় মাছ শিকারে। সমুদ্রের মাছ শিকার হয় মহাজনের নৌকা দিয়ে। নিজের বলতে শুধু প্রাণ আর দেহ। একবার মাছ শিকারে বের হলে অনেক সময় দুই কী তিন সপ্তাহ পরে ফিরে আসে। অনেকে আবার কখনো ফিরে আসে না। সমুদ্রের রুক্ষ ব্যবহারে তাদের প্রাণ যায়। বহু বছর স্ত্রী-সন্তানেরা শুধু সমুদ্র পানে চেয়ে থাকে যদি কোনো দিন মানুষটা ফিরে আসে। তারপর আস্তে আস্তে ভুলে যায়। যাদের মা আছে তারা এদিক-ওদিক হয় ঝুটা কাজ করে। আর তা না হলে শুঁটকি খামারে কামলা দিয়ে কোনো রকমে জীবন চালায়। জীবন নামের যান বড়ই নিষ্ঠুর আচরণ করে এই অপূর্ব দ্বীপের হতদরিদ্র অভিবাসীদের কাছে।
স্যার, আমি আফার জুতা নিমু। সাত কী আট বছরের ছোট একটা মেয়ে এসে আকুতি জানাল যে, আমার স্ত্রীর জুতা বহন করবার কাজটা যেন তাকেই দেওয়া হয়। ভালো করে লক্ষ্য করলাম মেয়েটি একটু লজ্জা মেশানো মিষ্টি হাসিতে আমার কাছে জুতা বহনের মতো একটা কাজের জন্য আবদার করছে। মনে হলো এই হাসির মধ্যে বঙ্গোপসাগরের সমস্ত ঢেউ খেলা করে। অতি সাবধানী মেয়েটি ইঙ্গিত দিল যে, অন্য কাউকে যেন আমি এই কাজটা না দিই। মেয়েটির লাজুকতাও যেন মেঘের আড়ালে সূর্যের লুকোচুরি। ওর হাসিতে বিন্দুমাত্র অভিনয় নেই। যদিও ওর মধ্যে কিছুটা উৎকণ্ঠা কাজ করছিল। মেয়েটিকে প্রশ্ন করলাম, নাম কি তোমার? জুতা কেন নিবে? একসঙ্গে দুটি প্রশ্ন করে বুঝতে পারলাম, এই ছোট মানুষটির জন্য একটু বেশিই জিজ্ঞাসা করা হয়ে গেছে।
আমার নাম দীপালি। জুতা পরি আফা বালির ওপর হাঁটতে পারবি না। সবাই তো খালি পায়ে হাঁটে। মেয়েটির সোজা-সাপটা উত্তর। বুঝলাম পর্যটকদের ব্যাগ ও টুকটাক জিনিসপত্র বহন করবার জন্য এই সমস্ত ছোট ছেলেমেয়েরা কাজ করে। দৃশ্যটা এই রকম যে, পর্যটক স্বামী-স্ত্রী সমুদ্র পাড়ে নিজেদের হাত ধরে হাঁটছে। তাদের পেছন পেছন ছোট একটা মেয়ে তাদেরই মূল্যবান জুতা জোড়া ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে সৈকতের এই মাথা থেকে ওই মাথা তাদের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। পশ্চিমাকাশে সূর্যাস্তের সময় ওই দম্পতি এক জায়গায় থেমে যাবে। তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করবে দিগন্তে সূর্যাস্তের দৃশ্য বন্দী করবার জন্য। স্ত্রী একটা ছবি তুলবে হাতের তালুর ওপর কুসুমকোমল অস্তগামী সূর্যকে আলিঙ্গন করছে। অন্য ছবিটা হবে দুজনের মুখোমুখি বসে আছে আর মাঝখানে অস্তগামী সূর্য। দূর থেকে জুতা বহনকারী ছোট মানুষটা পৃথিবীর বিস্ময় নিয়ে পর্যটক স্বামী-স্ত্রীর কাণ্ড-কারখানা দেখবে। এই ছবিগুলোর স্থায়ী ঠিকানা হয় বেডরুমের সাইড টেবিলের ওপর। ওই ছবিগুলোতে সমুদ্র সৈকত, ঢেউ, অস্তগামী সূর্য সবই থাকে। শুধু থাকে না ছোট মানুষগুলো।
তোমাকে কত টাকা দিতে হবে? দীপালিকে প্রশ্ন করলাম। খুশি হয়ি যা দিবেন তাই নিমু। এবারও ওর সোজা-সাপটা উত্তর। কালবিলম্ব না করে দীপালিকে সঙ্গে নিয়ে নিলাম। ওকে বললাম যে, ও শুধু এক জোড়া জুতাই বহন করবে না, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দ্বীপাঞ্চলটা যতটুকু সম্ভব ঘুরিয়ে ফিরিতে দেখাতে হবে। ওকে আশ্বস্ত করলাম গাইড হিসেবে থাকবার জন্য ওর রেট একটু বেশিই দেওয়া হবে। আমরা একটা রিকশা ভ্যান নিয়ে ঘাট থেকে দ্বীপের অন্যপাশে গেলাম। দীপালি রিকশা ভ্যানে চড়ে পা দুলিয়ে দুলিয়ে আমাদের সঙ্গে অভিযাত্রী হলো।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। সংগৃহীত
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। সংগৃহীত

দুপুর ২টা পর্যন্ত সেন্ট-মার্টিনের এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করে আমরা একটু ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। একটু একটু ক্ষুধাও লেগে গেল। আসার পর থেকে আমরা দুজনে শুধুমাত্র একটি করে ডাবের পানি খেয়েছি। দ্বীপাঞ্চলে এসে ডাব না খেয়ে বাড়ি ফেরা মানে অসম্পূর্ণ আনন্দ বিলাস। দীপালিও অনেকটা আমাদের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। এক জোড়া জুতা সে খুবই সাবধানে দুই হাতের মধ্যে নিয়ে বালুর ওপর দিয়ে হেঁটে চলছে। ওর ছোট ছোট পায়ের ছাপ ভেজা বালুর ওপর হালকা প্রভাব ফেলছে। পর মুহূর্তে সমুদ্রের ঢেউ এসে তাও আবার মুছে দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ঢেউও চায় না তার পাশ দিয়ে কেউ একজন পদচিহ্ন রেখে যাক।
দীপালিকে জিজ্ঞাসা করলাম ভাত–মাছ খাওয়া যায় এমন কোনো রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সে অতীব উৎসাহ ও উদ্দীপনায় আমাদের বালুকা সৈকত থেকে সরিয়ে একটু কোলাহলময় জায়গায় নিয়ে গেল। বুঝলাম ওটাই হচ্ছে সেন্ট মার্টিনের ডাউন টাউন। বেড়া আর ছোপরা দিয়ে মোড়া, ভেতরে কয়েকটা বেঞ্চ বসানো এমন একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দীপালি বলল, এইখানে খানা খান। ক্ষুধার জ্বালা তীব্র হওয়াতে দেরি না করে আমরা দুজনে ভেতরে ঢুকলাম। মালিক যথারীতি আপ্যায়ন করে আমাদের বসাল। দীপালি বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। বুঝলাম ওদের ভেতরে ঢুকতে নিষেধ আছে। পাছে হোটেল মালিকের ব্যবসার ক্ষতি হয়।
খাওয়া সেরে বাইরে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দীপালি আগ বাড়িয়ে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। এতক্ষণ কোথায় ছিলে? দুপুরের খাবার খেয়েছ? ও উত্তর দিল, আমি এতক্ষণ আমার বন্ধুর সঙ্গে খেলছিলাম। হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল ওর খেলার স্থানটিকে। বুঝলাম সে দুপুরের খাবার খায়নি। আমার ধারণা ছিল, হয়তো বাসায় গিয়ে চট করে খেয়ে আসবে। কিন্তু ও যে এতক্ষণ না খেয়ে আছে তা মাথায় খেলেনি। তৎক্ষণাৎ ওর হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললাম, পেট ভরে যা খুশি খেয়ে আসতে। আমরা চা পান শেষ করার আগেই দীপালি হাসি মুখে ফিরে এল। পেট ভরে খেয়েছে কিনা জানতে চাইলে, ও হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল।
এবার আসি আমেরিকার ঘটনায়। এক দিন আমার কাজের উল্টো দিকের কিউবে দুই আমেরিকান নারী ফিসফিস করে যেন কী বিষয়ে কথা বলছিলেন। কথা প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমেরিকান নারী বললে আমরা দেশিরা মোটামুটি একশত ভাগ সময়ই বুঝি সাদা মহিলা। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশি, শ্রীলঙ্কান বা সোমালিয়ার কোনো নারী সাতাশ বছর আগেও আমেরিকান নাগরিকত্ব পেলেও সে আমেরিকান নারী বলে বিবেচিত হতে পারবে না। এর কারণ হচ্ছে আমাদের মন–মানসিকতায় পরিচর্যার অভাব। দীর্ঘদিন মন-মানসিকতা উন্নতিকরণ চর্চা না করতে করতে ওতে বিরাট ধুলোর আস্তর পড়ে গেছে। যা হোক, স্বল্প স্বরে দুই নারী যে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করছিলেন তা জানতে পেরে আমার পেটে একটু খিঁচুনি দিল। কান খাঁড়া করে আলোচনার বিষয় সমন্ধে যা জানতে পারলাম তা হলো নিউ জার্সি স্টেটে ১৮ বছর বয়সী এক শ্বেতাঙ্গ তরুণী তার জন্মদাতা বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেছে। মামলার বিষয় তরুণীটির বাবা-মা তার প্রাইভেট কলেজের খরচপত্র থেকে শুরু করে সব আনুষঙ্গিক খরচ বহন করা বন্ধ করে দিয়েছেন। উপরন্তু ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ায় বাবা-মা তাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। সে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে, আদালত যেন তার পক্ষ হয়ে বাবা-মায়ের এই বিরুদ্ধাচরণের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়। পরে গুগল সার্চ করে জানতে পারলাম যে, মেয়েটির নাম র‍্যাচেল ক্যানিং। তার বিরুদ্ধে বাবা-মায়ের অভিযোগ হলো, সে বাবা-মার দেওয়া কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করে না। তার ওপরে সে একটা বদ ছেলেবন্ধু জুটিয়েছে। আদালতে প্রথম শুনানির দিনে র‍্যাচেলের বাবা-মা দুজনে দুজনের হাত ধরে বিচারকের কথা শুনছিলেন। অনতিদূরে বসে ছিল তাদের এক সময়কার আদরের সন্তান র‍্যাচেল। এই মামলা আমেরিকার বিচার ব্যবস্থা ও সন্তান জন্ম দেওয়া পিতা-মাতার নজর কেড়েছে। শেষ পর্যন্ত সন্তানের জয় হবে নাকি জন্মদাতা পিতা-মাতা জয়ী হবে তা দেখার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। সংগৃহীত
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। সংগৃহীত

সেন্ট মার্টিনের দীপালি প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল প্রায় আট বছর আগে। আমেরিকা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে কোনো এক দ্বীপে। জীবন, সময় আর ব্যস্ততার বাস্তবতায় তাকে ভুলেই যাওয়ার কথা। জীবন মানেই নতুন নতুন স্মৃতির জন্ম দেওয়া আর পুরোনো স্মৃতিগুলোর গোড়া উপচে ফেলা। এই কাজে যে যত পারদর্শী সে জীবনকে তত দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। যারা বিফল হয় তাদের জীবন নামক যানে চলতে হয় অনেকগুলো বোঝা কাঁধে নিয়ে। ঈদের আগে গরিব মানুষগুলো যেভাবে কমলাপুরে স্টেশনে রেলগাড়ির ছাদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বোঝা তোলে। তাদের জন্য পদে পদে থাকে কষ্ট আর প্রাণনাশের ঝুঁকি।
সেদিন বিকেল অবধি আমরা সেন্ট-মার্টিন দ্বীপ ঘুরেফিরে দেখে বিকেল পাঁচটার দিকে ফিরতি ফেরি জলবাহাদুর ধরবার জন্য ঘাটের দিকে পা বাড়ালাম। দীপালিও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে এল। সারা দিনের হাঁটাহাঁটিতে বেচারি একটু ক্লান্ত বুঝতে পারলাম। মনে মনে ভাবলাম, ওকে কিছু বকশিশ দেব যাতে করে আরও কয়েক দিন পর্যটকের জুতা বহন করবার কাজ না পেলেও ওর যেন কষ্ট না হয়। ওর মুখ দেখে বারবার কেন যেন সন্দেহ হচ্ছিল খুব সম্ভবত ও দুপুরের খাবার না খেয়ে টাকাটা রেখে দিয়েছে। ঘাট থেকে ফেরিতে ওঠার সময় চালাকি করে আমি ওকে একটা বড় নোট দিলাম। উদ্দেশ্য শুধু জানতে, ওর কাছে ভাংতি বা অতিরিক্ত টাকা আছে কিনা। ভাংতি দিতে গেলে বোঝা যাবে ওর কাছে কত টাকা আছে। আমার সন্দেহই ঠিক হলো। ছোট মানুষ বলে আমার চালাকি বুঝতে পারল না। সে দিব্যি দুপরে আমার দেওয়া টাকাটা দেখিয়ে বলল এই তার ভাংতি। সুযোগ না দিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলাম কেন সে দুপুরের খাবার খায়নি। উত্তরে সে বলল, তার দুই বছরের ছোট একটা বোন আছে। ওর মা বোনটিকে সঙ্গে নিয়ে শুঁটকি শুকানোর কাজ করে দ্বীপের কোথাও। সারা দিন কাজ করে সন্ধ্যায় মা ও বোন বাসায় আসবে। মায়ের হাতে আজকের জমানো টাকাগুলো দেবে। তারপর মা আর মেয়ে বসে মাটির হাঁড়িতে রান্না করবে।
কিছুটা ভগ্ন মন নিয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ছাড়লাম। ভগ্ন মন এই কারণে যে, কিছু কিছু জায়গা আছে জীবনে একবারই যাওয়া হয়। ফেরির পেছন দিকের পাটাতনে দাঁড়িয়ে আছি। সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েনি। জলবাহাদুর বীরদর্পে গর্জন তুলে ঢেউ ভেঙে ভেঙে সম্মুখ পানে এগিয়ে চলেছে। ছপাৎ ছপাৎ শব্দ। একদল শহুরে তরুণ-তরুণী গান বাজনায় মেতে উঠেছে। দূর থেকে ঘাট দেখা যাচ্ছে তবে এখন আর অপেক্ষার মানুষগুলো নেই। সমুদ্রবক্ষের কোথাও কোথাও এক কী দুটি মাছ ধরার নৌকা ঝিম মেরে থেমে আছে। হয়তো জেলেরা মাছ খুঁজে চলেছে। একটা কালো জেলে নৌকার ওপরে উদাসীন উড়ে যাওয়া একটা পাখি। সেও যেন কী খুঁজছে। হয়তো মাছ হবে। দিনের শেষে একদল সাদা পাখি দিগন্তের সীমারেখা দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।
সারা দিনের ক্লান্তিতে আমি সিটের ওপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলাম। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় দেখতে পেলাম দীপালি জলবাহাদুরে আমাদের সহযাত্রী হয়েছে। ঠিক পাশের সিটেই বসে আছে। হাতে কোনো জুতা ধরা নেই। ওর পিঠে একটা সুন্দর ব্যাগপ্যাক। ঠিক যেমনটি অনেক ধনাঢ্য মেয়েদের থাকে। জীবনের প্রথমবার সে দ্বীপাঞ্চল ছেড়ে অন্য কোথাও যাচ্ছে। তাও আবার সুদূর আমেরিকার নিউজার্সি স্টেটে। ঢাকা হয়ে তাকে নিউজার্সি স্টেটে নিয়ে যাওয়া হবে আমেরিকান অ্যামবাসির সহায়তায়। তাই খুশিতে সে খুব উত্তেজিত। আঠারো বছরের ধনাঢ্য কন্যা র‍্যাচেল ক্যানিং আর তার বাবা-মায়ের মামলার শুনানি হবে কিছুদিন পর। সমস্ত আমেরিকার খবর জুড়ে হইচই রব পড়ে গেছে। এই মামলায় কে জিতবে কে হারবে। জন্মদাতা বাবা-মা নাকি সন্তান। দীপালিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সমস্ত বিশ্বের প্রতীকী সন্তান হিসেবে। আমেরিকার এই মামলা অনেকটা মানবিক মূল্যবোধের বিপর্যয়ের মতো। দীপালি কোর্টে দাঁড়িয়ে দোভাষীর মাধ্যমে কিছু কথা বলবে আমেরিকান ওই তরুণীর দিকে তাকিয়ে। সে বলবে যে, তার বয়স আট। তার বাবা সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে হারিয়ে গেছে। তার মা ও দু-বছরের একটা বোন আছে। সে প্রতিদিন সকালে ঘাটে গিয়ে একটা ফেরির জন্য অপেক্ষা করে। ওই ফেরিতে করে প্রায় সময়ই ১৮ বছরের মেয়েরা বেড়াতে আসে। ওই সমস্ত মেয়েদের পায়ে দামি জুতা থাকে। দ্বীপে অনেক হাঁটাচলা করলে ওই জুতাগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। তাই সে জুতাগুলো হাতে নিয়ে পর্যটকদের কিছুটা স্বস্তি দেয়। বিনিময়ে যে টাকা সে বকশিশ পায় তা নিয়ে দিনের শেষে মায়ের হাতে তুলে দেয়। সে এখনো বিশ্বাস করে একদিন তার বাবা সমুদ্র থেকে ফিরে এসে তাকে কোলে তুলে নিবে। সে তার মা-বোনকে অনেক অনেক ভালোবাসে।
জলবাহাদুর হেলে-দুলে বীরদর্পে সমুদ্র গর্ভে এগিয়ে চলেছে। চারিদিকে শুধু জল আর জল। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। শুধু সীমান্তের জলরেখার ওপর একটা কালো সমান্তরাল দাগ। আমি কল্পজগতে দেখতে পেলাম দীপালি আর তার মায়ের রান্না করার দৃশ্য। রান্নার ধোঁয়ায় সমস্ত দ্বীপাঞ্চলের আকাশ আচ্ছাদিত হয়েছে। দূর থেকে দেখছি একখণ্ড সাদা মেঘ দীপালিদের কুড়ে ঘরের ওপর পায়চারি করছে। ওটা আসলে মেঘ নয়। রান্নার ধোঁয়া। ওই ধোঁয়ার ভেতর থেকে দীপালির কণ্ঠে রবি ঠাকুরের গান ভেসে আসছে:
আমি ফিরব না রে, ফিরব না আর, ফিরব না রে
এমন হাওয়ার মুখে ভাসল তরী
কুলে ভিড়ব না আর ভিড়ব না
ঘাটের রশি গেছে কেটে
কাঁদব কী তাই বক্ষ ফেটে
এখন পালের রশি ধরব কষি
এ রশি ছিঁড়ব না আর ছিঁড়ব না।