প্রবাসে স্বদেশি নিশ্বাস

মঞ্চে মোহাম্মদ ইমরান, জাকিয়া হাসনাত ইমরান, সঞ্চালক আরমান ও অন্যান্য
মঞ্চে মোহাম্মদ ইমরান, জাকিয়া হাসনাত ইমরান, সঞ্চালক আরমান ও অন্যান্য

কথা হচ্ছিল বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন নিয়ে। অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ থেকে এমন আয়োজন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান মঞ্চের বক্তব্য থেকে বৈঠকি আলোচনায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। দর্শকের সারি থেকেই তাঁর সঙ্গে আলাপ। বললেন, বাঙালি ঐতিহ্যগতভাবেই অসাম্প্রদায়িক। চমৎকার বাচন তাঁর।

এই লেখকের সঙ্গে তাঁর এ খণ্ড আলোচনা। বাংলা স্কুলের অধ্যক্ষ আমার অন্য পাশে। কথাগুলো রেলগাড়ির মতো এগিয়ে যায়। মোহাম্মদ ইমরান বলেন, বর্ষবরণ এ ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাহন। এই মূল্যবোধটি ছড়িয়ে দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, এমন আয়োজনের মধ্য দিয়েই প্রবাসে বাঙালির এই পরিচয়টি উচ্চমাত্রা পাবে।
১৫ এপ্রিল শুক্রবার। আবুধাবির বাংলা স্কুলে বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজন করেছিল বৈশাখী মেলার। বাংলা স্কুল এ জন্য ছিল লোকে লোকারণ্য। এখানে তরুণীরা এসেছেন শাড়ি পরে আর তরুণেরা পাঞ্জাবি। ছোটরা-নতুন জামা গায়ে জড়িয়ে আনন্দে কাটিয়েছে সারাটি দিন।
স্কুল চত্বরে ঢোকার পথেই কানে ভেসে আসছিল আবাহনী কণ্ঠ। আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা দেখবি যদি আয়, ধুম পড়েছে রং লেগেছে বৈশাখী মেলায়। ছেলে মেয়েরা খেলাধুলা করছে মাঠে। এদিকে প্রশাসনিক ভবনের গা ঘেঁষে তরুণীরা দাঁড়িয়ে। তারা গল্প করছে। মুখে মধুর হাসি। বিজ্ঞান ভবনের সামনের দিকেও নরনারীর ভিড়। তারা ছেঁটে বা দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। বৈশাখেরই ধুম। কী অনাবিল আনন্দ। মানুষের স্রোত ডান দিকে নিয়ে যায়। পাশে চায়ের দোকান। প্রিয়জনেরা এক সঙ্গে চা খাচ্ছেন। আহা কী তৃপ্তি!

মঞ্চ
মঞ্চ

অডিটোরিয়ামে ঢুকতেই হা হয়ে যাই। যেন এক চিলতে বাংলাদেশ! বার্তা শুনি আর অবাক হই। মাটির পুতুল চার আনা, হাতি ঘোড়া ছয় আনা, মুড়ি মোয়া রঙিন পানি কিনবে যদি আয়...। ইষ্টিকুটুম, বৈশাখী, ধানসিঁড়ি, আহার বিহার, দুরন্ত নামের স্টলগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে মিঠাই মণ্ডা, পিঠা পায়েস—যার যা পছন্দ খেয়ে নিচ্ছে।
আপ্যায়নে বাঙালি রমণীর নাম স্বর্গ পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। এ খবর জানি। এখানে এসে এর সত্যতা পেলাম। মহিলা সমিতির সভাপতি জাকিয়া হাসনাত ইমরান তাঁর প্রিয় সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রাণঢালা ভালোবাসা জানালেন। অসমান্তরাল আন্তরিকতা! নববর্ষে কিছু না গ্রহণ করলে যেন অমঙ্গল! আমি না বলতে পারি না।
মেরিল্যান্ড স্কুলের একাদশের শিক্ষার্থী ফাতিমা তাবাসসুম দাঁড়ানো ধানসিঁড়ির পাশে। বলল, দূতাবাস পরিবারের স্টল থেকে স্বেচ্ছাসেবা দিতে পেরে ভালো লাগছে। নাসরিন আখতার। বিস্ময়ভরা চোখ তার। পিঠা পায়েসের আয়োজন এই পরবাসে। অনেক, অনেক! রূপসা জাহান বললেন, আনন্দ আনন্দ। এই আমাদের সংস্কৃতি, অন্য ধরনের প্রকাশ তার। নাসরিন সুলতানা ভীষণ খুশি। বললেন, দিনটাকে উপভোগ করছি বহুমাত্রায়।

ধানসিঁড়ির স্টলে জাকিয়া হাসনাত ইমরান ও দূতাবাস পরিবারের সদস্যরা
ধানসিঁড়ির স্টলে জাকিয়া হাসনাত ইমরান ও দূতাবাস পরিবারের সদস্যরা

মহিলা সমিতির বৈশাখী তখন বেশ জমজমাট। পপি রহমান, আঞ্জুমান আরা ও রেহেলি মুশফিক একযোগে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানালেন। যেন জয়ধ্বনি, গ্রামের টান না থাকলে কী এমনটি হয়। জাকিয়া হাসান সুষমা মিশালেন, ফুলেল শুভেচ্ছা! আরও কাব্য আরও কথা। সাজু মতিউদ্দিন, রুহানী আফরোজ, রুখসানা হুদা ও তাহমিনা রিক্তা—ব্যস্ত তারা। কিন্তু ভোলেন না দেশের কথা। মনের মাধুরী দিয়ে প্রস্তুত তাদের এ পিঠা পায়েস। বাঙালি ললনা বলে কথা।
রমনার বটমূলে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ষাটের দশকে একবার ছায়ানট গেয়ে ওঠে—এসো এসো হে বৈশাখ। সমবেত কণ্ঠে তারা আহ্বান করে বৈশাখকে। সে ছিল প্রাণের ডাক। সে ধারা এখনো চলমান। মূলত এমন চেতনার উৎস গ্রাম। এখন সে আবেগ বৃহত্তর জনপদে ছড়িয়ে পড়েছে। নববর্ষ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানের স্বাগত কথনে অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসান এমনটিই বললেন। তার কথা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে লালন করার পাশাপাশি বাঙালি মানসে যুক্ত হয় জাতীয়তাবোধ দেশপ্রেম ও অসাম্প্রদায়িকতার অনুভব। তিনি বলেন, পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে তা একীভূত হয়ে গেছে।
মঞ্চে সংগীত, নৃত্য, অভিনয় যথারীতি চলছিল। পুরোদিনের এ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন দূতাবাসের শ্রমবিষয়ক কাউন্সেলর আরমান উল্লাহ চৌধুরী। মেধাবী শব্দ সঞ্চয়ন আর নিয়ন্ত্রিত প্রক্ষেপণ তার। সঙ্গে ছিলেন তার সহধর্মিণী কারিশমা ইনাম।
গান পরিবেশন করেন দুবাই কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল শিকদার বদিরুজ্জামান। প্রবাসে তরুণ মনে আনে প্রিয়জনের মুখ। আলাদা ব্যঞ্জনা আনে পরিবেশে। একই আবাসের রাজনীতিবিষয়ক কাউন্সেলর ড. তানভির মনসুর। কথা হয় ভার সঙ্গে। ভালো লাগা কথা। বললেন, এ এক মিলনমেলা। আশাবাদ ব্যক্ত করলেন, নতুন শক্তিতে উজ্জীবিত হোক বাঙালি সত্তা। সঙ্গে তার সহধর্মিণী মুনিরা আজম। বিস্ময় আর আনন্দ ভরা মুখ। বললেন, মানুষের মধ্যে কী ভালোবাসা। ছড়িয়ে পড়ুক সে উপলব্ধি সবখানে সবখানে.... যেন গান। প্রার্থনা করলেন কায়মনো বাক্যে। দূতাবাস পরিবারের সম্মানীজন আন্না জামান। তিনিও সবার মঙ্গল কামনা করলেন।
পুরোনো বাংলা সিনেমার গানের রূপায়ণ করেছেন স্কুলের শিক্ষার্থীরা। দর্শকদের হৃদয়-ছুঁয়ে যায়। এ পর্বে কুশীলবদের প্রস্তুত করেছেন দুই শিক্ষক। সৃজনশীল এই কাজটির জন্য ফালুনা হক ও তানজিলা আফজাল অবশ্যই প্রশংসার দাবি করতে পারেন। বিলি কেটে এসেছি। বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ইফতেখার হোসেন শুভেচ্ছা জানান। বিবিএর শিক্ষার্থী হ্যাপি দেবী আয়োজনে ভালো লাগার অনুভূতি প্রকাশ করেন। তার দুই বন্ধুর একজন বুশরা। তার আসা পরিবারের সদস্যদের নাচ গান দেখতে। অন্যজন জুবাইর নাহা মেডিকেল সায়েন্স পড়ছেন। বেড়াতে আসা বললেন, আনন্দে বয়ে যায় সময়। তারা তিনজনই বাংলা স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী।

অনুষ্ঠানে উপস্থিতির একাংশ
অনুষ্ঠানে উপস্থিতির একাংশ

এরই মধ্যে দেখা হয় ইমশাদ নাজ, নিলা, নাজিফা আর তানহার সঙ্গে। নববর্ষের গানে নাচে উজ্জ্বল তারা। আমরা আমাদের অগাধ স্নেহ থেকে তাদের বঞ্চিত করি না। সপ্তম শ্রেণির পপি এরই মধ্যে বলে ওঠে, আমি নাটকের আম্মাজান, আমাকে দেখেননি? আমি ওর চটপট প্রশ্নে অবাক হই। সেও বাদ পড়ে না, আমার স্নেহ থেকে। আগেই দেখা হয় স্কুলের তিন মেধাবীর সঙ্গে। তারা এখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। আসমা আমরি​ন ও জারিন তাসনিম উপস্থাপনা আর মুসারাত জাহান খেলাধুলায়। তারা স্বাগত জানায় অনুষ্ঠানে।
আবুধাবিপ্রবাসী আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের সঙ্গে দেখা। মোহাম্মদ ইউসুফ তার সংগঠনের কর্মীদের নিয়ে মহড়া দিচ্ছেন। সাদা পাঞ্জাবির ছড়াছড়ি দেখলাম। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু পরিষদে লাল রঙের বহর। কথা হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন পরিষদ সভাপতি আজিম ফজলুল কাদেরের সঙ্গে। উচ্ছ্বাস তার কণ্ঠে। মঙ্গলযাত্রা সফল হয়েছে। সামনে দেখি ছবিয়াল বোরহান। পরম স্নেহের তরুণ। আমারই ক্যামেরায় ছবি তুললেন। পুরোনো বন্ধু সাদউদ্দিন কামরান। হাত মেলান আনন্দে।
আমরা এগোই সামনে। এবার একা নই। এ বহরে স্বাগতিক স্কুলের অধ্যক্ষ। তিন নিয়ে গেলেন তার কক্ষে। সেলফি তোলার আমেজ থেকে আলাদা থাকতে দিলেন না বন্ধু প্রকৌশলী সাহাবুদ্দীন। বঙ্গবন্ধুর ছবির নিচে দাঁড়িয়ে কবিগুরুকে আজকের প্রাণের মেলার খবরটি দিতে উদ্‌গ্রীব হয়ে পড়ি আমি। বলি, দেখ, আমরা বাঙালি কিনা! এ সময় আমাদের সঙ্গে ছিলেন অধ্যক্ষ পত্নী ফারাহ দিবা। আহার বিহারে বড় ব্যস্ত ইংরেজির শিক্ষক ইশরাত জাহান। বললেন উৎসবের অংশ হতে পেরে গর্বিত। বিজ্ঞানের পাঠ দেন রুবাইয়া নিশাত। রবীন্দ্রসংগীত অন্তরে তার। মুছে যাক গ্লানি ধুয়ে যাক জরা....। স্টলের অন্যপাশে বিক্রি হচ্ছে তরুণ–তরুণীদের জামা সালোয়ার কামিজ। দুরন্ত ও বসে নেই। তাসলিমা আক্তার। জন্ম নোয়াখালীতে। তিনি ভার সন্তানসহ তাবৎ ছোটদের কল্যাণ কামনা করলেন।
বাঁদর খেলা দেখবি চল, বাউন্ডুলে ছেলের দল। চোখে চোখে বলবি কথা, নাইরে কোনো ভয়। গ্রামের মেলায় উঠতে মেতে দল বেঁধে সব আয়। এ গান ভাসে বাতাসে। স্টলগুলোও নাচে সেই আনন্দে। ইষ্টিকুটুম শৈল্পিক একটি আকর্ষণ আনতে পেরেছে। এ কৃতিত্বের দাবিদার নাজিম মাহমুদ। মনেপ্রাণে বাঙালি হলেই না এমনটি সম্ভব! ডালাকুলা উপস্থাপিত ধানসিঁড়ির সামনে। যাকে বলে আসল বাঙালিয়ানা।

তানভির মনসুর ও মুনিরা আজম
তানভির মনসুর ও মুনিরা আজম

একতারা নিয়ে কিশোরী নাচে মঞ্চে। পাখা নিয়ে, ছাতা হাতে, ফুল ফুল চুলে কলসি কাঁখে তরুণীরা এগোয়। গালে লেখা নববর্ষ। দৃশ্যের শেষ এখানেই নয়। ছনের ঘর, আলপনা আঁকা উঠোন। তরুণীরা নাচে। পায়ে আলতা, চোখে কাজল, গলায় মালা, কপালে টিপ, কানে দুল। পাশে মিষ্টির হাঁড়ি। শাশ্বত বাংলা।
লুচি, পুরি, জিলাপি ভাজা, পিঠা বানানোর ধুম। কোনোটার চাইতে কোনোটার আকর্ষণ কম। সবই এক হয়ে যায় এখানকার আয়োজনের সঙ্গে। ঝোলানো সিকা, দোলানো রঙিন পাশা, মাটির ময়না, হাতি ঘোড়া কতই না মন জুড়ানো দৃশ্য। শিল্পীর আলপনা, করতাল নিয়ে নরনারীর এগিয়ে যাওয়া, বটতলায় বাউলের কিংবা পাহাড়ি পথে অধিবাসী মেয়েদের নৃত্য, নদীতে নৌকা—এসব ভাসে মনের ক্যানভাসে।
এই তো বাংলা। এই তো বাঙালি। অসাম্প্রদায়িক চেতনার রূপ। আইলো আইলো আইলোরে রঙে ভরা বৈশাখ আমার আইলোরে। খবর আসে কণ্ঠে, ঢাকের বাদ্যে। বাঙালি অভিভূত হয়, স্বাগত জানায়। চিরায়ত বাংলার চেহারা। রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান বাংলার এই পরিচয়টিই ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে চান। জয় হোক সদিচ্ছার।