প্রবাসের দিনরাত্রি-১৫

আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভবন। সংগৃহীত
আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভবন। সংগৃহীত

বছর ছয় সাত আগের কথা। আমেরিকায় তখন অর্থনৈতিক মন্দা চরমে। চাকরির ক্ষেত্র করুণভাবে সংকীর্ণ। চাকরির বাজারে হাহাকার। জুতসই জায়গায় চাকরি তেমন নাই। এ দেশের অর্থনীতি, ওয়াল স্ট্রিট, সর্বোপরি মানুষ চলে হুজুগের ওপর। বিশ্বের কোনো কোণে কেউ যদি একটা পটকাও ফাটায়, তার ঢেউ এসে লাগে ওয়াল স্ট্রিটের গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে সব মেজর ইন্ডেক্সের মান কমে যাবে, স্টকের দাম যাবে পড়ে। মিডিয়া ঝাঁপ দিয়ে পড়ে সেটাকে আরও সাজিয়ে বাড়িয়ে প্রচার করে মানুষকে পাইয়ে দেবে ভয়। কেউ আর আবশ্যিক খরচ বাদে কোনো টাকা পকেট থেকে বের করবে না। টাকার প্রবাহ কমে গিয়ে অর্থনীতিকে আরেক ধাপ দেবে নামিয়ে। এভাবে চলতে চলতে সৃষ্টি হয়ে যাবে অর্থনৈতিক মন্দা। কোম্পানি আর করপোরেটগুলোও ভয়ে ঘোষণা করে দেবে হায়ারিং ফ্রিজ।

আমার পিএইচডি তখন একেবারে শেষ পর্যায়ে। পাস করে বের হয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু চাকরি নাই, ডিফেন্স দিই কী করে? চাকরি সুনিশ্চিত না হলে সাধারণত কেউ ডিফেন্স দেয় না। আমাদের মতো বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের এ দেশে পড়ালেখার পর টিকে থাকা কোনো মামার বাড়ির আবদার নয়, এ এক ম্যারাথন। স্টুডেন্ট ভিসার পর কাজের ভিসা—এফ ১ থেকে ওপিটি থেকে এইচ১বি, তারপর পারমানেন্ট রেসিডেন্সির লম্বা এবং কঠিন বন্ধুর পথ। এ পথ যারা পাড়ি দিয়েছেন তারা জানেন কত বড় ছোট নুড়ি কড়ি পাথরের লম্বা পথ পেরিয়েই তবে আসে কিছুটা স্বস্তি। পেছন ফিরে আর সে পথের দিকে দৃষ্টি ফেলা কঠিন।
আমি কীভাবে যেন চাকরির ওই খরার সময়টাতে ইন্টেল সান্টাক্লারাতে একটা ইন্টার্নি পেয়ে গেলাম। তখনই জানলাম কোম্পানিগুলোতে হায়ারিং ফ্রিজ চলছে, এক রকমের এম্বারগো। সেখানে আমার মেন্টরসহ সবাই উপদেশ দিলেন স্কুলে থেকে চুপচাপ গবেষণা চালিয়ে যেতে, যত দিন না হায়ারিং আবার স্বাভাবিক হয়। আমিও তাই করলাম। চার মাস ইন্টার্নি করে স্কুলে ফিরে এসে আরও এক বছর গবেষণা চালিয়ে গেলাম। আমার প্রফেসর এতে ভারী খুশি, তাঁর সুদে-আসলে লাভ। ওই বছর আমার তিন থেকে চারটা বেশ ইমপ্যাক্টফুল জার্নাল পেপার পাবলিশ হয়েছিল। ওই বছরটাতে আমি ডিসারটেশন ফেলোশিপও পেয়েছিলাম। বেশ ভালো অঙ্কের টাকা, সুতরাং প্রফেসরকে কোনো ফান্ডিং দিতে হয়নি। আমার গবেষণার কাজ দেখিয়ে আমরা বেশ কটা প্রজেক্ট ফান্ডিংয়ের জন্য প্রপোজালও লিখেছিলাম। গ্র্যাজুয়েশন করে আসার পরও সেসব কাজের খুঁটিনাটি অবশিষ্টাংশ দিয়ে আরও দুই থেকে তিনটা জার্নাল পেপার পাবলিশ করেছিলাম। আমাদের ল্যাবে পরে যেসব ছাত্রছাত্রী এসেছিল, তাদের অনেকে আমার কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে অনেক প্রজেক্ট দাঁড় করিয়ে নেয়, সেসব থেকে কো–অথর হিসেবে আমার আরও বেশ কটা জার্নাল পেপার ছাপা হয়।
অভাগা যেদিকে তাকায় সেদিকেই নাকি নদী শুকিয়ে যায়! আমার সকল সফল রাস্তার শেষ মোড়েই দেখেছি সুবিশাল নদী। সেই নদী শুকিয়ে যায়নি, অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সে নদী পার হতে হয়েছে। না হলে আমি যখনই পাস করে বের হব ঠিক তখনই চাকরির বাজারে এম্বারগো হয়! এর বছর চারেক আগে আমি আরেকবার চাকরির এম্বারগো দেখেছিলাম, সেটা বাংলাদেশে থাকতে। সেবার বুয়েটে আমাদের ডিপার্টমেন্টে শিক্ষক নিয়োগের সময়, সরকারি চাকরিতে তখন নিয়োগ বন্ধ, এম্বারগো চলছিল। সেটা ছিল ডিপার্টমেন্টে আমাদের ব্যাচের দ্বিতীয় দফায় নিয়োগ। প্রার্থী ছিলাম আমি আর ৯৫ ব্যাচের এক বড় ভাই। প্রথম দফায় আমাদের ব্যাচের আটজন শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন, আমি প্রথমবার কোনো এক অজানা কারণে বাদ পড়ে গেলাম!
স্মৃতির জানালায় বাসা বেঁধেছে মাকড়সা, তাতে জমেছে বিস্মৃতির ধুলোর প্রলেপ। পেছন ফিরে তাকাতে গেলে ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি। ছাত্রজীবনের এতগুলো বছর কত কিছুই উৎসর্গ করলাম পড়ালেখার জন্য। ভালো ছাত্রের তকমা বজায় রাখার জন্য। সিজিপিএ ধরে রাখার জন্য। বন্ধুদের সঙ্গে ক্যাফেতে অথবা হলের কোনো রুমে মধুর আড্ডার মাঝখান থেকে চলে আসা পরদিন ক্লাস টেস্ট অথবা কুইজ আছে বলে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ কমিয়ে দেওয়া সিজিপিএ কমে যাবে বলে। র‍্যাগের কতশত অনুষ্ঠানের মজা থেকে বঞ্চিত হয়েছি থিসিসের কাজটা ভালোভাবে দাঁড় করানোর জন্য। তারপর এখন পাস করেই কর্মজীবনে প্রথম প্রবেশের মুখে একটা ধাক্কার মতো খেলাম মনে হলো। অথবা কে জানে সফল রাস্তার শেষের মোড়ে সেই যে সুবিশাল নদী যেটার প্রবল ঢেউয়ের ধাক্কা!
এখন ভাবলে অদ্ভুত মনে হতে পারে। তবে ওই বয়সে ওই সময়ের বিচারে চোখে ছিল রঙিন স্বপ্ন। বুয়েটের শিক্ষক হব, মাস্টারি করব। তাই অন্য কোনো প্রস্তুতি নিয়ে রাখিনি। সেটাই ছিল আমার জন্য বড় সমস্যা। আমার বন্ধুরা তত দিনে টোফেল-জিআরই দিয়ে বিদেশে যাওয়ার জন্য পুরোদমে প্রস্তুত হয়ে আছে। পাস করেই অনেকে দেশে বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরিও পেয়ে গেছে। আমি সেসবের জন্য চেষ্টাও করিনি। আমাদের ডিপার্টমেন্টে সাধারণত প্রতি ব্যাচ থেকে আট থেকে দশজন শিক্ষক হিসেবে নেয়, তাই ধরেই নিয়েছিলাম আমারও হবে, কিন্তু বিধি বাম।

বুয়েটের ইসিই ভবন। সংগৃহীত
বুয়েটের ইসিই ভবন। সংগৃহীত

আমি এর মধ্যে চলে গিয়েছি আমাদের গ্রামের বাড়িতে, মায়ের সঙ্গে কিছুদিন সময় কাটাব বলে। ভাবছিলাম মাকে দেখে বাড়ি থেকে ঘুরে এসে অন্য কোথাও চাকরির জন্য চেষ্টা করব। সেদিন কোনো এক গ্রীষ্মের দিনে পড়ন্ত এক অলস বিকেলে আমাদের বাড়ির পুকুর পাড়ে বসে আমরা চাচাতো ভাইবোনেরা মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এর মধ্যে আমার মোবাইল ফোন বেজে ওঠে, আমার খুব কাছের এক বন্ধুর ফোন। সে বলল, কিরে তোদের ডিপার্টমেন্টে তো আটজন নিয়োগ দিয়েছে, তুই জয়েন করেছিস নাকি? আমি হতচকিত হয়ে গেলাম, কেমন যেন হিসাব মিলাতে পারলাম না!
ঢাকায় ফিরে এসে যা জানলাম তাতে শুধু হতাশই হয়েছি। এ বিষয় নিয়ে কী কথা বলব, কার সঙ্গে কথা বলব। আমরা তো রাস্তার পাশের নুড়িপাথর, আমাদের তো কোনো মামা-চাচা নাই গো! পুরো বিষয়টাতে আমিই যেন অপ্রস্তুত হলাম। এটা নিয়ে কথা বলতেও বিব্রতবোধ হতো। আমার বড় ভাই লন্ডন থেকে ফোন করে একটিই কথা বললেন, ওনার কথাটি আজও আমার কানে বাজে, ডু নট স্টপ, দিস ইস নট দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড। যে কোনো পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধরে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা, সামনে এগিয়ে যাওয়া, আমার বাবার কাছ থেকে শিখেছি। আমি তাই থামিনি, থেমে যাওয়া অথবা দমে যাওয়ার অভ্যাস আমাদের মতো মানুষদের থাকতে নেই যে। যা ঘটেছে তা পেছনে ফেলে ধৈর্যকে সঙ্গী করে অজানা আগামীর পথ ধরেই হেঁটেছি।
আমার স্বভাবে এক অদ্ভুত ধরনের সমস্যা আছে। কেউ যদি আমার কোনো ক্ষতি করে, কোনো দোষ করে অথবা আমাকে আঘাত করে, ইঙ্গিত করে কিছু বলে, সেটা জেনে অথবা না জেনেই করুক না কেন, আমি মুখের ওপরে সেটা নিয়ে কথা বলতে পারি না। মনে হয় যদি সেই ব্যক্তি আমার কথায় অপ্রস্তুত হন, যদি আমার কথায় মনের মধ্যে আঘাত পান। আমি তাই ভুলে যাই, সেসব পেছনে ফেলে সামনের দিকেই শুধু তাকাতে চাই। এটা আমার চরিত্রের এক ধরনের দুর্বলতা। তাই যা ঘটেছে আমি আর এ বিষয় নিয়ে কথা বলিনি, আমি ইতিমধ্যে আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে জয়েন করে ফেলেছি। সেখানে বুয়েটের আরও অনেক সিনিয়র ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষক হিসেবে ছিলেন। আমাদের অফিস স্পেস যেন একটি ছোট্ট বুয়েট। সময় কেটে যাচ্ছিল শত ব্যস্ততায় নতুন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। বুয়েটের বাইরের ছাত্রছাত্রীদের খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ এর আগে আমার আর হয়নি।
এর মাস ছয়েকের মধ্যে বুয়েটে আমার যে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ডিপার্টমেন্টের প্রধান হয়ে আসেন, তিনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন, খায়ের সাহেব, আপনাকেও নিয়োগ দেওয়া হবে। আহসানউল্লায় মাস দশেক চাকরি করেছি। তার মধ্যে সরকারি চাকরির এম্বারগো শিথিল হলে বুয়েটে আমাদের ডিপার্টমেন্টে জয়েন করে ফিরে আসি। স্যার যদি ওই সময়ে ডিপার্টমেন্ট প্রধান না হতেন তাহলে আমার বুয়েটে মাস্টার হিসেবে কোনো দিন জয়েন করা হয়তো হতোই না। ডিপার্টমেন্টে প্রথমে লেকচারার হিসেবে জয়েন করি, তারপর মাস্টার্স শেষ করি। বিদেশে আসবার আগে প্রায় আড়াই বছর চাকরি করেছি, তারপর সহকারী অধ্যাপক পদে উন্নীত হয়ে পিএইচডি করতে চলে আসি।
জীবন আজ গিয়েছে চলে বহু দূরের পথ, এক দশকের পারাপার। তবু মানুষের জীবনে কিছু কিছু বিষয়, কোনো কোনো ঘটনা, কিছু কিছু স্মৃতি এমন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সময়ের নিরন্তর স্রোতের বিপরীতে বিস্মৃতির আড়ালে। জীবন নদীর সংকীর্ণ পাড়ে দাঁড়িয়ে চিরস্থির সেই সব স্মৃতির পানে ঝাপসা দৃষ্টিতে কেবল তাকানোই যায়। সেই সব স্মৃতির চির বহমান তরঙ্গ শুধু ছুঁয়ে দিয়ে যায় বর্তমান। অতীতের সেই অনুভবে কেবল ফালি ফালি ক্ষত।

লেখক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত।

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: