একান্ত একান্তে হুমায়ূন আহমেদ

একান্ত আড্ডায় হুমায়ূন আহমেদকে জাদু দেখাচ্ছেন লেখক
একান্ত আড্ডায় হুমায়ূন আহমেদকে জাদু দেখাচ্ছেন লেখক

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হ‌ুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় যতটা মনে পড়ে ১৯৯০ সালে কাকরাইলের এক চায়নিজ রেস্টুরেন্টে। আমার অনুজপ্রতিম জাদুশিল্পী বন্ধু জাহাঙ্গীর (বর্তমানে ফ্রান্সে স্থায়ীভাবে বসবাসরত) হ‌ুমায়ূন আহমেদকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য ওই চায়নিজ রেস্টুরেন্টে বহুসংখ্যক জাদুশিল্পী ও ভক্তকে আমন্ত্রণ করেছিলেন। আমি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার পর অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করার জন্য জাহাঙ্গীর আমাকে সবিনয় অনুরোধ করলে আমি রাজি হতে বাধ্য হই। অনুষ্ঠান শেষে উদার মনের এই মানুষটি আমাকে তাঁর কাছে ডেকে বসিয়ে বললেন, ‘আপনার উপস্থাপনা আমার ভালো লেগেছে, বাসায় আসবেন, আড্ডা হবে।’ আমার জবাব ছিল, অবশ্যই আসব। তখন তিনি স্ত্রী গুলতেকিন ও সন্তানদের নিয়ে এলিফ্যান্ট রোডে একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন।
হ‌ুমায়ূন আহমেদের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখালেখি হলেও একটি বিষয় সংবাদপত্রে না আসায় তা থেকে পাঠক সমাজ তথা ভক্তবৃন্দ বঞ্চিত রয়ে গেছেন বলে আমার ধারণা। আর তা হলো বহুমাত্রিক প্রতিভাধর হ‌ুমায়ূন আহমেদ ছিলেন একজন যশোবন্ত জাদুশিল্পী।

এক বিকেলে প্রথম তাঁর বাসায় পৌঁছানোর পর আমাকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁর বৈঠকঘরে বসালেন। দুজন পাশাপাশি বসলাম। বসার ঘরে চেয়ার-টেবিলের বালাই নেই। এক পাশে একটি কম্পিউটার। মেঝের সবটাই মোটা গদি ও চাদরে ঢাকা, আড্ডার জন্য সদাপ্রস্তুত। হ‌ুমায়ূন আহমেদ একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছেন আর আমার সঙ্গে কথা বলে চলেছেন। হঠাৎ তাঁর দুই মেয়ে শিলা ও বিপাশাকে ডাকলেন এবং আমাকে জাদুকর হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আর আমাকে বললেন, জলিল ম্যাজিক দেখান না। আমি ম্যাজিক দেখালাম। প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য ছিলাম কি না জানি না কিন্তু তিনি প্রশংসা করলেন এবং আবার কবে তাঁর বাসায় যাব তা জানতে চাইলেন। বললাম, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আসব। হ‌ুমায়ূন আহমেদ বললেন, ম্যাজিক নিয়ে আসবেন। আমি বললাম, আচ্ছা, কিন্তু আপনি তো দেখছি ম্যাজিশিয়ানদের মতো আবদার করছেন (তখনো আমি জানি না উনি একজন গুণী ম্যাজিশিয়ান)। হুমায়ূন আহমেদ রহস্যময়ভাবে মুচকি হাসলেন।
মহান এই মানুষটির আমন্ত্রণে আমি এক বিশেষ আকর্ষণে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তাঁর বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। আবার দুজনের আন্তরিক আড্ডা। এই আড্ডায় বহুগুণে গুণান্বিত এই উদার মনের মানুষটি বললেন, তিনি বহু বছর যাবৎ জাদু চর্চা করেন এবং জাদুশিল্পের প্রতি রয়েছে তাঁর গভীর মমতা। হ‌ুমায়ূন আহমেদ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি পামিং করেন? বলেই তিনি কয়েন পাম করে দেখালেন ও জিজ্ঞেস করলেন, হচ্ছে? আমি বললাম, নিখুঁত। পামিং হচ্ছে হাতের তালুতে বা আঙুলের ফাঁকে বিশেষ কায়দায় কয়েন, সিগারেট বা তাস লুকিয়ে রেখে দর্শকদের হাত খালি দেখিয়ে ওই লুকানো কয়েন, সিগারেট বা তাস বের করে দেখানো। এটা করার জন্য প্রয়োজন হয় বছরের পর বছর একনিষ্ঠ সাধনা। তখনই বুঝতে পারলাম, তিনি কত বড় মাপের একজন জাদুশিল্পী।
হ‌ুমায়ূন আহমেদ বললেন, তাঁর সংগ্রহে রয়েছে প্রচুর ম্যাজিকের বই ও বৈঠকি ম্যাজিক। এরপর তিনি নিয়ে আসলেন একটি বক্স। সেখান থেকে কিছু ম্যাজিক বের করে বললেন, এগুলোর কৌশল আমি ভুলে গেছি, আপনার জানা থাকলে বলবেন কি? আমি দেখিয়ে দিলাম। উনি বললেন, অসংখ্য ধন্যবাদ।
হ‌ুমায়ূন আহমেদ আমার কাছে উন্নত ম্যাজিকের বই আছে কি না জানতে চাইলে আমি তাঁকে বললাম, পরবর্তীতে নিয়ে আসব। অন্য একদিন তাঁর জন্য Foo Can নামের একটি Club/Stage magic ও Tatbel Course of magic নামের একটি উন্নতমানের বই তাঁর হাতে তুলে দিলাম। তখন লক্ষ্য করলাম তাঁর মুখ ভরা হাসি। তাঁকে দেওয়া সেই Foo Can বইটি এখন কোথায় কীভাবে আছে জানি না। কিন্তু তাঁর সেই হাসি এখনো আমার চোখে ভাসে আর চোখে অশ্রুও আসে।
একদিন লেখক অত্যন্ত আবদার করে আন্তরিকতার সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট দিনে আমাকে তাঁর বাসায় উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করলেন। বললেন, উনি একটি ছবি বানাতে যাচ্ছেন, নাম আগুনের পরশমণি। যে ধরনের বাড়িতে শুটিং হবে তাঁর মডেলসহ বহু শিল্পীর উপস্থিতিতে আলোচনা ও নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছে। আমি যাতে কিছু ম্যাজিক নিয়ে আসি। কথা দিলাম, আসব।
নির্দিষ্ট দিনে উপস্থিত হলাম। আসাদুজ্জামান নূরসহ অনেকে সেদিন উপস্থিত ছিলেন। সকলের সঙ্গে আমাকে জাদুশিল্পী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাকে ম্যাজিক প্রদর্শন করার অনুরোধ করে বললেন, আপনার যদি সহকারী প্রয়োজন হয় শিলা ও বিপাশাকে নিতে পারেন। ওরা নাটক করে, ওদের দুই-তিনবার কী করতে হবে বুঝিয়ে দিলে ওরা বুঝতে পারবে তাদের কী করতে হবে। আমি শিলা ও বিপাশাকে ওই দিন সহকারী হিসেবে আমার সঙ্গে রাখলাম। শিলা ও বিপাশা সেদিন বেশ উৎফুল্ল ছিল ম্যাজিকের কাজে যুক্ত হতে পেরে।
হ‌ুমায়ূন আহমেদের জাদুবিদ্যায় হাতেখড়ি হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। তখন তিনি ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছেন। পথের ধারে জাদু প্রদর্শনকারী এক হকারের কাছে তাঁর জাদুশিল্পে হাতেখড়ি। জাদুশিল্পটি তাঁর ভালো লেগে যায় সেদিনই। আর তাই পড়ালেখার পাশাপাশি অবসরে গুণী এই মানুষটি জাদুর তালিম নিতে চলে যেতেন হাতিরপুলে, যেখানে ওই হকার ম্যাজিশিয়ান থাকতেন সেখানে। হ‌ুমায়ূন আহমেদ হকারের কাছ থেকে রপ্ত করা জাদু বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের দেখিয়ে অবাক করে দিতেন। এরপর এই শিল্পে উন্নতি করার জন্য দেশ-বিদেশের উন্নত মানের বই সংগ্রহ ও পড়া শুরু করেন। পাশাপাশি চালিয়ে যান নিরলস অধ্যবসায়।
তাঁর ভক্তরা জেনে অবাক হবেন, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক জাদু সংগঠন International Brotherhood of Magicians-এর সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে জাদু প্রদর্শন করে তিনি যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। এ ছাড়া খুদে গানরাজ অনুষ্ঠানে বিচারক হিসেবে উপস্থিত থেকে একপর্যায়ে জাদু প্রদর্শন করেছেন। একান্ত আড্ডায় বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ম্যাজিক দেখিয়েছেন তিনি, যার মধ্যে ভারতের লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অন্যতম। বহুব্রীহি নাটকে একজন ম্যাজিশিয়ানের চরিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে জাদুর প্রতি যে তাঁর বিশেষ দুর্বলতা আছে তা প্রকাশ পায়। একসময় তিনি প্লানচেট করে মৃত ব্যক্তির আত্মা এনে কথোপকথনের চেষ্টাও করতেন।
তাঁর সঙ্গে একান্ত অনেক আড্ডা দিয়েছি। স্মৃতিপটে জমে আছে বহু স্মৃতি যা এই লেখায় শেষ করা অসম্ভব। কাছ থেকে দেখেছি হ‌ুমায়ূন আহমেদ বাচ্চাদের অনেক পছন্দ করতেন। সিগারেটের সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। ছিলেন ভোজনরসিক। হৃদয়টা ছিল অনেক বড়, অন্যের দুঃখে কাতর হয়ে পড়তেন সহজেই।
নন্দিত কথাসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র পরিচালক এই গুণী মানুষটি ১৯ জুলাই ২০১২ তারিখে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসারত অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রে মারা যান। দেশ-বিদেশের অগণন ভক্ত তাঁর মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান। ২০ জুলাই ২০১২ তারিখ ভোরে (প্রথম রোজা) ফজরের নামাজ শেষে কম্পিউটারে অনলাইন পত্রিকা ও ফেসবুক থেকে আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষটির মৃত্যুসংবাদে আমি প্রচণ্ডভাবে মানসিক আঘাত পাই।
টেরি ফক্সের পথ ধরে হ‌ুমায়ূন আহমেদ ঘোষণা দিয়েছিলেন ক্যানসার চিকিৎসার শেষে বঙ্গোপসাগরে পা ভিজিয়ে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া যাবেন দেশে একটি ক্যানসার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। দেশ-বিদেশের অগণিত ভক্তদের কাছ থেকে সাড়াও পেয়েছিলেন। কিন্তু মরণব্যাধি ক্যানসার তুলে নিল তাঁকে, চলে গেলেন অন্য ভুবনে। হলো না পা ভেজানো। বাংলা ভিজছে আজ চোখের জলে। এই মহান মানুষটির শেষ স্বপ্ন ছিল একটি ক্যানসার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা। আমি আশা করি, সরকার এগিয়ে আসবে তাঁর স্বপ্ন পূরণে, প্রতিষ্ঠা করবে একটি ক্যানসার হাসপাতাল। আর তাঁর নামে এই হাসপাতালের নাম হতে পারে হ‌ুমায়ূন ক্যানসার হাসপাতাল।
টেরি ফক্স ছিলেন এক কানাডীয় যুবক। মাত্র বাইশ বছর বয়সে ভয়াবহ ক্যানসার তাঁকে আক্রমণ করল। তাঁর একটি পা কেটে ফেলে দিতে হয়। ওই অবস্থায় বিছানায় শুয়ে টেরি ফক্স ভাবলেন, ক্যানসার গবেষণার জন্য অর্থ প্রয়োজন। তিনি ঘোষণা করলেন, এক পা নিয়েই কানাডার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত দৌড়ে ক্যানসার গবেষণার জন্য অর্থ সংগ্রহ করবেন। আটলান্টিক সাগরে পা ডুবিয়ে টেরি ফক্স দৌড় শুরু করলেন। তত দিনে একটি নকল পা লাগানো হয়েছে। ১৪৩ দিন নকল পায়ে দৌড়ে ৩,৩৩১ মাইল অতিক্রম করে তাঁকে থামতে হলো। কারণ, ক্যানসার তত দিনে ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়েছে। মাত্র তেইশ বছর বয়সে যখন তাঁর মৃত্যু হয়, তখন ক্যানসার গবেষণার জন্য তিনি ১০০ মিলিয়ন ডলার রেখে যান।