ভালোবাসায় মোড়ানো ঝাঁজালো আলোচনা

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

এই কই তুই? রান্নাঘর থেকে বউয়ের চিৎকার।
বেডরুমে শুয়ে আইপিএলের খেলা দেখছিলাম। তাড়াতাড়ি উঠেই দিলাম দৌড়।
তোর সমস্যা কি? সামনে দাঁড়াতেই চিৎকার করে বলে উঠল।
আমি আবার কি করলাম। নরম গলায় উত্তর দিলাম।
আমি কি এই সংসারে শুধু গাধার মতো কাজই করে যাব।
বুঝলাম না সমস্যা কি। কিন্তু এটা বুঝলাম যে, আজ ঘরের আবহাওয়া ভালো যাবে না। কিছু শ্রুতিমধুর (!) বাক্য শোনার জন্য কান ও মনকে বললাম তৈরি হতে। আমরা দুজনে সহপাঠী হওয়ার কারণে একে অপরকে তুই বলে সম্বোধন করি। এতে একটা লাভ হয়েছে। সাধারণত মানুষ রেগে গেলে বা ঝগড়ার সময় তুই করে বলেই অন্যকে ছোট করতে বা অপমান করতে চায়। কিন্তু আমার বেলায় আমার বউ সেই সুযোগ পায় না। আহা কী শান্তি।
প্রশ্নই আসে না। কেন, কি হইছে? উত্তর দিলাম।
কেন বুঝিস না?
বুঝলে তো আর প্রশ্ন করে তোর মূল্যবান সময় নষ্ট করতাম না।
আমার সঙ্গে চালাকি করবি না।
মাথা খারাপ, তোর সঙ্গে চালাকি? কি করে সম্ভব?
ন্যাকামো করবি না। তুই কি নবাবের বংশধর?

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আমার তা মনে হয় না। আর এ ধরনের কোনো তথ্য আমার জানা নাই। আর হলেতো তুই অবশ্যই জানতি। কারণ তা হলে তো তোকে রানিমা হিসেবেই ডাকা হতো। আর তা ছাড়া আমি যদি সিরাজ-উদ-দৌলা আংকেলের কিছু হতাম, তাহলে তো আমার নাম ইমদাদ হোসেন না হয়ে ইমদাদ-উদ-দৌলা হতো। শেষ পয়েন্ট, একটু আগে আমি নাশতা করেছি পরোটা, ডিম ও সবজি ভাজি দিয়ে। যদি নবাব হতাম তাহলে মোগলাই পরোটা ও কাবাব খেতাম। তুই চাইলে আমি আরও কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে তোকে প্রমাণ করে দিতে পারব যে আমি নবাবের বংশধর নই। আসলে সেই মুহূর্তে আমি ঝগড়া করার মুডে নেই। তাই পরিবেশটা হালকা করার চেষ্টা করছি। যাতে ঝগড়া এড়ানো যায়। কারণ আমি মোস্তাফিজের বোলিংটা মিস করতে চাচ্ছি না।
এই তুই কি গোপাল ভাঁড় হইছিস? আমার সঙ্গে ফাজলামি করিস।
শোন একবার বলছিস নবাব, আবার বলছিস গোপাল ভাঁড়। আমি কে, তুই তো দেখি এইটা নিয়েই কনফিউজড। আগে সিদ্ধান্ত নে আমি কে, তারপর আয় ঝগড়া করি।

তুই নবাবের মতো নাশতা খেয়ে উঠে গেলি, তোর প্লেট ধোবে কে?
মনে মনে বললাম, যাক বাবা ছোট বিষয়, আশা করছি দ্রুত শেষ করা যাবে।
যেহেতু এটা আমেরিকা, নিয়ম অনুযায়ী আমারই ধোয়ার কথা। কিন্তু.... ?
আমার উত্তর বউ বলল, কিন্তু কি?
ভাবলাম এই সপ্তাহে যেহেতু আমাদের বিবাহবার্ষিকী, সেহেতু এই এক সপ্তাহ একটু বাংলাদেশি স্বামী তো হতেই পারি, পারি না?
স্বা-মী? স্বামী কাকে বলে জানিস?
কেন জানব না? কোনো মেয়েকে যে ছেলে বিয়ে করে তাকেই স্বামী বলে।
তোর মতো ছোটলোকের কাছ থেকে আমি এর থেকে ভালো উত্তর আশা করিনি।
উত্তেজিত হওয়ার তো কিছু নাই। উত্তর যদি সঠিক না হয়, বলে দে।
স্বামীর কোন দায়িত্বটা তুই পালন করছিস।
সব দায়িত্বই পালন করছি। তুই চাইলে আমি এক এক করে পয়েন্ট আকারে সবগুলি ব্যাখ্যা করতে পারি।
বল না শুনি। বল, চুপ করে আছিস কেন?
সমস্যায় পড়ে গেলাম। ঝগড়ার সময় আমার কোনো পয়েন্টই মাথায় আসে না। স্বাভাবিক সময় যখন ঝগড়া থাকে না, তখন কত পয়েন্ট মাথায় আসে। মনের মাঝে সব সাজিয়ে রাখি, ঝগড়া লাগলেই এগুলো প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু ঝগড়ার সময় একটাও খুঁজে পাই না। যে দু-একটা মনে আসে, সেটাকেও মনে হয় ঝগড়ার বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়। অথচ ওর সব পয়েন্ট তৈরি করাই থাকে। হয়তো যে পয়েন্টটা আমি মনে করেছি এই ঝগড়ার বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়, সেটাকেও এমন সুন্দরভাবে প্রয়োগ করবে, মনে হবে এর থেকে প্রাসঙ্গিক বিষয় এই দুনিয়াতেও নেই। কোথা থেকে যে বের করে এক একটা তীর ছুড়ে মারে আল্লাহ মালুম! সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে ১৫-২০ বছর আগের কোনো বাক্য, কথা বা ঘটনা হুবহু মেরে দিচ্ছে। হয়তো ওই বিষয়ের কোনো কিছুই আমার মনে নেই। যার কারণে কখনো আমার ঝগড়ায় জেতা হয় না। আমার ধারণা আল্লাহ মেয়েদের মাথায় ঝগড়া বিষয়ক কোনো স্পেশাল চিপ বা অ্যাপস ঢুকিয়ে দিয়েছে। যা ছেলেদের দেয়নি।
কেন বিয়ের সময় কবুল বলেছি না? এই পয়েন্টই মাথায় এল। আমার উত্তর শুনে বিস্মিত নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। বুঝলাম বোকার মতো উত্তর হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি আরেকটা পয়েন্ট বের করলাম। আমি ইনকাম করে সংসারের খরচ চালাই।
ছোটলোক তুই আমায় টাকার খোঁটা দিস। তোর এত বড় সাহস। তুই জানিস না, আমি কোনো ফ্যামিলির মেয়ে?
বুঝলাম ধরা খেয়ে গেছি। ভেবেছিলাম বিষয়টা তাড়াতাড়ি শেষ করে খেলা দেখব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার খেলা দেখা আজ আর হবে না। কারণ ভুল পয়েন্ট বলে ফেলেছি। কিন্তু গুলিতো আর ফেরত নেওয়া যাবে না। আত্মসমর্পণই এখন একমাত্র পথ।
ভাইরে আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি এইভাবে বলতে চাইনি। কোনো কিছু মিন করেও বলিনি। কোনো পয়েন্ট না পেয়ে, যেটা মনে আসছে ছাইড়া দিছি।
এখন বুঝছিস তো স্বামীর কোনো দায়িত্বই তুই পালন করিস না। আর করিস না বলেই কোনো পয়েন্ট খুঁজে পাস না।
চুপ করে থাকি। কারণ এটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কী বলতে আবার কী বলে ফেলব। কিন্তু আমার মুখ বন্ধ হলে কী হবে, গিন্নির মুখ তো চলমান।
সংসারের একটা কাজও তুই করিস না। রান্না, বাজার, বাচ্চা স্কুলে নেওয়া সব কাজ কেন একা আমাকে করতে হবে।
এর জন্য তুই দায়ী।
আমি দায়ী মানে? চিৎকার করে উঠল।
চিৎকার করিস না। আয় আমরা ঝগড়ার মুডে কথা না বলে, আলোচনার মুডে কথা বলি। সব সময় ঝগড়া করা ভালো না।
কি আমি সব সময় ঝগড়া করি? আমি ঝগড়াটে? ছোটলোক তোর এত বড় সাহস...।
বুঝলাম আজ আমার আইপিএল শেষ। মোস্তাফিজের না এখন বউয়ের আগুনঝরা বোলিং দেখতে হবে। হে মাবুদ আমারে এই বিপদ থেকে রক্ষা কর। কথায় আছে বান্দা বিপদে পড়লে আল্লাহই রক্ষা করে। বউয়ের মুখ থেকে যখন একের পর এক গোলা বের হচ্ছে, তখন হঠাৎ করে বাসার ল্যান্ডলাইন ফোন বেজে উঠল। মেয়ে স্কুল থেকে ফোন করেছে। বউ ফোন ধরে মেয়ের সঙ্গে মিষ্টি করে কথা বলা শুরু করল।
মা কি করো?
‘...।’ যেহেতু ও পাশের কথা শুনতে পারছি না তাই ডট ডট ডট দিলাম।
কিছু খেয়েছ?
‘...।’
তোমার আব্বু? বাসায়। টিভিতে খেলা দেখছে।
কী ডাহা মিথ্যা কথা। আমার খেলা দেখা বন্ধ করে, আমারে কাঁটা চামচ দিয়ে কেঁচতেছে। মনে হচ্ছে চিৎকার করে বলি, তোর মা মিথ্যা বলছে। আমারে বাঁচা। জানি এটা বলা সম্ভব না। তবে মনে মনে মেয়েকে ধন্যবাদ দিলাম, সময় মতো ফোন করার জন্য। বউ মেয়ের সঙ্গে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে। যাক আপাতত বাঁচা গেল। টিভির সামনে গিয়ে দেখি মোস্তাফিজের বোলিং শেষ। কপালটাই খারাপ।
বি. দ্র.: আমরা কিন্তু সব সময় ঝগড়া করি না। শুধুমাত্র যখন জেগে থাকি, তখন করি। টম অ্যান্ড জেরি, হা-হা-হা। আমাদের ঝগড়াগুলিকে আমি ঝগড়া বলি না। এগুলি আসলে ভালোবাসায় মোড়ানো একটু উচ্চ স্বরে ঝাঁজালো আলোচনা মাত্র।