আমারে তুমি অশেষ করেছ...

বরফে ডুবে যাওয়া বাসস্টপ
বরফে ডুবে যাওয়া বাসস্টপ

প্রতিদিন ঘুম ভেঙে প্রথম কি করা উচিত? আমি যখন স্বাভাবিক মানুষের মতো চিন্তা করি, তখন মনে হয়, আরেকটা নতুন দিন দেখার সুযোগ করে দেওয়ার ও রাতের ঘুমটাকে চির দীর্ঘায়িত না করার জন্য স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানানো দিনের প্রথম কাজ হওয়ার দাবি রাখে। কিন্তু যখন জানুয়ারির হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় ভোর পাঁচটায় আমার কর্কশ অ্যালার্ম বেজে ওঠে, তখন কিছু অশ্রাব্য গালিগালাজ ছাড়া মাথায় আর কিছু আসে না। নিজেকে বাছাই করা গালিগুলো দিতে দিতে আমি চোখ বন্ধ করেই হাঁটতে হাঁটতে ঘরের আরেক মাথায় টেবিলের কাছে যাই। নির্দয়ভাবে বাজতে থাকা অ্যালার্মটা বন্ধ করি দ্রুত হাতে। প্রতিদিনই মনে হয় ছুড়ে ফেলে দিই ঘড়িটাকে জানালা দিয়ে। কিন্তু ততক্ষণে আমার স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি একটু একটু করে কাজ করতে শুরু করে। আগামীকাল সকালে এই ঘড়ি ছাড়া যে আমার চলবে না, এটা আমার মনে পড়ে যায়। আমি রাগে ফুসতে ফুসতে বাথরুমে ঢুকি। পুরোপুরি রেডি হয়ে বাসস্টপে এসে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ছয়টা বেজে যায়।

বাসস্টপে এক হাঁটু বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকে এবার অভিশাপ দিতে থাকি। কানাডায় বসবাসের সিদ্ধান্তের জন্য অভিশাপ, বৃদ্ধ বয়সে আবার পড়ালেখা শুরু করার জন্য অভিশাপ এবং সবচে সিরিয়াসলি এই কলিজা জমিয়ে দেওয়া শীতে সকালে ক্লাস হয় এমন কোর্সে এনরোল করার জন্য অভিশাপ। প্রচণ্ড ঠান্ডা বাতাস আমার গালে ঠাস ঠাস চড় কষাতে থাকে। মনে হয় বুঝি মুখের চামড়া খুলে আসবে। আমার কপালে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়। যেন হিমশীতল ছুরি দিয়ে কেউ আমার কপালে পোঁচ দিচ্ছে অনবরত।
বাস আসে একসময়। উষ্ণ আরামদায়ক বাস। সকালে আর বিকেলে অসম্ভব ভিড় থাকে বাসে। দিনের অন্য সময়গুলোতে ৩০ মিনিট পর পর বাস এলেও সকাল-বিকেলের ব্যস্ত সময়গুলোতে ১৫ মিনিট পর পর একেকটা বাস আসে। যদিও এ সময় বসার সুযোগ পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার। তারপরও বেশিক্ষণ যে ঠান্ডার চোটপাট সহ্য করতে হয়ে না, তাইই বা কম কী! কিন্তু তবুও আমার রাগ কমে না। বাসে উঠে আমি কোনোরকমে ঠেলাঠেলি করে দাঁড়ানোর জায়গা করে নিয়ে আশপাশে সবার দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকাতে থাকি। যেন, এই সাত সকালে, মাইনাস তিরিশের কাছাকাছি এই অসহ্য ঠান্ডায় কম্ফর্টারের আরাম থেকে এরা সবাই ষড়যন্ত্র করে আমাকে টেনে বের করে এনেছে। আমার এই দুর্ভোগের জন্য যেন এরা প্রত্যেকে সমানভাবে দায়ী। বাসভর্তি মানুষ, কেউ অফিসে, কেউ স্কুল-কলেজে যাচ্ছে। আমি নিঃশব্দে জগৎ সংসারের সবার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করতে থাকি একমনে।
সকালবেলা যেহেতু খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে বাস আসতে থাকে, চালকেরা কারও প্রতি খুব একটা সহানুভূতি দেখান না। যতই জানপ্রাণ দিয়ে দৌড়ানো হোক বাসের পেছন পেছন, কিংবা হাত নেড়ে, চিৎকার করে চালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হোক না কেন, একটু দেরি হলেই বাস মিস। এক দিন চালক দেখছি আরও এক কাঠি সরেস। চলন্ত বাসের পাশে পাশে দৌড়াতে থাকা একেকজন নীল আর্মস্ট্রংকে হাত নেড়ে টা টা দিচ্ছেন হাসিমুখে। নীল আর্মস্ট্রং শুনে অবাক হবেন না। উইন্টার জ্যাকেট, মুখ ঢাকা টুপি, গ্লাভস আর ভারী উইন্টার বুট পরা মানুষজনকে দেখলে মনে হয় একেকজন চাঁদে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হয়েছেন।
যাই হোক, ডাউন টাউনের কাছাকাছি এসে হঠাৎ করেই বাসের গতি কমে এল। রাস্তায় খুব বেশি গাড়ি তখনো নামেনি। আমি একটু অস্থির হয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম। কোনো অস্বাভাবিক কিছু দেখা গেল না। শুধু দেখলাম, একজন নারী ও পুরুষ হাত ধরাধরি করে দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছেন। ওরা রাস্তা পার হওয়ার পর বাস আবার একটু দ্রুতগতিতে কাছের স্টপে গিয়ে থামল। কেউ নামল না বাস থেকে, কাউকে উঠতেও দেখলাম না। বাসস্টপেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

অটোয়ায় শীতের সকাল। ইন্টারনেট থেকে নেওয়া
অটোয়ায় শীতের সকাল। ইন্টারনেট থেকে নেওয়া

আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি রীতিমতো উসখুস শুরু করলাম। তারপর জানালা দিয়ে দেখলাম, ওই দুজন দৌড়াতে দৌড়াতে বাসের কাছে আসছেন। রাগে আমার পিত্তি জ্বলে গেল। অন্য কারও জন্য তো এত আন্তরিকতা দেখি না চালকদের। আমি বর্ণবৈষম্যের গন্ধ পেতে থাকি। সাদা চালক, সাদা মানুষদের জন্য একটু বাড়তি খাতিরতো দেখাবেনই! আমি কতবার দু-এক সেকেন্ডের জন্য বাস মিস করেছি। কতবার দুই হাত নেড়ে, স্টপ, স্টপ চিৎকার করে চালকের করুণা ভিক্ষা করেছি। কই কোনো দিন তো কোনো লাভ হয়নি! রাগে, দুঃখে দু-এক দিন কেঁদেও ফেলেছি। আর আজকে এই দুজনের জন্য যে সবার দেরি হয়ে যাচ্ছে সেদিকে চালক ব্যাটার কোনো খবরই নেই। আয়নায় দেখা যাচ্ছে চালক বেশ হাস্যমুখী হয়ে বসে আছেন। আমি গজগজ করতে থাকি মনে মনে। দুজন এসে বাসে উঠলেন। ভিড়ের জন্য ভালো দেখতে পাচ্ছিলাম না তাদের। শুধু শুনতে পেলাম, একটি নারী কণ্ঠ।
অনেক ধন্যবাদ, আরেকটু হলেই আমার মিটিংটা মিস হয়ে যেত।
সেদিন বাসের লোকজনও মনে হচ্ছে খুব ভদ্র (নাকি বর্ণবাদী!)। সামনের সিটের দুজন সিট ছেড়ে পেছনে চলে এলেন তাদেরকে বসতে দিয়ে। আমি গ্যাট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমার জায়গায়। আমি একটুও নড়ব না যত যাই হোক। হতে পারে আমার চামড়া বাদামি, কিন্তু আমিও কানাডীয়, হাহ! বাস চলতে শুরু করল। এখানে বাসে এমনিতেও লোকজন বেশি কথা বলে না। আর সকাল সকাল বোধকরি কারওই বেশি কথা বলার মেজাজ থাকে না।
নীরবতার মধ্যে হঠাৎই বেশ জোরে নারী হাস্য শুনতে পেলাম। এবার একটু ফাঁক ফোকর দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। সামনের লম্বালম্বি সিটে বসে থাকা সেই নারী আবারও ঝনঝন করে হেসে উঠলেন। পাশাপাশি বসে আছেন দুজন। পোশাকআশাকে বোঝা যাচ্ছে দুজনই অফিসযাত্রী। নারী-পুরুষ বললে যেমন ভারিক্কি, বয়স্ক মানুষের ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে তারা মোটেও তা নয়। অল্পবয়সী ঝকঝকে তরুণ তরুণী। ছেলেটি হাসিমুখে, নিচু গলায় কিছু বলছে মেয়েটিকে, মেয়েটি হাসি সামলানোর চেষ্টা করছে আর না পেরে সশব্দে হেসে উঠছে।
চমৎকার একটা দৃশ্য। কিন্তু কোথায় যেন একটা অস্বাভাবিকতা আছে! কী যেন নেই, অথবা কী যেন আছে ঠিক ধরতে পারছি না। একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বুঝলাম, দুজনই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। হয়তো একেবারেই অন্ধ অথবা খুবই ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তির দুজন মানুষ। আমি একটু গলা উঁচু করে দেখলাম দুজনের হাতেই দুটি সাদা ছড়ি। ওদের দৌড়ে রাস্তা পার হওয়া, ধোপদুরস্ত পোশাকে অফিসে যাওয়া আর ওই যে ঝনঝন করে হেসে ওঠা...কে বলবে ওরা কারও চেয়ে কম! কে বলবে ওদের চোখজুড়ে অন্ধকার। এত আনন্দ কীসের ওদের?
আমার অবাক লাগে। এই মাইনাস তিরিশের হাড় জমে যাওয়া ঠান্ডায় সাত সকালে ছুটে এসে বাস ধরার, অফিসে যাওয়ার বিরক্তি ওদের স্পর্শ করে না কেন? কেন যেন খুব সূক্ষ্ম অথচ তীব্র গ্লানিবোধ করতে থাকি, ঠিক ধরতে পারি না। মেয়েটি আবারও খিল খিল করে হেসে ওঠে। বাস এসে থামে একটা স্টপে। লাইট জ্বলে ওঠে বাসের ভেতরে। জানালার কাচে আমি পরিষ্কার দেখতে পাই নিজেকে। প্রচণ্ড বিরক্তির ভঙ্গিতে আমার মুখের রেখাগুলো স্থির হয়ে আছে। আমার খুব লজ্জা লাগতে থাকে। আমি প্রাণপণে আমার মুখের রেখাগুলোকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে থাকি।