সরবরাহ স্বাভাবিক হচ্ছেই না

পণ্য পরিবহন
পণ্য পরিবহন

টানা ১৭ দিনের (মাঝখানে দুটি শুক্রবার ছাড়া) অবরোধ-হরতালে ঝুঁকি নিয়ে ট্রাকমালিকেরা ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান বের করেননি। ফলে সারা দেশে খুবই সীমিত পরিসরে পণ্য পরিবহন হয়েছে। এতে ভেঙে পড়ে বিভিন্ন পণ্যের সরবরাহব্যবস্থা।
তবে গত শুক্র ও শনিবার সারা দেশে পণ্য পরিবহন হওয়ায় এই সরবরাহব্যবস্থায় কিছুটা গতি এসেছে। যদিও ভাড়া হয়ে গেছে দ্বিগুণ কিংবা তারও বেশি। এ অবস্থায় গত রোববার জামায়াতের হরতাল থাকায় সরবরাহব্যবস্থা ফের বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আর আজ থেকে আবার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করায় সরবরাহ ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা আরো বাড়লো।
ট্রাকমালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, হরতালে একসময় নিত্যপণ্যবাহী ট্রাক ছেড়ে দেওয়া হলেও এখন পণ্যবোঝাই ট্রাক পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর আগের কোনো অবরোধই এবারের মতো সহিংস ছিল না।
এসব কারণে হরতাল-অবরোধ চলাকালে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পণ্য পাঠাতে যেমন দ্বিধায় থাকেন মোকাম ব্যবসায়ী ও আড়তদারেরা, তেমনি অনেক ট্রাকমালিকই এ অবস্থায় পরিবহন করতেও সাহস দেখান না। যেসব ট্রাকমালিক পণ্য পরিবহনে আগ্রহী হন, তাঁরা নেন দ্বিগুণ কিংবা তিন গুণ ভাড়া।
বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানমালিক সমিতির হিসাবে, সারা দেশে পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্যাংকলরি এবং পিকআপ আছে এক লাখের মতো। গত এক মাসে সারা দেশে এক হাজার গাড়ি অগ্নিকাণ্ড এবং ভাঙচুরের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৪০০ গাড়ি আংশিক কিংবা পুরোপুরি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ৬০০ গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। এসব গাড়ির প্রতিটির দাম গড়ে ৩০-৩৫ লাখ টাকা। প্রতিদিন সবচেয়ে বেশি ২৫ হাজার পণ্যবাহী যান চলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। স্বাভাবিক সময়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ট্রাক ভাড়া ১৫-২০ হাজার টাকা হলেও বর্তমানে নেওয়া হচ্ছে অন্তত ৪০ হাজার টাকা।
এরপর ঢাকা-বেনাপোল পথে চলাচল করে সাত থেকে ১০ হাজার এবং উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে পণ্য আনা-নেওয়া করে ১০-১২ হাজার যান। বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে পচনশীল পণ্যসহ শিল্পের কাঁচামালের একটি বড় অংশই আমদানি হয়। অবরোধে বন্ধ থাকার পর শুক্র ও শনিবার আবার চালু হয়েছে।
তেজগাঁওয়ে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানমালিকদের দুটি সংগঠনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত শুক্রবার সারা দিনই ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে পণ্য পরিবহনের ভাড়া ছিল ৫০-৬০ হাজার টাকা। অবশ্য সন্ধ্যার দিকে কমে তা ৪০ হাজার টাকা হয়।
ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, এক মাসের মধ্যে যদি ২০ দিনই বসে থাকতে হয়, বেশি ভাড়া নেওয়া ছাড়া গতি নেই। কারণ, নিরাপত্তাহীনতা। ট্রাকমালিকেরা যেমন দামি গাড়িটার কথা চিন্তা করেন, তেমনি চালকেরাও চিন্তা করেন নিজের জীবনের কথা। বেশি পয়সা ছাড়া অনেক চালক গাড়ি চালাতেই আগ্রহী নন। গত ৬ ডিসেম্বর ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে ভাড়া এক লাখ টাকায় উঠেছিল বলে তিনি জানান।
বছরের এই সময়টায় শীতকালীন সবজিতে বাজার ভর্তি হয়ে যায়। কম দামে সবজি বিক্রি হয় বাজারে। এ বছরও সে রকমই আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু টানা অবরোধ বাজারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। কারণ, সারা দেশ থেকে ঢাকায় আসতে পারছে না সবজি। কৃষকদেরও মাথায় হাত। সবজি নষ্ট হচ্ছে খেতেই। রংপুর-ঢাকা পথের সবজি আনার ট্রাকভাড়া ১৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার, দিনাজপুর-ঢাকা পথের ভাড়া ২০ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা।
ট্রাকমালিক ও বেনাপোল বন্দরকেন্দ্রিক আমদানিকারকেরা জানান, স্বাভাবিক সময়ে বেনাপোল থেকে পণ্য পরিবহনের ভাড়া ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। কিন্তু এখন পণ্য পরিবহন হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায়।
বেনাপোলের এইচআরটি ট্রান্সপোর্টের স্বত্বাধিকারী মিকাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাস্তায় নামালেই ট্রাক ভাঙচুর করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভাঙচুরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।’
ভারতের নাসিকের পেঁয়াজ দেশে আমদানি করতে খরচ পড়ছে মাত্র ৩০ টাকা। সেই পেঁয়াজ পাইকারি বাজারে ৮০ এবং খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৯০-৯৫ টাকায়। কারণ, ঢাকায় পেঁয়াজ আসতে পারছে না।
শ্যামবাজারের আমদানিকারক ও পপুলার বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী রতন সাহা প্রথম আলোকে বলেন, শুক্রবার যে পেঁয়াজ এসেছে, তা ঘাটতি পূরণ করার মতো না। পেঁয়াজ দরকার ১০০ গাড়ি, এসেছে ১০ গাড়ি। তিনি জানান, ভারতীয় পেঁয়াজ বেশি আমদানি হয় সাতক্ষীরার ভোমরা দিয়ে। আর সাতক্ষীরার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন। দিনাজপুরের হিলির সঙ্গেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। পেঁয়াজ আসছে কিছু চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ আর বেনাপোল দিয়ে।
নানা ধরনের ভোগ্যপণ্য প্রস্তুত ও বাজারজাত করে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। অবরোধে সারা দেশে পরিবেশকদের কাছে পণ্য পৌঁছাতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ৫০০-এর মতো ট্রাক প্রাণের পণ্য সারা দেশে নিয়ে যায়। অবরোধ-হরতালে কোনো ট্রাকই যায়নি।
দেশে প্রতিদিন ছয় হাজার টন চিনি, ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা-সুজি, ডাল ও হাঁস-মুরগির খাদ্য বাজারজাত করে থাকে সিটি গ্রুপ। এর মধ্যে তিন হাজার টন চিনি, এক হাজার টন করে ভোজ্যতেল ও হাঁস-মুরগির খাদ্য, ৫০০ টন করে আটা-ময়দা-সুজি ও ডাল। অবরোধ-হরতাল চলাকালে কোনো পণ্যই সরবরাহ হয়নি।