অনিশ্চয়তায় আগ্রহ হারাচ্ছে পোশাক ক্রেতারা

তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডের পর রানা প্লাজা ধস। স্মরণকালের বড় দুই শিল্প -দুর্ঘটনায় এক হাজার ২৪৫ শ্রমিকের মৃত্যু দেশের পোশাকশিল্পের ভিত নাড়িয়ে দেয়। সেই ক্ষত না শুকাতেই আবার রাজনৈতিক সহিংসতার খড়্গে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এই শিল্প খাত সংকটে পড়েছে। 
পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, টানা অবরোধে সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় কারখানার উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আবার উৎপাদন হলেও অনেক ক্ষেত্রেই সময়মতো পণ্য পাঠানো যাচ্ছে না। পুলিশি পাহারায় কিছু কাভার্ড ভ্যান বন্দরে গেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। অন্যদিকে সময়মতো পণ্য পাবেন কি না, সেই অনিশ্চয়তার কারণে ক্রেতারা কার্যাদেশ দেওয়া কমিয়ে দিয়েছেন।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতায় কেমন ক্ষতি হয়েছে, ইতিমধ্যে সদস্যদের কাছ থেকে সেই পরিসংখ্যান সংগ্রহ করেছে বিজিএমইএ। ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৬টি পোশাক কারখানা তথ্য দিয়েছে। তাতে দেখা যায়, কার্যাদেশ বাতিল, মূল্যছাড়, এয়ারফ্রেইট, জাহাজীকরণ দেরি ও নাশকতার কারণে কারখানাগুলোর প্রায় এক কোটি ৫০ লাখ ডলার ক্ষতি হয়েছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমেরিকার এক ক্রেতার সাড়ে তিন লাখ ডলার মূল্যের ৯৪ হাজার পিস পোশাক তৈরির কার্যাদেশ পায় ডিভাইন ফ্যাশন। এই পণ্য জাহাজীকরণের তারিখ ছিল গত ৩০ নভেম্বর। তবে অবরোধের কারণে শেষ পর্যন্ত দেড় লাখ ডলারের পণ্য সময়মতো বন্দরে পাঠাতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
আবার সম্প্রতি আমেরিকান ইগল পাঁচ লাখ পিস পোশাকের একটি কার্যাদেশ শেষ পর্যন্ত বাতিল করে ইন্দোনেশিয়ায় দিয়ে দিয়েছে। চলমান অস্থিরতার কারণে ওপেক্স গ্রুপ কাজটি পেয়েও শেষ পর্যন্ত করতে পারেনি। এ ছাড়া ল্যান্ড মার্ক গ্রুপের পাঁচ লাখ ৯২ হাজার ডলারের পণ্য সময়মতো পাঠাতে না পারায় আমেরিকার ক্রেতা ওই কার্যাদেশটি বাতিল করেন।
বিজিএমইএ জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে এক লাখ ৩২ হাজার টন পোশাক এয়ার শিপমেন্ট বা উড়োজাহাজে পাঠাতে হয়েছে। এ জন্য প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বেশি গুনতে হয়েছে উদ্যোক্তাদের। সংগঠনটির এক নেতা বলেন, জাহাজে পণ্য পাঠালে সেই খরচ বহন করেন ক্রেতা। কিন্তু সময়মতো পাঠাতে না পারলে বাধ্য হয়ে এয়ারফ্রেইট করতে হয়। আর এই খরচ পোশাক কারখানাকেই বহন করতে হয়।
আবার পুলিশি পাহারা দিয়ে কয়েক দিন ধরেই পোশাকবোঝাই কাভার্ড ভ্যান চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানো হয়েছে।
তবে রপ্তানিকারকেরা বলছেন, পুলিশ ব্যবস্থা নিলেও পরিস্থিতির তেমন একটা প্রভাব পড়ছে না। কারণ, এটি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তা ছাড়া অবরোধ থাকায় এমব্রয়ডারি, ডায়িং, ফিনিশিং ইত্যাদি কাজ অনেক প্রতিষ্ঠানই বাইরের অন্য কারখানা থেকে করাতে পারছে না। অন্যদিকে কাভার্ড ভ্যানের ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার ভাড়া বেড়ে হয়েছে এক লাখ টাকা।
বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান রপ্তানির পোশাক নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে যায়। কিন্তু অবরোধে পুলিশি পাহারা দিয়ে ৪০০ থেকে ৫০০ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। অবশ্য এক দিন সর্বোচ্চ এক হাজার ৬০০ ট্রাক বন্দরে নেওয়া হয়েছিল।
পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, বড়দিন সামনে রেখে ইউরোপ-আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানি হয়। জুন-জুলাই মাসে কার্যাদেশ আসে, পাঠাতে হয় নভেম্বরের শুরু থেকে। তবে রানা প্লাজা ধসের পর গতবারের চেয়ে এবার বড়দিনের কার্যাদেশ প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কম আসে। তিনি আরও বলেন, একে তো কার্যাদেশ কম এসেছে, তার ওপর অবরোধের কারণে অনেকেই সময়মতো পোশাক পাঠাতে পারেননি। ফলে অনেক উদ্যোক্তাকেই ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে।
বিজিএমইএর এই সহসভাপতি আরও জানান, এখন শরৎকালের (ফল) ক্রয়াদেশ আসার সময়। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পণ্য পাবে কি না, সেই অনিশ্চয়তায় অধিকাংশ ক্রেতা প্রতিষ্ঠানই অর্ডার কম দিচ্ছে। অনেকে আবার ভারত, ইন্দোনেশিয়াসহ অন্য প্রতিযোগী দেশে চলে যাচ্ছে। তবে কী পরিমাণ কার্যাদেশ কম আসছে, তা আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে বোঝা যাবে।
বিজিএমইএ এক হিসাবে বলেছে, হরতাল বা অবরোধে যদি গড়ে ৩০ শতাংশ উৎপাদন ব্যাহত হয়, তবে প্রতিদিন পোশাকশিল্পে প্রায় ১৪০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়। নভেম্বর থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪৪ দিনের ২৩ দিনই হরতাল ও অবরোধ ছিল। এই হিসাবে ইতিমধ্যে তিন হাজার ২২০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে।