নারীর কর্মহীনতায় ক্ষতি ৩ ট্রিলিয়ন ডলার

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে গত দুই দশকে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে। পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলে এ সময়ে এমন প্রবণতা দেখা যায়নি। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের এ বৈষম্য কমিয়ে আনতে পারলে সেটি এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার বা ৩ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ মূল্য যোগ করবে। এই অর্থ বাংলাদেশের চলতি অর্থবছরের বাজেটের ৮০ গুণ।

এমন তথ্য উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক শ্রম তহবিলের (আইএলও) ‘বিশ্ব কর্মসংস্থান ও সামাজিক অগ্রগতি প্রতিবেদন—নারীদের অবস্থান ২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্ব শ্রমবাজারে নারী-পুরুষের বৈষম্যের বিষয়টি এখন একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। বৈষম্য বৃদ্ধির ফলে নারীরা কাজ কম পাচ্ছেন। যেসব নারী কাজ পাচ্ছেন, তাঁরাও খুব মানসম্পন্ন কাজ পাচ্ছেন না। একই মানের কাজ করেও কর্মক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের তুলনায় কম পারিশ্রমিক পাচ্ছেন।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের পার্থক্য কিছুটা কমলেও দক্ষিণ এশিয়ায় চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। বিশ্বে মোট কর্মক্ষম পুরুষদের মধ্যে ৭৬ শতাংশ কাজ করেন। আর কর্মক্ষম নারীর ৪৯ শতাংশ এখন কর্মক্ষেত্রে যুক্ত আছেন। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্যের পার্থক্য ২৬ দশমিক ৭ শতাংশীয় পয়েন্ট। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় এ পার্থক্য প্রায় ৫১ শতাংশীয় পয়েন্ট। এই অঞ্চলে কর্মক্ষম নারীদের মাত্র ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ কাজ করেন। পুরুষদের ক্ষেত্রে এ হার ৭৯ দশমিক ৪ শতাংশ। পূর্ব এশিয়ায় নারীদের কাজের অবস্থা তুলনামূলকভাবে বেশ ভালো। এই অঞ্চলে কর্মক্ষম নারীদের ৬১ শতাংশই কাজ করেন, যা বিশ্বের সব অঞ্চলের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

অর্থনীতির আকারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ২০টি দেশের জোট জি-২০–এর ২০১৪ সালের এক সম্মেলনে বিশ্বনেতারা কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমিয়ে আনার বিষয়ে আলোচনা করেন। ওই বৈঠকে ২০২৫ সালের মধ্যে সারা বিশ্বের সব অঞ্চলে এ পার্থক্য ২৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়। এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হলে তা বিশ্ব অর্থনীতিতে বাড়তি ৫ লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলার যোগ করবে। এর মধ্যে শুধু এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের অর্থনীতিতে যোগ হবে ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার।

বিশ্বব্যাপী পুরুষের চেয়ে নারীদের বেকারত্বের হার বেশি বলেও আইএলওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। আইএলওর হিসাবে ২০১৭ সালে বিশ্বে নারীদের বেকারত্বের হার ৬ দশমিক ২ শতাংশ, পুরুষদের বেকারত্বের হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ পুরুষদের তুলনায় নারীদের বেকারত্বের গড় হার বেশি। আগামী ২০২১ সাল পর্যন্ত এই পরিস্থিতির পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম বলে মনে করে আইএলও।

অর্থনীতিতে অবদানের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লে তা নারীর ক্ষমতায়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ৮০ শতাংশ নারী শুধু ঘরে থাকার চেয়ে অর্থ উপার্জন করা যায় এমন কাজ করতে বেশি আগ্রহী। কিন্তু ইচ্ছা থাকার পরেও ৪০ শতাংশ কর্মক্ষম নারী এই অঞ্চলে কোনো কাজ পাচ্ছেন না।

আইএলওর এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক তোমোকো নিশিমোতো এ প্রসঙ্গে বলেন, যেসব কারণে নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করতে যাওয়া কঠিন, সেই প্রতিকূলতাগুলো এখনো এই অঞ্চলে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। নারীদের কাজে যাওয়ার জন্য পরিবারের মধ্যে ইতিবাচক ও সহযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

আইএলওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ২০ শতাংশ নারী সংসার ও কাজের মধ্যে ভারসাম্য ধরে রাখতে পারেন না। এই সমস্যার কারণে তাঁদের বাধ্য হয়ে অনেক সময় চাকরি ছাড়তে হয়। ২২ শতাংশ নারী কাজের কারণে নিজের ও পরিবারের যত্ন নিতে না পারায় চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন বলে জানিয়েছেন।

কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমিয়ে আনতে কিছু সুপারিশও করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ জন্য নারীদের বিষয়ে সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন নেতিবাচক ধারণা ভেঙে ফেলার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নারীদের শিক্ষার পেছনে পরিবার ও রাষ্ট্রের বিনিয়োগ বাড়ানো, পারিশ্রমিকের বৈষম্য দূর করার মতো বিষয়েও জোর দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনটির অন্যতম রচয়িতা স্টিভেন টবিনের মতে, বিশ্বের অনেক এলাকায় নারীর ঘরের বাইরে কাজ করাকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়। এতে নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করাটা অনেক সময় কঠিন হয় পড়ে। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও নারীদের কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন। নারীর প্রতি এ ধরনের সামাজিক মনোভাবে পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলেই এই বৈষম্য অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।