ভাগ্য ফেরাচ্ছে কমলা

রাঙামাটির নানিয়ারচরে বাগান থেকে কমলা তুলছেন চাষি মুধুসুদন তালুকদার। ছবিটি গত মঙ্গলবার দুপুরে সাবেক্ষং গ্রাম থেকে তোলা l সুপ্রিয় চাকমা
রাঙামাটির নানিয়ারচরে বাগান থেকে কমলা তুলছেন চাষি মুধুসুদন তালুকদার। ছবিটি গত মঙ্গলবার দুপুরে সাবেক্ষং গ্রাম থেকে তোলা l সুপ্রিয় চাকমা

চাষি মুধুসুদন তালুকদারের জমিজিরাত ছিল ভালোই। কিন্তু চাষের টাকায় সংসার চলত কোনো রকমে। টানাটানি লেগেই থাকত। মৌসুমি ফলের চাষ করে সারা বছরের খরচ জোগাতে হিমশিম অবস্থা ছিল। তবে সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। সচ্ছলতা এসেছে মুধুসুদনের সংসারে। এখন তিনি সফল কমলাচাষি।

 রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলা সদর ইউনিয়নের সাবেক্ষং গ্রামের নবকার্বারিপাড়ায় মধুসুদনের বাড়ি। উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরত্বে তাঁর বাড়ি। বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে একটি টিলায় তাঁর ‘অভাব জয়ের’ কমলা বাগান।

মুধুসুদন বলেন, ২০০৭ সালে ৭০০টি গাছ নিয়ে ৬ একর জায়গায় কমলা বাগান শুরু করেন। সাত বছরের মাথায় ২০১৪ সালে ফলন আসতে শুরু করে। ওই বছরই বিক্রি করেন ৩ লাখ টাকার কমলা। খরচ বাদ দিয়ে লাভ ছিল দেড় লাখ টাকার মতো। এরপর দিনে দিনে বেড়েছে ফলন। তাঁর আশা এ বছর অন্তত ১২ লাখ টাকার কমলা বিক্রি করবেন। ইতিমধ্যে ৩ লাখ টাকার কমলা বিক্রি করেছেন। মুধুসুদনের শুধুই যে সচ্ছলতা এসেছে তা নয়, বেড়েছে সম্পদও। আগে ছিল ৯ একর জমি। এখন উপজেলা সদরের টিঅ্যান্ডটি এলাকায় ৮ লাখ টাকা দিয়ে ২০ শতক জমি কিনেছেন।

মধুসুদনের মতো কমলাচাষি শিপন চাকমা, দীপন চাকমা, দীপায়ন চাকমা ও নবজ্যোতি চাকমাদেরও সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। তাঁদের বাগানে কমলাগাছ রয়েছে ১০০ থেকে ৩০০টি পর্যন্ত। এসব বাগানে অধিকাংশ কমলাগাছে এ বছর ফলন এসেছে। এ বছর নানিয়ারচরের কমলার ফলনও ভালো হয়েছে।

কমলাচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে সাবেক্ষং গ্রামটিতে বসতি শুরু হয়। এরপর গ্রামবাসী জুমচাষ করে কোনো রকমে সংসার চালাতেন। পরবর্তী সময়ে জুমচাষ থেকে উৎপাদন কম হওয়ায় গ্রামে খাদ্যসংকট দেখা দেয়। জুমচাষের বদলে মিশ্র ফলদ বাগান শুরু করেন চাষিরা। মিশ্র ফলদ বাগানে মধ্যে কাঁঠাল, আম, কলা, লিচু ও জাম্বুরার চাষ হতো। কিন্তু যাতায়াত ব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ায় চাষিরা তেমন লাভবান হতে পারেননি। ২০০৭ সাল থেকে গ্রামের মধুসুদন তালুকদারসহ বেশ কয়েকজন কমলা চাষ শুরু করেন। এখন এই এলাকায় ২৫ জনের বেশি কমলাচাষি রয়েছেন।

রাঙামাটি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় এ বছর ১ হাজার ৮৬২ একর জমিতে কমলা চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৬৩৯ মেট্রিক টন। নানিয়ারচর উপজেলা কমলা চাষ হয়েছে ১৭৫ একরে। আর মধ্যে শুধু সাবেক্ষং গ্রামে ১১১ একর জমিতে কমলা চাষ করা হচ্ছে।

সরেজমিনে মুধুসুদনের বাগানে গিয়ে দেখা যায়, ১০ থেকে ১৫ ফুট উঁচু গাছগুলো কমলার ভারে নুয়ে পড়ছে। প্রায় সব গাছে বাঁশের ঠেস দিয়ে দেওয়া হয়েছে। নজর কাড়েছ হলুদ রঙের কমলা। 

 চাষি মধুসুদন প্রথম আলোকে বলেন, নানিয়ারচরের সাবেক্ষংয়ের নবর্কাবারিপাড়ায় কমলা মিষ্টি ও আকারে বড় হওয়ায় বাজারে প্রতি জোড়া ৬০ থেকে ৭০ টাকা করে বিক্রি হয়। তবে চাষিরা বাগান থেকে প্রতি জোড়া ৩০ থেকে ৩৫ টাকা করে বিক্রি করছেন। একেকটি কমলার ওজন ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম পর্যন্ত। আবহাওয়া ও মাটি উর্বর হওয়ায় কমলা হাতের মুঠোয় আটে না। 

রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক পবন কুমার চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম কমলা চাষের জন্য উপযুক্ত স্থান। তবে মাটি ও আবহাওয়ার ওপর ভিত্তি করে কমলার ফলন, মিষ্টি ও ছোট-বড় হয়। আগে পাহাড়ে কমলার ফলনে সুনাম ছিল সাজেকের। গত কয়েক বছর ধরে নানিয়ারচর উপজেলা কমলা উৎপাদনে বেশ নাম করছে। কমলাগুলো আকারে বড় ও মিষ্টি। চাষিরাও লাভবান হচ্ছেন।