উদ্যোক্তা তৈরির টাকা বেহাত

উদ্যোগও সফল হয়নি, টাকাও ফেরত আসছে না। কারণ, প্রভাবশালীরা উদ্যোক্তা তৈরির সুদবিহীন মূলধনের বেশির ভাগ টাকাই মেরে দিয়েছেন। তাঁদের অনেককে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। এরপরও নতুন করে মূলধন জোগান দেওয়ার তৎপরতা চলছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে সমমূলধন তহবিল বা ইইএফ ব্যবস্থাপনাকারী সংস্থা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

গত অক্টোবর পর্যন্ত ইইএফ থেকে সারা দেশের ৯৫৫ জন ব্যক্তিকে ১ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা মূলধন জোগান দেওয়া হয়েছে। এর অর্ধেক টাকাই আদায় হচ্ছে না। সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও টাকা ফেরত না দেওয়ায় এবং মূলধনের যথাযথ ব্যবহার না করায় কৃষি খাতের ১৫১টি প্রতিষ্ঠান ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ২৪ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে আইসিবি।

জানতে চাইলে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী সানাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুদবিহীন মূলধন দেওয়ার পরও যারা সফল হতে পারেনি, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এসব অর্থায়নের বড় অংশই শুরুর দিকের। আমরা এখন অনেক দেখেশুনে অর্থ ছাড় করছি। কোনো ধরনের দুর্ঘটনা যেন না হয়, তা নিশ্চিত করা হয়েছে। পরিদর্শন প্রতিবেদন ভালো না হলে অর্থ ছাড় করা হচ্ছে না।’

কৃষিভিত্তিক ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি এবং খাত দুটির উন্নয়নে ১০০ কোটি টাকা নিয়ে ২০০১ সালে গঠন করা হয়েছিল ইইএফ নামের এই তহবিল। ২০০৯ সাল পর্যন্ত এটি পরিচালনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত এ সময়ে দেওয়া অর্থের বড় অংশেরই খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ২০০৯ সালের পর তহবিলটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় আইসিবিকে। ইইএফ পরিচালনায় এখন পর্যন্ত ২ হাজার ২৫ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার।

তহবিলের নিয়ম অনুযায়ী, ইইএফ সহায়তার প্রথম কিস্তি ছাড়ের দিন থেকে পরবর্তী আট বছরের মধ্যে পুরো অর্থ ফেরত দেওয়ার কথা। এর মধ্যে কৃষিভিত্তিক প্রকল্পের ক্ষেত্রে তহবিলের প্রথম কিস্তি ছাড়ের ৪ বছরের মধ্যে ২০ শতাংশ অর্থ ফেরত দিতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্পের ক্ষেত্রে প্রথম কিস্তি ছাড়ের ৪ বছরের মধ্যে ১০ শতাংশ ফেরত দিতে হয়।

আইসিবি সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের আগে যাঁরা আবেদন করেছিলেন, তাঁদের অনেককে এখনো মূলধন জোগান দেওয়া হচ্ছে। তবে অর্থ ছাড়ের আগে পরিদর্শন করা হচ্ছে। এরপরই অর্থ ছাড়। তবে বেশির ভাগ পরিদর্শনেই প্রকল্পগুলোর বিষয়ে ভালো তথ্য মিলছে না। অনেকেই অর্ধেক টাকা বিনিয়োগ করেছেন, আবার কেউ কেউ অন্যের প্রকল্প ভাড়া নিয়ে চালাচ্ছেন। তবে উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তার চাপে শেষ পর্যন্ত এসব প্রতিবেদন ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে অর্থ ছাড় করতে হচ্ছে।

২০১৪ সালে কুমিল্লা জেলায় মঞ্জুর এগ্রো ফার্মকে মূলধন জোগান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আইসিবি। পাম ফল থেকে পাম তেল উৎপাদিত হবে, এ জন্য নতুন এই উদ্যোগে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া উদ্যোক্তা নিজে এ তহবিলে ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা জোগান দেবে। আইসিবি দুই দফায় প্রতিষ্ঠানটিকে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা দেয়। এরপর আইসিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম দেখতে যৌথ পরিদর্শন করে। ওই পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘টাকা দেওয়ার পরও প্রকল্পটির উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। টাকা ছাড়ের আগের অবস্থাতেই রয়েছে। তহবিলের সিংহভাগ অর্থ প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়নি।’ এরপরও ইইএফ তহবিলের বাকি ৩২ লাখ টাকা ছাড়ের আবেদন করেন উদ্যোক্তা।

আইসিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার চাপে এই প্রকল্পে বাকি অর্থ ছাড়ের জন্য নতুন করে পরিদর্শন করা হয়। এতেও উঠে এসেছে, ‘আধুনিক পদ্ধতিতে পাম ফল থেকে তেল উৎপাদন করা হবে, এ শর্তেই প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু এতে পাম তেলের পরিবর্তে দেশীয় সরিষার তেল উৎপাদন করা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রকল্পের ভেতরেই গরুর খামার তৈরি করা হয়েছে।’ এরপরও ওই প্রকল্পে নতুন করে অর্থ ছাড়ের প্রক্রিয়া চলছে।

মঞ্জুর এগ্রোর এমডি মঞ্জুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শীতের কারণে পাম ফল পাওয়া যাচ্ছে না, এ কারণে উৎপাদন বন্ধ আছে। গরুর খামার, সরিষার তেল ও কৃষি খামার আমার নিজস্ব প্রকল্প। কিছু কর্মকর্তা প্রকল্পের নামে ভালো প্রতিবেদন দেয়নি, এ কারণে তাদের সঙ্গে ঝামেলাও হয়ে গেছে। বিষয়টার সুরাহা হয়ে যাবে।’

মঞ্জুর হোসেন জানান, চার জেলায় পাম ফল লাগানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিএসআর তহবিল থেকে এ জন্য ১০ লাখ টাকাও দিয়েছে। তবে আগের মতো সহায়তা মিলছে না।’